ঘোরাঘুরি
একদিনের আনন্দ ভ্রমণ আড়িয়াল বিলে
ভরা বর্ষায় পানিতে টইটুম্বর, চারদিকে ধু ধু পানি আর পানি। ভাসমান শাপলাফুল আর দূরে কোথাও দেখা যায় ছোট কুশা বা ডিঙ্গি নাও আর, শীতে শুকিয়ে বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ। যেদিকে চোখ যায় শুধু সবুজ আর সবুজ। আর এই সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে আপনাকে যেতে হবে রাজধানী ঢাকা শহর থেকে প্রায় ৩২ কিলোমিটার দক্ষিণে মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর, ঢাকার নবাবগঞ্জ ও দোহার থানার অন্তর্গত আড়িয়াল বিলে।
আড়িয়াল বিল দেশের মধ্যাঞ্চলের সবচেয়ে বড় ও প্রাচীন বিল। এই বিলের প্রতিবেশ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে হাজার বছর ধরে। ধারণা করা হয়, অতি প্রাচীন কালে এ স্থানে গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গমস্থল ছিল, পরে উভয় নদীর প্রবাহ পরিবর্তনের ফলে এই স্থান শুষ্ক হয়ে বিলে পরিণত হয়। ঢাকা ও মুন্সীগঞ্জ জেলা এবং পদ্মা নদীর মাঝখানে একটি ছিটমহলসম জলাভূমি এ আড়িয়াল বিল।
সাঁতার জানা থাকলে আপনিও আপনাদের ভাড়া করা ট্রলার থেকে লাফিয়ে পড়তে পারেন এমনিভাবে।
বর্ষা মৌসুমে নদ-নদী দুটিতে প্রবাহ পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান থাকে বিধায় এ বিলে জমা পানি নিষ্কাশন ব্যর্থ হয়। আড়িয়াল বিল এলাকার বেশিরভাগই শুষ্ক ঋতুতে (শীত, বসন্ত ও গ্রীষ্ম) আর্দ্র থাকে এবং বিলের খালগুলোতে যথেষ্ট পরিমাণে পানি জমা থাকে।
আবার অনেকের মতে আড়িয়াল বিলকে বিল বলা হলেও এটা আসলে বিল নয়, এটা আড়িয়াল খাঁ নদের মৃত অংশবিশেষ। আড়িয়াল খাঁ পদ্মার একটা শাখা নদ যার দৈর্ঘ্য ১৫৫ কিলোমিটার। বর্তমানের এই আড়িয়াল বিল দক্ষিণে পদ্মা ও ধলেশ্বরী নদীর মাঝখানে অবস্থিত প্রায় ১৩৬ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের একটি জলাভূমি। প্রায় পুরো এলাকাই কাদা-মাটি দিয়ে আবৃত। খুব কাছাকাছি দুটি বৃহৎ নদীপ্রবাহ থাকায় বৃষ্টির পানি জমে এখানে ভরা বর্ষায় মৌসুমি প্লাবণ সংঘটিত হয়ে থাকে। ঢেউহীন এক পানির রাজ্য এই আড়িয়াল বিল। টলটলে জল-জঙ্গলে মাথাচাড়া দেয় শাপলা ও কচুরি ফুল। কোথাও কোথাও দেখা যাবে সাদা ধবধবে কাশফুল। সবুজের সমারোহে বুদ হয়ে পড়বে চোখজোড়া। নীলচে পানিতে স্পষ্ট হওয়া সাদা মেঘের প্রতিবিম্ব দেখে যে কেউ মায়াবী জগতের ভাবনায় ডুবে যাবে।
আষাঢ়, শ্রাবণ ও ভাদ্র এ তিন মাস বিলের চারপাশ থৈ থৈ করে পানিতে। চারপাশ টইটম্বুর পানিতে বিলে ভিটার উপর ঘরগুলো মাথা তুলে আছে, সঙ্গে মাথা তুলে হাঁক দিচ্ছে বুক অথবা মাথা সমান পানিতে নিমজ্জিত বড় বড় গাছ। বিলের লোকজনকে এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ি, এক পাড়া থেকে অন্য পাড়ায়, মসজিদ, মন্দির ও বাজারে যাওয়ার জন্য ছোট ছোট ডিঙ্গি নৌকা ব্যবহার করে থাকে ।
ইছামতী নদী
দুরন্ত কিশোরদের ব্রিজ থেকে লাফিয়ে বিলের পানিতে পড়া আপনার ভ্রমণের আনন্দ আরো বাড়িয়ে দেবে।
এই বিলের মধ্যদিয়ে প্রবাহিত ইছামতী নদীর ইতিবৃত্ত- ইছামমতী কিন্তু নদী না, এটা হলো খাল। কথিত আছে রাজানগরের রাজা রাজ বল্লভ রায় এই খাল খনন করেছিলেন। রাজ বল্লভ রায় ছিলেন আলিবর্দি খাঁর সহযোগী। সৈয়দপুর হয়ে খালটি রাজানগর, শেখেরনগর, আলমপুর থেকে দক্ষিণে আড়িয়াল বিলের ওপর দিয়ে শ্রীনগর হয়ে পদ্মায় গিয়ে মিশেছে।
কচুরিপানার ভিট বা ভিটা
ট্রলারে করে বেড়ানোর সময় দেখতে পাবেন কচুরিপানার ভেলা। আসলে ভেলা নয়, পুরোটাই কচুরিপানার স্তূপ। আড়িয়াল বিল আর খালের আাশপাশে থেকে এসব কচুরিপানা সংগ্রহ করে নিয়ে আসা হয়েছে। এগুলো যার যার বাড়ির সামনের উঁচু জমিতে বসানো হয়েছে। মানে পানি চলে গেলে এসব কচুরিপানা উঁচু জমিতে নিজে নিজেই বসে যাবে। তারপর সেখানে চাষ হবে লাউ আর কুমড়া। স্থানীয় ভাষায় এই ভেলাকে বলা হয় ‘ভরা’। অনেকে বলে কচুরির ভিট বা ভিটা।
দুচালা-চৌচালা দৃষ্টিনন্দন কাঠের তৈরি ঘর
শক্ত কাঠ ও টিন দিয়ে তৈরি চৌচালা বসতঘর। ছবি : সংগৃহীত
বিক্রমপুরের মূল সৌন্দর্য এখানকার দুচালা-চৌচালা সব মজবুত কাঠ দিয়ে তৈরি পাটাতন করা দুচালা-চৌচালা টিনের ঘর ও বাড়ি। পাটাতন দেওয়া সেসব দুচালা-চৌচালা ঘরের সৌন্দর্য অসাধারণ। চাইলে এসব বাড়ির এ দুচালা-চৌচালা ঘরগুলো সরিয়ে নেওয়া যায়। অর্থের প্রয়োজনে বিক্রিও করে দেওয়া যায়। এখানকার আরেক সৌন্দর্য বর্ষা মৌসুমে প্রতিটি বাড়ির কাছে কোষা ও ডিঙ্গি নৌকার বহর দাঁড়িয়ে থাকা। এসব ছোট্ট কোষা ও ডিঙ্গি নৌকা বাড়ির লোকজন পারাপার এবং ছেলেমেয়েদের স্কুলে যাতায়াতের জন্য ব্যবহৃত হয়।
আড়িয়াল বিলের ভিতর বসতি।
মাছ ধরার ভেসাল
আড়িয়াল বিলে নানা প্রজাতির মাছ পাওয়া যায় বর্ষায়। স্থানীয় জেলেরা রাতে ও দিনের বেলায় ছোটবড় নৌকা নিয়ে মাছ ধরে। তাদের বিশেষ পদ্ধতিতে মাছ ধরার দৃশ্যও মনোরম। আড়িয়াল বিলে পৌঁছার পর এর সৌন্দর্য দেখতে দেখতে চোখে পড়বে বিশাল বিশাল মাছ ধরার ভেসাল। যেন সে ভেসালগুলো আড়িয়াল বিলে স্বাগত জানাচ্ছে আপনাকে। স্বাগত জানাবে পানিতে আবক্ষ ডুবে থাকা কিছু হিজল গাছও।
আড়িয়াল বিলে মৎস্যজীবীদের ভেসাইল দিয়ে মাছ ধরার দৃশ্য।
বিলের মাঝখানে গিয়ে চারপাশটায় একবার চোখ বুলালে দেখবেন শুধু সবুজ আর সবুজ আর স্বচ্ছ নীল জলের ওপর ছোট ছোট ঢেউয়ের খেলা। এমন বিশালতা দেখে আপনার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করবে- এটা বিল না হাওড়। এত্ত বিশালতা যার, সে হাওড় না হয়ে পারে না। এই বিলের স্বচ্ছ জল কোথাও গভীর কোথাও অগভীর। কোথাও কোথাও পানির নিচে মাটি বা বৈচিত্র্যময় জলজ উদ্ভিদসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ স্পষ্ট দেখা যাবে। জলজ উদ্ভিদের মধ্যে কচুরিপানা আর কলমিই বেশি চোখে পড়বে। কোথাও কোথাও পাবেন কাশফুলও।
ডেঙ্গা বা দীঘি
আড়িয়াল বিলের অন্যতম আকর্ষণ হলো স্থানীয় নাম ডেঙ্গা বা দীঘি।আড়িয়ল বিলে ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রায় ৫০০ ডেঙ্গা বা দীঘি রয়েছে। এসব দীঘি পাড়সহ বর্ষাকালে ডুবে বিলের পানির সঙ্গে একাকার হয়ে যায়। নৌকা বা ট্রলারে মাঝিকে বললে তারাই আপনাকে ঘুরিয়ে দেখাবে কোথায় কোথায় এসব ডেঙ্গা বা দীঘি আছে। এসব ডেঙ্গার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সাগরদীঘি, মাধবিদীঘি। মাধবিদীঘির পাড়ে রয়ে মেহগনির বন। নীরবতা চারদিকে। মেহগনির বনে দাঁড়িয়ে যতটা চোখ যায় আড়িয়ল বিলটাকে দেখুন। এরপর দেখুন মাধবিদীঘি।
বর্ষায় ডেঙ্গাতে বেড়ানো বা প্রবেশ নিষেধ। টলারে করে যেতে যেতে কোথাও চোখে পড়বে কচুরিপানা সংগ্রাহকের। এসব কচুরিপানা বাঁশ দিয়ে ঘিরে রাখা হবে পুরো ডেঙ্গায়। যাতে বিলের পানি নেমে গেলেও ডেঙ্গা বা দীঘিতে মাছ থেকে যায়। ডেঙ্গায় দেখা পাবেন ঝাঁকে ঝাঁকে সাদা বকেরও।
বিলে নানা জাতের মাছের সঙ্গে রয়েছে কচুরি আর শাপলাফুল। বিলের পানিতে সকাল-সন্ধ্যা চলে রঙিন ফড়িংয়ের বিরতিহীন ওড়াউড়ি। বৃষ্টিহীন উষ্ণ দিনে বিলের ফুলের পাশে আসে একদল পতঙ্গও।
আড়িয়াল বিলে উৎপাদিত ফসল
শীতের শেষের দিকে আড়িয়াল বিলে কৃষকদের মূল ব্যস্ততা থাকে মিষ্টিকুমড়া নিয়ে। আড়িয়ার বিলের কোনো কোনো মিষ্টিকুমড়া দুই মণেরও বেশি ওজনের হয়ে থাকে। ছবি : সংগৃহীত
বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীর খাদ্যের জোগান আসে এ বিল থেকে। প্রাকৃতিকভাবেই এ বিল বিশাল মৎস্য সম্পদের ভাণ্ডার। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ৭৯৭০ হেক্টর আবাদযোগ্য ভূমি রয়েছে আড়িয়ল বিলে। এখানে উৎপাদিত প্রধান খাদ্যশস্য ধান। আরো জন্মে কুমড়া, করলা, খিরাই, টমেটো, শসা, বেগুন, কাঁচামরিচ ইত্যাদি। বছরের সব ঋতুতেই এখানে ফলন হয়। শীত শেষে বসন্তে এই আড়িয়ল বিলে শাক-সবজির চাষাবাদ এবং নিয়মিতভাবে চাল কুমড়ার চাষও হয়। কোথাও কোথাও সবুজ ধান ক্ষেতের ফাঁকে ফাঁকে শত শত ভিটা (উঁচু) জমিতে কুমড়া ছাড়াও আবাদ করা হয় করলা, লাউ, শসা, খিরাই, পেপে. বেগুন, হেচি শাক, ক্ষুদুইরা শাকসহ নানা ফসল।
শুষ্ক মৌসুমে আড়িয়াল বিলের চিত্র। ছবি : সংগৃহীত
শ্যামসিদ্ধির মঠ
আড়িয়াল বিলে প্রবেশ বা ফেরার পথে দেখে নিতে পারেন শ্যামসিদ্ধির মঠ। শ্রীনগর বাজারের পশ্চিম দিকে শ্যামসিদ্ধি গ্রামে অবস্থিত প্রাচীন এ মঠের দক্ষিণ দিকের প্রবেশপথের ওপরে বাংলা শিলালিপির লেখা অনুযায়ী ১৮৩৬ সালে বিক্রমপুরের ধনাঢ্য ব্যক্তি শম্ভুনাথ মজুমদার এটি নির্মাণ করেন।
শ্যামসিদ্ধির মঠ। ছবি : সংগৃহীত
জনশ্রুতি আছে সম্ভুনাথ স্বপ্নে তার স্বর্গীয় পিতার চিতার উপরে মঠ নির্মাণের নির্দেশ পেয়ে মঠটি নির্মাণ করেন। প্রায় ২৪১ ফুট উঁচু এ মঠ দিল্লির কুতুব মিনারের চেয়েও পাঁচ ফুট উঁচু। তাই বলা যেতে পারে এটা ভারত উপমহাদেশের সর্বোচ্চ মঠ।
অষ্টভুজ আকৃতির এ মঠ দৈর্ঘ্যে ও প্রস্থে ২১ ফুট। চুন-সুরকি দিয়ে তৈরি মঠের দেয়াল বেশ পুরু। মঠের উপরের দিকে বাইরের দেয়ালজুড়ে আছে শত শত খোড়ল। এগুলোতে বাসা বেঁধেছে শত শত সবুজ টিয়া, ঝুটি শালিক। তাই মঠটি সবসময় বিশেষ করে সকালে ও বিকেলে পাখির কলকাকলিতে মুখর থাকে।
শ্যামসিদ্ধির মঠের খুড়লে বসা টিয়া ও শালিক পাখি। ছবি : সংগৃহীত
যেভাবে যেতে পারেন
আড়িয়াল বিলে বেড়ানোর উত্তম সময় বর্ষাকাল। বর্ষায় আড়িয়াল বিল বেড়াতে হলে যেতে হবে শ্রীনগর বাজারে। শ্রীনগর বাজারের পুরাতন লঞ্চঘাট হলো ট্রলার বা নৌকা নিয়ে আড়িয়াল বিলে প্রবেশের উত্তম স্থান। আড়িয়াল বিল ভ্রমণ করতে দলবেঁধে রাজধানী ঢাকার গুলিস্তান থেকে মাওয়া, লৌহজং কিংবা দোহার-জয়পাড়ার যেকোনো বাসে চড়ে বসুন। (মিরপুর ১২, গাবতলী, টঙ্গী থেকেও পাবেন মাওয়াগামী বিভিন্ন পরিবহনের বাস।) ভাড়া নেবে ৫০- ৯০ টাকা। নেমে যান শ্রীনগরের ছনবাড়ি বা বেজগাঁও স্টেশনে। সেখান থেকে শ্রীনগর বাজারে চলে যান ১৫-২০ টাকা রিকশা ভাড়ায়।
শ্রীনগর বাজারের পুরাতন লঞ্চঘাটেই পাবেন প্রয়োজনীয় ট্রলার বা নৌকা। দলবেঁধে গেলে একজন আগে গিয়ে সব ঠিকঠাক করে আসতে পারেন।
আড়িয়াল বিল ভ্রমণকারীদের জন্যই এই চটপটির দোকান। ছবি : সংগৃহীত
আবার নিমতলায় নেমে বারৈখালি, বা হাঁসাড়া স্টেশনে নেমে হাঁসাড়া বাজার কিংবা দোহার-জয়পাড়ার বাসে গিয়ে শ্রীনগরের বালাসুর বাজারেও নামতে পারেন। এসব স্থান থেকে আড়িয়াল বিলে প্রবেশ করতে পারবেন। ছয় ঘণ্টার জন্য ট্রলার ভাড়া নেবে ৭০০ থেকে ১০০০ টাকা। আর সরাদিনের জন্য দুই হাজার থেকে দুই হাজার ৫০০ টাকা।
প্রয়োজনীয়তা
বর্ষাকালে কখনো রোদ কখনো বৃষ্টি তাই আড়িয়াল বিল ভ্রমণের সময় অবশ্যই ছাতা, রোদ টুপি ও রেই্নকোর্ট সঙ্গে নেবেন। বিলের ভেতর কোথাও দোকানপাট নেই। তাই সঙ্গে অবশ্যই পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ খাবার পানি ও শুকনা খাবার নিতে ভুলবেন না। অপচনশীল বর্জ্য যেমন পলিথিন ও প্লাস্টিকের বোতল বিলে ফেলে পরিবেশ ধ্বংসের অংশীদার হবেন না।