ঘোরাঘুরি

৮০০ টাকায় জৈন্তা রাজাদের জৈন্তেশ্বরী

Looks like you've blocked notifications!

'জৈন্তেশ্বরী বাড়ি’ মূলত : সিন্টেং বা জৈন্তা রাজাদের পূজিত দেবতার বাড়ি । জৈন্তার রাজা যশোমানিক ১৬১৮ সালে অত্যন্ত আড়ম্বরে উপহার হিসেবে প্রাপ্ত কালি দেবীর মূর্তিকে এ বাড়িতে স্থাপন করেন এবং বাড়িটি নির্মাণ করেন। বাড়িটির মধ্যখানে মূল মন্দির ঘরটির অবস্থান। বর্তমানেও মূল ঘরটির ভিটা এবং সংলগ্ন দক্ষিণের ঘরটি নানা দৈব-দুর্বিপাকের মধ্যেও দাঁড়িয়ে আছে। কিছুটা সংস্কার করে একদল হিতৈষী ব্যক্তি ঘরটি ’ইরাদেবী মিলনায়তন’ নামকরণ করেছেন এবং বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান মাঝেমধ্যে এতে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। যারা ঐতিহাসিক নিদর্শন দেখতে পছন্দ করেন তাদের জন্য জৈন্তেশ্বরী অসাধারণ একটি স্থান। আর খরচের কথা ভাবছেন খরচ মাত্র ৮০০ টাকা

ইতিহাস

রাজা ধন মানিক ১৫৯৬ থেকে ১৬০৬ সাল পর্যন্ত জৈন্তিয়ার অধিপতি ছিলেন । তাঁর মৃত্যুর পর ১৬০৬ সালে কাছাড় রাজ শত্রুদমন যশোমানিককে মুক্তি দেন। যশোমানিক দেশে ফিরে আসেন ও সিংহাসন লাভ করেন। ১৬১৮ সালে শত্রুদমন ও অসমরাজ প্রতাপ সিংহের মধ্যে যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে প্রথমে কাছাড় রাজ পরাজিত হন। যুদ্ধ জয়ের পর অহম রাজ সেনাপতি সুন্দর গোসাইকে রহা দুর্গে রেখে নিজে রাজধানীতে প্রত্যর্পণ করেন। এ সুযোগে কাছাড় পতির ভ্রাতা ও সেনাপতি ভীমবল রহা দুর্গ আক্রমণ করেন। অতর্কিত এই আক্রমণ প্রতিরোধে তিনি অসমর্থ হন, বেশির ভাগ সেনা মৃত্যুবরণ করেন, বাকিরা পালিয়ে যান। কাছাড়পতি এই বিজয়কে স্থায়ী করার জন্য রাজধানী মাইবঙ্গের নতুন নাম করেন ’কীর্তিপুর’। এ সময় থেকে কাছাড়পতিকে জৈন্তাপতি কর্তৃক বার্ষিক নজরানা দেওয়ার প্রথাও রহিত হয়।

শত্রুদমনের এই বিজয়ের পর যশোমানিক কোচবিহার গমন করেন এবং কোচরাজ লক্ষ্মীনারায়ণের কন্যাকে বিয়ে করেন। সে বিয়েতে যৌতুকস্বরূপ ধাতুনির্মিত মূল্যবান একটি দেবমূর্তি প্রাপ্ত হন। দেবী কালীর সে মূর্তিকে অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে জৈন্তাপুরে নিয়ে মহাসমারোহে ’জৈন্তেশ্বরী কালী’ নামে প্রতিষ্ঠিত করেন।

যা দেখবেন

প্রবেশ পথে দেখা পাবেন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সাইনবোর্ড সংরক্ষিত পুরাকীর্তি । ভেতরে প্রবেশের পর দেখবেন ভগ্ন প্রায় দেওয়ালের অংশ। সামনে এগিয়ে গেলে পুরোনো ঘর দেখতে পাবেন। ঘরটির সামনে দেখতে পবেন একটি সাইনবোর্ড ‘ইরাদেবী মিলনায়তন’ । ঘরটি টিনের তৈরি এবং সমতল থেকে প্রায় চার-পাঁচ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। কয়েকটি সিঁড়ি বেয়ে ঘরটিতে প্রবেশ করতে হয়। ঘরটির স্তম্ভগুলো লোহার এবং স্থাপত্যশৈলী বেশ দৃষ্টিনন্দন। ঘরটির পশ্চিম দিকে দেয়াল সংলগ্ন প্রায় দু’ফুট উঁচু পাকা মঞ্চ ধাঁচের একটি জায়গা আছে, যেটি ’চণ্ডীর থালা’ নামে পরিচিত। বিগত কয়েক দশক আগেও এখানে একজন ব্রাহ্মণ বসবাস করতেন। এ ঘরটি সংলগ্ন পেছনের দিকে আরেকটি ঘর ছিল, যেটির কয়েক ফুট উঁচু পাকার ভিটা এখনো দেখা যায়। এ ঘরটিই মূল মন্দির ঘর ছিল এবং এটি আয়তাকার। ভিত থাকলেও উপরের কাঠামোটি সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে গেছে। সম্ভবত এখানে জৈন্তেশ্বরী দেবী অধিষ্ঠিত ছিলেন । ঘরটি যে খুবই মজবুত ও সুরক্ষিত ছিল, তা বর্তমান ধ্বংসাবশেষ দেখেই নিশ্চিত হওয়া যায়।

১৯০০ খ্রিস্টাব্দে দেবীর মূর্তিটি চুরি হয়ে যায়। এ ঘরটির দক্ষিণ দিকে রয়েছে একটি পানির কূপ যা স্থানীয়দের কাছে ’ইন্দিরা’ নামে পরিচিত। কূপটি পাকার বাঁধানো এবং বর্তমানে এটির পানি আর ব্যবহার উপযোগী নয়। এর পাশেই রয়েছে পাকার উঁচু গোলাকৃতি একটি পাটাতন বা বেদি যেখানে মানুষ বলি দেওয়া হতো বলে কথিত আছে। এজন্য পাটাতনটি ’বলির পাটাতন’ নামে পরিচিত। বেদীটি বেলে পাথরের তৈরি এবং আয়তন প্রায় ৩ বর্গ মিটার। বেদির গোলাকৃতি অংশ থেকে উত্তর দিকে ক্রমেই নিচের দিকে একটি সিঁড়ি চলে গেছে । এটির দুটি ধাপ রয়েছে-প্রথমাংশ সামান্য উঁচু এবং পরের অংশ প্রথমাংশ থেকে খানিকটা নিচু হয়ে ক্রমেই ভূমির দিকে চলে গেছে। সম্ভবত নরবলি দেওয়ার নানা ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান এখানে সম্পাদিত হতো। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই মানুষ বলি দেওয়ার অপবাদেই ব্রিটিশরা ১৮৩৫ সালে জৈন্তারাজ্য দখল করে নেয়। বর্তমানে বাড়িটিতে মোট তিনটি ফটক দেখা যায়। মূল ফটকটি দক্ষিণ দিকে অবস্থিত এবং সেটি সাবেক কালেব রাজকীয় ভাব অনেকটা ধরে রাখতে পেরেছে। যদিও সংস্কার ও পরিচর্যা অভাবে সেটি এখন প্রায় বিবর্ণ এবং ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পের কারণে উপরের অংশটি ভেঙে পড়েছে। অপর গেইট দুটির একটি পূর্বদিকে এবং একটি পশ্চিমদিকে অবস্থিত ।

নিরাপত্তার জন্য সে দুটি এখন বন্ধ করে রাখা হয়েছে। সম্ভবত রাজা রাজবাড়ি হতে এ পূর্বদিকের গেইট দিয়েই যাতায়াত করতেন। তবে এ বাড়ির সবচেয়ে আকর্ষণ এবং দর্শনীয় বিষয়টি হচ্ছে বাড়িটির বিরাট উঁচু দেয়াল। বিশাল এ বাড়িটির পুরোটাই ৮ হাত উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা এবং দেয়ালের মধ্যে হাতি, ঘোড়াসহ নানাপ্রকার প্রাণীর চিত্র অঙ্কিত আছে। জৈন্তেশ্বরী বাড়ির দেয়ালের মধ্যে উত্তর-পশ্চিম দিকে আরেকটি ভবনের ধ্বংসাবশেষ এখন দেখতে পাওয়া যায়। এটি সম্ভবত রাজ্যের সচিবালয় হিসেবে ব্যবহৃত হতো। মন্দিরের দক্ষিণ দিকটি রাজার দরবার হল হিসেবে ব্যবহৃত হতো বলে কথিত আছে এবং প্রধান ও অভিজাতদের বসার জন্য সেখানে পাথরের আসন রয়েছে। সে পাথরগুলো ’মেগালিথিক’ নামে পরিচিত এবং এগুলো জৈন্তিয়ার প্রাচীনত্বের এক জীবন্ত নিদর্শন।

যাবেন কীভাবে

ঢাকা থেকে ট্রেনে বা বাসে সিলেট যাবেন খরচ মাত্র ৩০০ থেকে ১২০০ টাকা। সিলেট থেকে এক ঘণ্টার পথ জৈন্তাপুর। বাস, মিনিবাস, সিএনজিচালিত অটোরিকশা বা মাইক্রোবাসে চড়ে জৈন্তাপুর চলে যেতে পারেন খরচ ৫০ থেকে ১০০ টাকার ভেতর। উঠতে পারেন জৈন্তা হিল রিসোর্টে অথবা কাছের নলজুড়িতে জেলা পরিষদ ডাকবাংলোয়। আগে থেকেই বুকিং দিয়ে যেতে হবে ডাকবাংলোয়। শহর থেকে মাইক্রবাস নিয়ে গেলে ভাড়া নিবে ২৫০০ থেকে ৩০০০।