সিংহ বাড়িতে কবিগুরুর পদধূলি
১৩২৬ বাংলা সালের কার্ত্তিক মাসের মাঝামাঝি। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ তখন বেড়াতে এসেছেন শিলং শহরে। ব্রাহ্ম সমাজের তদানীন্তন সম্পাদক, পরলোকগত গোবিন্দনারায়ণ সিংহ ছিলেন গুরুদেবের একান্ত অনুরাগী। কবি শিলংয়ে এসেছেন একথা শোনামাত্র তাকে সিলেটে আনার জন্য গোবিন্দনারায়ণ সিংহের খুব আকাঙ্ক্ষা হল। চটপট করে তিনি ব্রাহ্ম সমাজের পক্ষ থেকে কবিকে শ্রীভূমি সিলেটে আসার সাদর আমন্ত্রণ জানিয়ে তার করলেন। কবি জবাবে জানালেন , সিলেটে আশা তাঁর পক্ষে সম্ভবপর নয়। কেননা দীর্ঘ পথ ভ্রমণ বিরক্তিকর। কবির অসম্মতি জানার পরও গোবিন্দনারায়ণ সিংহ নিরস্ত হলেন না। “আঞ্জুমান ইসলাম”, মহিলা সমিতি ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ও টেলিগ্রাম করবার ব্যবস্থা করলেন। এমনি ভাবে যখন তাঁর কাছে আহ্বানের পর আহ্বান আসতে লাগলো, তখন অগত্যা তাকে সম্মতি জানাতেই হল। বন্ধুরা আপনি চাইলে ঘুরে আসতে পারেন সিলেটে কবিগুরুর পদ ধূলি প্রাপ্ত সেই সিংহ বাড়ি থেকে।
সিলেট শহরের বন্দরবাজার , জিন্দাবাজার পেড়িয়ে চৌহাট্টায় অবস্থিত সিংহ বাড়ী। প্রবেশ দ্বারেই দেখা পাবেন “সিংহ বাড়ী ” নাম ফলকের। শহর জীবনে এক অন্য রকম পরিবেশ পেলাম বাসার ভেতরে। হাতের বাঁয়ে দেখা পাবেন ছোট্ট একটি পুকুরের শান বাধানো ঘাট। চারপাশে গাছগাছালি ছায়া এক অন্য রকম পরিবেশ নগর জীবনে। শহুরে জীবনে ছায়া ঘেরা পরিবেশ পাওয়া খুব কঠিন। একদিকে পাখিদের কুহু কুজন শব্দ অন্য দিকে নগর জীবনের যান্ত্রিকতার ছোঁওয়া। সব মিলিয়ে এক অন্যরকম পরিবেশ। প্রথমে দেখতে পাবেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে ঘরে উপাসনায় অংশগ্রহণ করেন সে ঘরের। আরেকটু কাছে এগিয়ে গেলেই পুকুর পাড়। সামনে এগিয়ে গেলেই দেখা পাবেন সেই ঘরের দিকে যেখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সবার সাথে ছবি তোলেন।
ভৌগলিক দিক দিয়ে সিলেট শিলংয়ের কাছাকাছি হলেও সিলেট পর্যন্ত সরাসরি রাস্তা ছিলো না। শিলং থেকে চেরাপুঞ্জি পর্যন্ত সড়ক ছিল। চেরাপুঞ্জি থেকে খাসিয়ারা ব্যক্তিকে বহন করে নিয়ে যাওয়ার একটি পদ্ধতি প্রচলন ছিলো। কিন্তু এ ব্যবস্থা মানবাধিকারের লংঘন বলে কবি সরাসরি নাকচ করেন এবং সিলেট থেকে প্রেরিত নিমন্ত্রণ বিনয়ের সাথে প্রত্যাখ্যান করেন। কবির নেতিবাচক উত্তর পেয়ে গোবিন্দ নারায়ন সিংহ, আনজুমানে ইসলাম, মহিলা পরিষদসহ বিভিন্ন সংঘটনের সাথে যোগাযোগ করে কয়েকটি টেলিগ্রাম পাঠান। আবেগঘন টেলিগ্রামগুলো কবির হৃদয়কে প্রভাবিত করে। তিনি সিলেট আসার দীর্ঘ অথচ বিকল্প পথ গৌহাটী থেকে আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ের লামডিং-বদরপুর সেকশন হয়ে করিমগঞ্জ-কুলাউড়া হয়ে সিলেট পৌঁছানোর পথে সিলেট আসতে রাজী হন।
৩১ অক্টোবর কবিগুরু শিলং থেকে গৌহাটী অভিমূখে যাত্রা করেন। সেখানে কবিকে সংবর্ধনা জানানোর জন্য বিশাল আয়োজন করা হয়। দিন তিনেক সেখানে অবস্থান করে কবি ৩ নভেম্বর গৌহাটী থেকে সিলেটের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। গৌহাটী থেকে সিলেটের পথ প্রায় প্রতিটি স্টেশনেই কবিকে এক পলক দেখার জন্য ভক্তদের ভিড় লেগে যায়। সিলেট থেকে একটি প্রতিনিধিদল কবিগুরুকে এগিয়ে আনতে বদরপুর পর্যন্ত যায়। ট্রেন কুলাঊড়া জংশনে পৌছালে তাকে প্রাণঢালা সংবর্ধনা জানানো হয়। কবি ও তার সহযাত্রীরা কুলাঊড়াতে রাত্রিযাপন করেন।
কবিকে সংবর্ধনা জানানোর জন্য অভ্যর্থন পরিষদ গঠন করা হয়। সভাপতি নিযুক্ত হন খানবাহাদুর সৈয়দ আব্দুল মজিদ। ৫ নভেম্বর সকালে ট্রেন সিলেট স্টেশনে পৌঁছালে কবিগুরুকে রাজকীয় সম্মান প্রদর্শন করা হয়। অভ্যর্থনা জানাতে উপস্থিত হন খানবাহাদুর সৈয়দ আব্দুল মজিদ, মৌলভী আব্দুল করিম, রায়বাহাদুর প্রমোদচন্দ্র দত্ত, এহিয়া ভিলা, কাজী বাড়ি ও মজুমদার বাড়ী, দস্তিদার বাড়ির অভিজাত ব্যক্তিবর্গ। সিলেট মহিলা সমাজের পক্ষে অভ্যর্থনা জানান নলিনীবালা চৌধুরী। সুরমা নদীর উপর ঐতিহ্যবাহী কীনব্রীজ তখনো হয়নি। কবিগুরু ও তার সহসঙ্গীরা বজরায় সুরমা নদী পাড়ি দিয়ে মূল সিলেট শহরে প্রবেশ করেন। সিলেটের ঐতিহ্যবাহী চাঁদনীঘাটকে পত্র-পুষ্প পতাকা, মঙ্গল ঘট আর লাল শালু দিয়ে সুসজ্জিত করা হয়। শহরের বিশিষ্ট ব্যক্তি মৌলভী আব্দুল করিমকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ একটি সুসজ্জিত ফিটন গাড়িতে করে শহরের উত্তর-পূর্বাংশে ছোট টিলার উপর পাদ্রী টমাস সাহেবের বাংলোর পাশে একটি বাড়িতে যান। এখানেই কবির থাকবার ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। সেখানে পৌঁছালে কবিকে সঙ্গীত ও চন্দন তিলকের মাধ্যমে অভ্যর্থনা জানানো হয়।
ওইদিন সন্ধ্যায় স্থানীয় ব্রাহ্মসমাজের আমন্ত্রণে কবি তাদের উপাসনায় যোগ দেন। পরদিন ৬ নভেম্বর সকালে লোকনাথ টাউনহলে কবিকে সংবর্ধনা প্রদান করা হয়। এতে স্বাগত বক্তব্য রাখেন সৈয়দ আব্দুল মজিদ। একইদিন দুপুরে মুরারীচাঁদ কলেজের (এম.সি কলেজ) বাংলা ও সংস্কৃতের অধ্যাপক নলিনীমোহন শাস্ত্রীর আমন্ত্রণে কবি তার বাড়িতে যান। বেলা দুইটায় ব্রাহ্মসমাজগৃহে সিলেট মহিলা সমিতি আয়োজিত সংবর্ধনায় যোগ দেন। এরপর কবি শহরের উপকন্ঠে মাছিমপুর এলাকায় মনিপুরী পল্লীতে যান। কবির সম্মানে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বিষ্ণুপ্রিয়া মনিপুরী রমনী কর্তৃক পরিবেশিত রাসনৃত্যে মুগ্ধ হন। এখান থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে কবিগুরু পরবর্তীকালে শান্তি নিকেতনে মনিপুরী নৃত্য চালু করেছিলেন। পরদিন সাত নভেম্বর সকালে এই সিংহ বাড়িতে আসেন কবি। পরিবারের এক নবজাতকের নামকরণ অনুষ্ঠানে কবি যোগদান করেন।
যাবেন কিভাবে
ঢাকার সায়েদাবাদ, ফকিরাপুল, রাজারবাগ ও মহাখালী বাসস্ট্যান্ড থেকে গ্রিনলাইন, শ্যামলী, এনা, হানিফ বা বিআরটিসি বাসে অথবা ট্রেনে কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে সকালে আন্তনগর পারাবাত, দুপুরে জয়ন্তিকা ও কালনী এবং রাতে উপবন সিলেটের পথে ছোটে ভাড়া ৩৬০ থেকে ১২০০ টাকার মধ্যে । সেখান থেকে চৌহাট্টায় সিংহ বাড়ী যেতে ভাড়া নেবে ৪০ টাকা, সিএনজি অটোরিকশা ভাড়া ১০০ থেকে ১৫০ টাকা।