স্মৃতিতে অমলিন ইন্দোনেশিয়ার ইবু

Looks like you've blocked notifications!

দুবার ট্রানজিট নেওয়ার পর লায়ন এয়ারের ডমেস্টিক ফ্লাইটটি যখন পাদাং এয়ারপোর্টের কংক্রিটের মসৃণভূমি স্পর্শ করে তখন স্থানীয় সময় বেলা আড়াইটা। পোর্ট এন্ট্রি ভিসাসহ ইমিগ্রেশনের যাবতীয় কাজ সম্পন্ন হয়েছে জাকার্তা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরেই। ফলে পাদাং এয়ারপোর্ট থেকে লাগেজ নিয়ে বেরিয়ে আসতে সময় লাগলো মাত্র কয়েক মিনিট। এ এয়ারপোর্টটি আভ্যন্তরিন রুটের জন্য নির্ধারিত হলেও এর জৌলুস, আভিজাত্য আর কারুকার্যময়তা চোখে পড়ার মতোই। ইন্দোনেশিয়া দ্বীপ দেশ হওয়ায় হাজার হাজার মাইল দূরের যাত্রীদের দ্রুত ও নিরাপদ ভ্রমণ আকাশ পথেই। ফলে ডমেস্টিক এয়ারপোর্টগুলোও বেশ জমজমাট থাকে হরহামেশাই।

বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে চারদিকটায় একটু চোখ বুলিয়ে নিলাম। বিমানবন্দরের সামনের দৃশ্যটা বেশ মনরোম ও মনমুগ্ধকর। প্রাকৃতিক পরিবেশের আবহে গড়ে উঠেছে চারদিকটা। বেশ ভালোই লাগছে। অদূরেই একটি পাহাড়। খুব বেশি উঁচু নয়। সবুজের ভেতরে পাহাড়ের চূড়ার দৃশ্যটি কিঞ্চিৎ কৃষ্ণকায়। মাঝেমাঝে সাদা মেঘের ভেলা ভেসে বেড়াচ্ছে। দৃশ্যটি এক অর্থে যেন শিল্পির তুলিতে আঁকা অপরূপ এক মায়াবী হরিণীর ছবি। পারস্য কবি হাফিজ কিংবা আরব কবি ইমরুল কায়েসের অনবদ্য প্রেমের কবিতায় তাঁরা তাঁদের প্রেয়সীর রূপের যে বর্ণনা দিয়েছেন পাহাড়ের রূপটিও তেমনি বলেই মনে হলো। বলা যায় প্রথম দর্শনেই গভীর প্রেম হলো ইন্দোনেশিয়ার অপরূপ- রূপমাধুরির সঙ্গে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই জাপান প্রবাসী বন্ধু-সহকর্মী লুৎফর রহমান সরকার শিপার ও বরকত ভাই ল্যান্ডক্রুজার প্রাডো নিয়ে হাজির হলেন। বিনামবন্দর থেকে আমাদের নিয়ে শতমাইল বেগে চলছে গাড়িটি। কিছুক্ষণের মধ্যেই পাদাং সিটিতে হাজির হলাম আমরা।

সাগরের কোলঘেষে আধুনিক নগরজীবনের সব সুযোগ-সুবিধা নিয়েই গড়ে উঠেছে পাদাং সিটি। বিশাল ঢেউ আচড়ে পড়ছে শহরের পাদদেশে। পশ্চিমাকাশে তখন সূর্য লাল রং ধারণ করেছে। সূর্যের লাল বিকিরণে ঢেউগুলো এক ভিন্ন ধরনের সৌন্দর্য লাভ করছে। পর্যটকদের জন্য বিকেলের এ সৌন্দর্য উপভোগ করার যাবতীয় ব্যবস্থা করতে নগরকর্তার চেষ্টার কমতি নেই। মানুষ যাতে নিরাপদে ঢেউয়ের গর্জন আর প্রকৃতির রূপসৌন্দর্য উপভেগ করতে পারেন সেই ব্যবস্থা অকৃপণভাবে করা হয়েছে। গাড়ি যতই এগুচ্ছে মন ততটাই উদ্বেলিত হয়ে উঠছে। আহ! কিছুক্ষণের জন্য যদি এখানে একটু বসতে পারতাম। এ দিন আর এ সুযোগ জীবনে আর আসবে কি না, জানি না। প্রস্তাব করতেই সবাই একবাক্যে রাজি হয়ে গেলেন। চালক নাসির গাড়ি থামালেন। নেমে বুক ভরে বাতাস নিলাম। এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা চেয়ারগুলোতে বসে পড়লাম সবাই।

কিছুক্ষণের জন্য বিদ্রোহী কবি, প্রেমের কবি ও আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘পদ্মার ঢেউ রে, তোর শূন্য হৃদয় নিয়ে যা’ ঐতিহাসিক গানটির পঙতিগুলো আনমনেই ঠোট গলিয়ে বের হতে লাগল।

নানা ধরনের খাওয়া-দাওয়া আর গল্পগুজবে কখন যে সন্ধ্যা নেমে আসল মনেই নেই। ততক্ষণে সূর্য ডুবে পূব আকাশে চাঁদ উঠছে। রাতে ঢেউয়ের গর্জন আরো জোরালো হয়। ঢেউগুলোও রং বদলায়। কবি নজরুলের সেই ঐতিহাসিক গানেরই পরের অন্তরা -------

‘ঢেউয়ে তোর ঢেউ ওঠায় যেমন চাঁদের আলো

 মোর বধূয়ার রূপ তেমনি ঝিল্‌মিল করে কৃষ্ণ–কালো’। খুব বেশি করে মনে পড়ল। পুরো গানটি গাওয়ারও চেষ্টা করলাম।

স্মৃতিময় এ মুহূর্ত রেখে উঠতে মন সায় দিচ্ছিল না। কিন্তু উঠতেই হবে। আমাদের এ শহর ছেড়ে যেতে হবে আরো আড়াইশ কিলোমিটার দূরের লাকিতান এলাকায়। স্মৃতির আল্পনায় ছবি এঁকে সবাই উঠে পড়লাম গাড়িতে। গাড়ি চলছে। অঝোর ধারায় বৃষ্টি নামছে। অভিজ্ঞ চালক নাসির বেশ সতর্কতার সঙ্গেই গাড়ি চালাচ্ছেন। নিরাপদ যাত্রার জন্য মহান আল্লাহর নাম স্মরণ করে দোয়া পড়লাম কয়েকবার।

রাত প্রায় আড়াইটা। শিপার ভাই বললেন- বেশ তো ঘুমালেন। এবার উঠেন। আর কয়েক মিনিটের মধ্যেই আমরা আমার বাড়িতে পৌঁছে যাব। এটিই হচ্ছে আমাদের গন্তব্যস্থল। এখানেই আমরা থাকব কয়েকদিন।

গাড়িটি থামল বিশাল এক গেটের সামনে। গাড়িটি হরণ দিতেই এক মুহূর্তও অপেক্ষা করতে হয়নি। গেটটি খুলে গেল। ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন মিসেস খুজাইমা ইমা।  তাঁর চেহারা দেখেই অনুমান হলো- তিনি ঘুমাননি। আগন্তুকদের জন্য তিনি সন্ধ্যা থেকেই অপেক্ষা করছিলেন। আমাদের যাতে একটুও কষ্ট না হয় এ জন্য আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলেন তিনি। আমাদের পেয়ে তিনি বড় ধরনের দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত হয়েছেন। আমরা না পৌঁছা পর্যন্ত বড় টেনশনেই ছিলেন তিনি।

গাড়ি থেকে নামার পর পরই পৃথকভাবে স্থানীয় রীতি ও রেওয়াজ অনুযায়ী আমাদের সবাইকে অভিবাদন জানালেন মিসেস খুজাইমা। ভেতরে নিয়ে যার যার কক্ষগুলো দেখিয়ে দিয়ে হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেস হতে হুকুম দিলেন। ফ্রেস হয়ে খাবার টেবিলে গিয়ে অবাক না হয়ে উপায় ছিলে না। আমাদের উপযোগী ও পছন্দের অনেক ধরনের খাবার টেবিলে সাজানো। পরম মমতায় মাতৃস্নেহে খাবারগুলো পাতে তুলে দিচ্ছেন তিনি। প্রচণ্ড ক্ষুধা থাকায় লাজলজ্জা না রেখে খেয়ে চলছি। তিনিও খাওয়াতে পেরে বেশ তৃপ্ত বলেই মনে হচ্ছে। তাঁর চোখেমুখে বিরক্তির একটু লেশমাত্রও নেই। এতটা সময় আমরা তাঁকে অনিদ্রায় ও দুশ্চিন্তায় রেখেছি। এ জন্য বেশ লজ্জিত হচ্ছিলাম। কোনো ধরনের বিপদ ছাড়াই আমরা নিরাপদে তাঁর আথিতিয়েতায় আসতে পেরেছি এ জন্য তিনি বারবার সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ দিচ্ছেন।

খাবার পর ক্লান্ত শরীর নিয়ে বিচানায় যেতেই গভীর ঘুম। ঘুম থেকে উঠে দেখি সকাল ৯টা। বিছানা ছেড়ে একটু বেরোতেই অনেকটা স্বপ্নের মতোই মনে হলো। ঠিক যেন স্বপ্নের মায়াজালে বন্দি। বিশাল এক বাগান বাড়িতে আমরা। আমাদের জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক ও কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমদের গাজীপুরের নুহাশ পল্লীর আদলেই গড়ে ওঠা এ বাড়িটি। কি নেই এর ভেতরে? নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করলাম। না, এখানে সবই আছে। যা দেখেছি নুহাশ পল্লীতে। বরং এখানে একটা অতিরিক্ত বিষয় আছে সেটা হলো – বেডরুমের পাশে একটি বড়সড় চৌবাচ্চা। ছোট্ট একটি টিলার মতো জায়াগা থেকে গড়িয়ে পানি পড়ছে। অন্য একটি নালা দিয়ে বাইরে চলে যাচ্ছে পানি। চৌবাচ্চায় হরেক প্রজাতির রংবেরংয়ের মাছেরা খেলা করছে।

গোসল সেরে নামাজ পড়ে গেলাম নাস্তার টেবিলে। অনেকটা বাগানের ভেতরেই নাস্তার টেবিল। এখানেও সেই মিসেস খুজাইমা। টেবিলভরা নানান কিসিমের নাস্তা আর দেশীয় ফলফলাদি। খেলামও উদোরভর্তি করে। কোত্থেকে যে এত ক্ষুধা জমা হয়েছে। তিনি খাওয়াচ্ছেন আর স্থানীয় ভাষায় কথা বলে চলেছেন। দোভাষীর কাজটি করছেন শিপার ভাই। তিনি ইন্দোনেশিয়ান ভাষায় তেমন পারদর্শী বলে মনে হলো না। যদিও গোটা বাগান বাড়িটাসহ এসব কিছুর পেছনের মুলে হলেন শিপার ভাই। তার অক্লান্ত পরিশ্রম আর শতসাধনার ফল এ বাগান বাড়িটা। শেষে দোভাষীর কাজটিতে যুক্ত হলেন নাসির ভাই। নাসির দীর্ঘদিন ধরে ইন্দোনেশিয়াতেই স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। বাংলাদেশের নাগরিক হলেও তিনি এখন ইন্দোনেশিয়ানই বলা চলে। বিয়ে করে ঘর গাটছাড়া বাঁধছেন এ দেশে।

নাস্তা খেতে খেতেই চলছে জম্পেস আড্ডা। অনেকদিন এভাবে প্রাণখুলে আড্ডা হয়নি। আড্ডার মধ্যমনি মিসেস খুজাইমা। তিনিই আমাদের সবার ইবু। ইবুই জমিয়ে তুলছেন আড্ডা। ভাষা ও সংস্কৃতির ভিন্নতা থাকলেও তিনি কী বলতে চাইছেন আর কী বুঝাতে চাইছেন, তা বুঝতে আমাদের বিন্দুমাত্র বেগ পেতে হয়নি। মনে হচ্ছে তাঁর অব্যক্ত কথাগুলো আমাদের জন্যই জমা করে রেখেছিলেন এত দিন। নাস্তা শেষে পুরো বাগান বাড়িটার পরতে পরতে তিনি ঘুরে ঘুরে দেখালেন। দেখছি আর মনের প্রশান্তিতে প্রকৃত স্বর্গীয় সুখানুভূতিতে অবগাহন করছি। বাড়িটির প্রতিটি ইট, পাথর আর গাছ-গাছালিতে নান্দনিকতার ছোঁয়া বিরাজমান।

নাস্তাপর্ব শেষ করে আমরা সেই গাড়িতে করে বেরিয়ে পড়লাম প্রকৃতির স্বরূপ সন্ধানে। প্রসস্ত আর মসৃণ সড়ক ধরে গাড়ি এগিয়ে চলেছে। একপাশে সাগর-নদীর নীলাভ জলতরঙ্গ। অন্যপাশে পাহাড়ের গাছগাছালি। যতই সামনে এগুচ্ছি মন ততই উদাসী বাউলের ন্যায় নেচে উঠছে। পথেপথে নেমেছি। সারাদিন এভাবেই কেটে গেছে টেরই পাইনি। দীর্ঘ ভ্রমণের ক্লান্তিতে শরীর একটুও অবসাদ হয়নি। বরং সজীবতায় দেহ-মন উজ্জীবিত হচ্ছে।

রাতে বাসায় ফিরে দেখি সেই করম আয়োজন করে অপেক্ষায় আছেন আমাদের ইবু। পুরো বাড়ি মাতিয়ে তুলছেন ইবু আর শিপার ভাইয়ের আত্মীয়স্বজনরা। মিসেস খুজাইমার স্বামী জয়নাল আরেফিন সাহেবও আমাদের আড্ডায় প্রাণ জোগাচ্ছেন। অত্যন্ত পরিপাটি ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন সুপুরুষ তিনি। কথা বলেন বেশ ধীরে ও মেপেমেপে। নানা ধরনের খাওয়া-দাওয়া আর গল্প চলল অনেক রাত পর্যন্ত। পরের দিনের কর্মসূচি ঠিক করে যথারীতি ঘুমিয়ে পড়লাম সবাই। কর্মসূচি মানেই ঘোরাঘুরি আর ছবি তোলা।

সূর্য উঠার আগেই ঘুম থেকে উঠে দিনের কাজ শুরু করার অভ্যাস আমার ছোট বেলার। দীর্ঘপথের ক্লান্তি আর গভীর রাতে ঘুমোতে যাওয়ার কারণে আগেরদিন এটা হয়নি। আজ আর এটা করা যাবে না। মহান আল্লাহর দরবারে এ প্রতিজ্ঞা করেই ঘুমোতে বিছানায় গেলাম। ভোরে উঠলাম। বাড়িতে পিনপতন নীরবতা। ভাবলাম সবাই হয়তো ঘুমোচ্ছেন। ফজরের নামাজ পড়ে এদিক সেদিক কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরি করে আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। সকাল সাড়ে ৮টার দিকে শিপার ভাইকে জাগালেন আমাদের ইবুর (মিসে খুজাইমা) কাজের ছেলে নাল্ডি। ‌মি. নাল্ডিকে ইবুর সহকারীও বলা যায়।

শিপার ভাইকে নাল্ডি যা বলল, তার অর্থ হলো- কিচেনে নাস্তার আয়োজন করা আছে। তুমি মেহমানদের নিয়ে ওভেনে গরম করে খেয়ে নাও। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মেহমানদের জন্য ভালো নাস্তার আয়োজন করা সম্ভব হয়নি। তুমি মেহমানদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করে নেবে। জয়নাল আরেফিন সাহেবকে নিয়ে হাসপাতালে আছেন ইবু।

নাল্ডির এ কথায় রীতিমতো সবাই হতবাক। অনেকটা কিংকর্তৃব্যবিমূঢ়ও বটে। শিপার ভাই ফোন করলেন ইবুকে। কিছুক্ষণ কথা বলে ফোন রেখে দিয়ে গভীর চিন্তায় পড়ে গেলেন তিনি। জানতে চাইলে বললেন, রাত সাড়ে ৩টার দিকে আমার শ্বশুর (জয়নাল আরেফিন সাহেব) গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে দ্রুত স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করা হয়েছে। তিনি এখন সেখানেই চিকিৎসাধীন।

গভীর রাতে এতবড় একটা ঘটনা ঘটে গেল। অথচ আমরা মোটেও টের পেলাম না। নিজেদের অপরাধীই মনে হলো। শিপার ভাইকে বললাম- ইবু তো আমাদের জাগাতে পারতেন। আমরা কিছুটা হলেও তাঁকে সাহায্য করতে পারতাম। জবাবে শিপার ভাই বললেন- আমাদের কষ্ট হবে হয়তো এ কারণে আমাদের জানানো হয়নি। তা ছাড়া আমরা তো আর তেমন কিছু তাদের জন্য করতে পারবও না।

আমরা দ্রুত সবাই মিলে চলে গেলাম আনুমানিক তিন কিলোমিটার দূরে স্থানীয় হাসপাতালে। ইবু ও অন্য আত্মীয়স্বজনরা বেশ চিন্তিত। চিকিৎসক ভালো কোনো আশা দিতে পারছেন না। আরেফিন সাহেবের এখনো জ্ঞান ফিরে আসেনি। এর মধ্যেই ইবু কম করে হলেও আমাদের কাছে তিনবার দুঃখ প্রকাশ করে নিলেন। আমাদের ঠিক মতো আতিথেয়তা করতে পারেননি। এ জন্য তিনি ভীষণ লজ্জিত। আমরা অনেক দূরের দেশ থেকে তাঁদের কাছে বেড়াতে গিয়েছি। অথচ আমাদের জন্য তিনি তেমন কিছু করতে পারছেন না। এ কথাটা তিনি বারকয়েক বললেন। আমরা যে যার মতো করে তাঁকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছি এবং আরেফিন সাহেবের চিকিৎসা ও সেবাকাজে পূর্ণ মনযোগ দেওয়ার অনুরোধ করছি।

শিপার ভাই প্রধান চিকিৎসকের সঙ্গে জয়নাল সাহেবের চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যের অগ্রগতি নিয়ে কথা বললেন। চিকিৎসকের বক্তব্য হলো এখানে তাঁর যথোপযোক্ত চিকিৎসা সম্ভব নয়। তাঁকে জেলা সদরের উন্নত হাসপাতালে এখনই নিয়ে যেতে হবে। তিনি সেখানে রেফারও করে দিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁকে নিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশে রওনা হলাম সবাই।

ইন্দোনেশিয়াকে বলা হয় হাজার দ্বীপের দেশ। এটা না দেখলে উপলব্ধি করা যাবে না। যেদিকেই তাকাই শুধু বিশাল জলরাশি আর ছোট বড় শত শত দ্বীপ। একেকটি দ্বীপ যেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর রূপের ঝাঁপি খুলে বসেছে। মনজুড়ানো এসব দ্বীপকে কেন্দ্র করে সরকারি ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় গড়ে উঠেছে পর্যটনশিল্প। এমনই একটি ছোট দ্বীপ পরিদর্শন করার কথা ছিল আমাদের। যেদিন জয়নাল আরেফিন সাহেব অসুস্থ হয়ে পড়েন, ওই দিনই আমাদের ওই দ্বীপটি ঘুরে দেখার কথা ছিল। আমাদের জন্য স্পিডবোড ও গাইডের ব্যবস্থাও আগে থেকেই করে রেখেছিলেন ইবু। জয়নাল সাহেব অসুস্থ হয়ে পড়ায় আমাদের এ পরিকল্পনায় কিছুটা ছন্দপতন হলো।

আমরা হাসপাতালে বারবার রোগীর খোঁজ নিচ্ছি। এমন সময় ইবু শিপার ভাইকে আমাদের নিয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে আসার জন্য বেশ কয়েকবার বললেন। শেষ পর্যন্ত আমরা দুপুরের খাবার খেয়ে আসলাম। ততক্ষণে রোগীর শরীরের অবস্থা বেশ উন্নতির দিকেই বলে চিকিৎসরা জানালেন। সবাই মহান আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করলাম। এরই মধ্যে ইবু দ্বীপ পরিদর্শনের আগের আয়োজন আবার সক্রিয় করে তুললেন। তাঁর অনুপ্রেরণায় আর সহযোগিতায় আমরা বোটে করে দ্বীপ দেখতে রওনা হলাম। দ্বীপের অর্ধেক পথ যেতেই উত্তাল ঢেউ আর বিশাল জলরাশির শোঁ শোঁ আওয়াজ আমাদের যাত্রাপথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আমার মানসিক দুর্বলতার কারণেই শেষ পর্যন্ত মাঝপথ থেকে বোট ঘুরিয়ে দিতে বাধ্য হন চালক। আমরা আগের জায়গায়। এ কথাটি মনে হলে এখনো ভীষণ লজ্জা পাই।

একজন মা চাইলে একটি পরিবার ও একটি সমাজের পরিবর্তনের জন্য যথেষ্ট। ইবুই হচ্ছেন তার উজ্জ্বল প্রমাণ। ইন্দোনেশিয়ায় কয়েকটি জনপদ ঘুরেও এর আর্থসামাজিক অবস্থা এবং সামাজিক ও পারিবারিক অবকাঠামো দেখে আমার কাছে সেটাই মনে হলো। ছোট সময় একটি প্রবাদ পড়েছিলাম- কোনো এক বিশ্ব নেতা বলেছিলেন, ‘তোমরা আমাকে একজন কর্মঠ ও সুশিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের একটি উন্নত বিশ্ব উপহার দেব।’ এ প্রবাদের মায়ের সঙ্গে আমি হুবহু মিল খুঁজে পেলাম ইন্দোনেশিয়ার ইবুর।

ধন্যবাদ ইবু। শত অভিবাদন মা তোমাকে।

পুনশ্চ : মাকে ইন্দোনেশিয়ান ভাষায় বলা হয় ইবু।