ছুটির দিনে

৭৩৭ জনের শেষ ঠিকানা

Looks like you've blocked notifications!

কুমিল্লা শহর থেকে প্রায় সাত কিলোমিটার দূরে ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টের কোল ঘেঁষে রয়েছে এক উজ্জ্বল ইতিহাস ‘ওয়ার সিমেট্রি’। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত হওয়া ৭৩৭ সৈনিকের সমাধিস্থল। কুমিল্লায় স্থানীয়ভাবে এটাকে ইংরেজ কবরস্থান বলা হয়।

শহুরে যান্ত্রিক কোলাহল ছেড়ে প্রকৃতির সান্নিধ্য পেতে চাইলে চলে আসতে পারেন ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টের কোল ঘেঁষে ‘ওয়ার সিমেট্রি’-তে। ময়নামতি সেনানিবাসের সামনে থেকে কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়ক ধরে কিছুটা উত্তরের দিকে ওয়ার সিমেট্রি। মূল সড়কের পাশে উঁচু-নিচু টিলাসদৃশ ১৫ একর জায়গা নিয়ে সাজানো-গোছানো এক অপূর্ব স্থান। অপরূপ সুন্দর, তবে এর রয়েছে বিষাদময় ইতিহাসের কথা।

ইতিহাস

১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত চলমান বিভীষিকাময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতার স্মৃতিচিহ্ন এই স্থান। এখানেই ঘুমিয়ে আছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বলি হওয়া ৭৩৭ মানবপুত্র। নিজ বাড়ি ছেড়ে হাজার হাজার মাইল দূরে এখানেই যাঁদের শেষ ঠিকানা। ৭৩৭ জনের সবাই নিজের দেশের জন্য প্রাণ উৎসর্গ করা বীর। এর মধ্যে ব্রিটেনের ৩৫৭ জন, কানাডার ১২, অস্ট্রেলিয়ার ১২, ভারতীয় উপমহাদেশের ১৭৮, পূর্ব আফ্রিকার ৫৬, পশ্চিম আফ্রিকার ৮৬, নিউজিল্যান্ডের ৪, দক্ষিণ আফ্রিকার ১, রোডেশিয়ার ৩, পোল্যান্ডের ১, বেলজিয়ামের একজনসহ রয়েছে ২৪ জাপানির (যুদ্ধবন্দি) সমাধি।

মূল ফটক দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই চোখে পড়বে ফটকের দেয়ালে বাংলা ও ইংরেজিতে লিপিবদ্ধ ইতিহাসসংবলিত পিতলের ফলক। তার প্রশস্ত হাঁটার পথ, যার দুই ধারেই সবুজ ঘাসের মধ্যে সৈনিকদের সারি সারি সমাধি। প্রতিটি সমাধিকে ঘিরে রেখেছে নানা জাতের নানা রঙের ফুলের গাছ। এ গাছগুলোয় ফুল ফোটে সমাধির প্রতিটি নিহত সৈনিকের জন্য। ফুলের ছায়ায় চিরকালের নিদ্রা আর ভাঙবে না তাঁদের। তাঁরা কমনওয়েলথভুক্ত সেনা ও বিমানবাহিনীর জীবন উৎসর্গ করা সদস্য। প্রতিটি সমাধির শিয়রের প্রস্তরফলক বা এফিটাফ (ব্রঞ্জের পাতের ওপরে খোদাই করা) রয়েছে সেখানে সমাহিত সৈনিকের নাম, পদবি, রেজিমেন্ট, বয়স, মৃত্যুর তারিখ এবং ধর্মীয় প্রতীক। হাতে গোনা কয়েকটি সমাধি বাদে সব সমাধির এপিটাফে রয়েছে তাঁদের প্রিয়জনের কিছু কথা। হঠাৎ করেই চোখ আটকে গেল একটি এপিটাফ ইংরেজি অক্ষরে লেখা দুটো লাইনের দিকে। কবরটি ১৯৪৪ সালের ১১ জুন ৩০ বছর বয়সে নিহত হওয়া ব্রিটিশ লেফটেন্যান্ট সি এইচ মাচহিনের (Lieutenant C.H MACHIN), এটি হলো ‘HEARTS THAT LOVED YOU, WILL NEVER FORGET YOU.’ C.H MACHIN-এর স্ত্রীর প্রিয় স্বামীর সমাধির এপিটাফ লেখাটির বাংলা অর্থ দাঁড়ায়, ‘যে হৃদয় তোমাকে ভালোবেসেছে, সেই হৃদয় কোনোদিনও তোমাকে ভুলবে না।’ কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে ছিলাম সমাধিটার দিকে। কেন যেন অনায়াসেই আমার অশ্রু ঝরে পড়ল এপিটাফের ওপর। হৃদয়টা হাহাকার করল তার জন্য। কী অপরিমেয় ভালোবাসা। একে একে দেখলাম অনেক সমাধি। হৃদয়ে নাড়া দেওয়া কথা/উক্তি রয়েছে বাকিগুলোয়ও। কোনোটা বাবা বা মা তাঁর ছেলের জন্য, কোনোটা বোন তাঁর ভাইয়ের জন্য, কোনোটা ছেলে তাঁর পিতার জন্য লিখেছেন। এসব এপিটাফ যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে প্রিয়জনের সমাধিতে লিখে গেছেন চিরনিদ্রায় শায়িত সেনাদের স্বজনরা। টি টি নক্স (T.T KNOX) নামের আরেক সেনাসদস্যের সমাধির প্রস্তরফলকে, ‘HE DIED THAT WE MIGHT LIVE.’ বাংলায় ‘সে তার জীবন উৎসর্গ করেছে যেন আমরা বেঁচে থাকতে পারি’। তার পরিবারের সদস্যদের লিখে যাওয়া এই বাক্য এখানে শুয়ে থাকা প্রত্যেক সেনার অসামান্য আত্মত্যাগের অতি সামান্য এক স্বীকৃতি।

ঘুরে ঘুরে অনেক সমাধি দেখে এরপর প্রশস্ত পথ ধরে কিছুটা সামনে এগিয়ে গেলেই দেখবেন সিঁড়িবিশিষ্ট একটি বেদি। তার ওপরে শোভা পাচ্ছে খ্রিস্টধর্মীয় প্রতীক ‘ক্রুশ’। বেদিটির দুই পাশে রয়েছে দুটি তোরণঘর। এই তোরণঘরের মধ্যে পথ এগিয়ে চলছে পেছনের দিকে। সমাধিস্থলটির পেছনের অংশেও রয়েছে অনেক সমাধি।

সমাধির সারি সারি মিছিলের এক অংশ যেন। এখানেই আলাপ হলো সমাধিস্থলটির রক্ষণাবেক্ষণে নিয়োজিত এক কর্মচারী বিলফ্রেডের সঙ্গে। ক্ষণিকের আলাপচারিতায় তিনি আমাদের জানালেন, দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে এই স্থানটির রক্ষণাবেক্ষণ করছেন তিনি। তাঁর সঙ্গে আরো চারজন কাজ করেন। কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর সংগঠন ‘কমনওয়েলথ গ্রেইভস কমিশনের’ তত্ত্বাবধানে সমাধিস্থলটি পরিচালিত হয়। পেছনের অংশে রয়েছে মুসলমান ও হিন্দু ধর্মাবলম্বী সেনাদের সমাধি। দক্ষিণ-পশ্চিমাংশে রয়েছে জাপানের (শত্রুপক্ষ) ২৪ জন সৈনিক ও বেসামরিকের সমাধি।

সময়সূচি

খুব সুন্দর করে সাজানো-গোছানো থাকে সমাধিস্থলটি। প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে দুপুর ১২টা এবং দুপুর ২টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত সবার জন্য এটি উন্মুক্ত থাকে। এ ছাড়া ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার জন্য তিন দিন করে বন্ধ থাকে এই সমাধিস্থল। মূল ফটক থেকে ভেতরে প্রবেশের আগেই কিছু নির্দেশাবলির দিকে চোখ যাবে সবার। যেমন : বসে গল্প করবেন না, গেট বন্ধ থাকলে খোলার জন্য অনুরোধ করা যাবে না, যাঁরা শায়িত আছেন তাঁদের প্রতি সম্মান দেখাতে হবে, নোংরা করবেন না, ক্যামেরা নিয়ে প্রবেশ করবেন না। তবে এখানে সমাধিস্থল পরিচালনার কোনো অফিস নেই বলে ইচ্ছা থাকলেও এর কোনো কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলতে পারিনি।

সবুজে ঘেরা নানা প্রজাতির ফুলগাছ বেষ্টিত এই স্থান তার মোহনীয় সৌন্দর্য দ্বারা মনকে যেমন আনন্দিত করে, তেমনি দিয়ে যায় এক অজানা বিষণ্ণতার পরশ। নিবিড় এই পরিবেশে এসে আমাদের মতো যে কেউ নির্বিঘ্নে কাটিয়ে দিতে পারবে অসাধারণ বেশ কয়েকটি মুহূর্ত। ইতিহাসের নিদর্শনের সঙ্গে বিনম্র ভালোবাসা সংগ্রহ করে নিয়ে ওই দিনের মতো চলে আসতে পারেন আপনি।

যেভাবে যাবেন

ঢাকা থেকে কুমিল্লাগামী যেকোনো বাসে উঠে কুমিল্লার ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টে নেমে পড়তে হবে। সায়েদাবাদ থেকে কুমিল্লাগামী বেশ কিছু বাস আসে। ভাড়া জনপ্রতি ১৫০ থেকে ২৫০ টাকা। সেখান থেকে উত্তরে কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কে ১০ মিনিটের হাঁটার পথ। তবে চাইলে রিকশা বা অটোরিকশায়ও যাওয়া যায়। ভাড়া জনপ্রতি ১০ টাকা। এখানে কোনো আবাসিক হোটেল নেই। আবাসিক হোটেলের জন্য আপনাকে কুমিল্লা শহরে যেতে হবে।