গ্রিস ভ্রমণ

পাথরের ভাঁজে শহরের ইতিহাস

Looks like you've blocked notifications!

কৈশোর থেকে তারুণ্যে প্রবেশের পর থেকে, যখন একটু একটু করে পৃথিবীর ইতিহাসের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছি , পুরাণের কাহিনীগুলো যখন মনে বিভিন্ন প্রশ্নের উদ্রেক করছে, তখন থেকেই মনে লালন করতাম গ্রিস ভ্রমণের কথা। শুধু সাধ থাকলেই হবে না, সাধ্যও থাকা চাই, সেই কল্পকাহিনীর লীলাভূমিতে পা রাখবার জন্য । অবশেষে সাধ আর সাধ্যের মিলন ঘটল এ বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর ।

গ্রিসের রাজধানী শহর এথেন্স দিয়ে শুরু করলাম আমার বহু প্রতীক্ষিত গ্রিস ভ্রমণ। এথেন্স গ্রিসের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শহর সেই প্রাগৌতিহাসিক কাল থেকে । আর এথেন্সের মূল আকর্ষণগুলোর মধ্যে প্রাচীনতম শহর অ্যাক্রোপোলিস অন্যতম ।

পুরো গ্রিসেই ছড়িয়ে আছে এ রকম অনেক অ্যাক্রোপোলিস। সরেজমিনে গিয়ে দেখবার আনন্দ তো আছেই, কিন্তু আমার কাছে তা ছিল একটি মানসিক অভিজ্ঞতা। সেখানে স্বশরীরে উপস্থিত হয়েও আমার কাছে মনে হচ্ছিল, আমি যেন সেখানে নেই। সেখানকার প্রতিটি ছোট বড় পাথর, ইমারতের অবয়ব, যা কিছু লিখিত আছে তার থেকে বেশি কিছু বলতে চায়। কতই  অজানা, অদেখা ইতিহাস লুকিয়ে আছে, যার সঠিক ব্যাখ্যা  ইতিহাসবিদরাও দাঁড়  করাতে পারেননি ।

অ্যাক্রোপোলিসের উপর থেকে এথেন্স শহর। ছবি : লেখক

অ্যাক্রোপোলিস আসলে কী

শাব্দিক অর্থে যদি যাই অ্যাক্রো শব্দের অর্থ উঁচু আর পোলিশ অর্থ  শহর। অর্থাৎ উঁচু জায়গায় নির্মিত শহরকে বলা হয় অ্যাক্রোপোলিস ।

ঠিক তেমনই একটি চুন-পাথরের পাহাড়ের উপর নির্মিত এথেন্স তথা গ্রিসের প্রাচীনতম শহরকে বলা হয় অ্যাক্রোপোলিস। যেখানে রয়েছে ধর্মীয় উপাসনালয়, নগরদূর্গসহ তৎকালীন রাজার বাসস্থান। একে প্রাচীন গ্রিসের দেব-দেবতার বাসস্থান বললেও অত্যুক্তি হবে না। এখানকার মূল উপাসনালয়টি দেবী এথেনাকে উৎসর্গ করে বানানো হয়। এ ছাড়া রয়েছে অনেক ছোট ছোট উপাসনালয়ের ধ্বংসাবশেষ।

প্রাচীন গ্রিক ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসারে এথেনা হচ্ছে শিক্ষা, সংস্কৃতি, বীরত্ব, শক্তি, যুদ্ধ, জ্ঞান ও শহরের দেবী। কথিত আছে দেবতা জিউসের মাথা থেকে এথেনার জন্ম এবং জন্মের সময়ই  এথেনা ছিলেন যুদ্ধবর্ম পরিহিতা  প্রাপ্তবয়স্ক তরুণী। তার কোনো মা নেই। জিউসের সবচেয়ে প্রিয় সন্তান এথেনা। হোমার ‘ইলিয়ডে’ এথেনাকে দেখিয়েছেন একজন বীরযোদ্ধা হিসেবে।

অ্যাক্রোপোলিসের উচ্চতা সমুদ্র সমতল থেকে প্রায় ৬০০ ফুট এবং আয়তন ৩০ হাজার ৫০০ বর্গমিটার। এখানে মনুষ্য প্রজাতির উপস্থিতি পাওয়া যায় খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০ বছর আগে। তবে প্রত্নতত্ত্ববিদরা এই পাহাড়ের অবস্থান সম্পর্কে যা বলেছেন তা হলো, এই পাহাড় ক্রিট্যাশিয়াস যুগের, যখন ডাইনোসার পৃথিবীতে বিচরণ করছে। ইতিহাসবিদরা মনে করেন শুধু দেবী এথেনাকে উৎসর্গ করেই যে এখানে মন্দির নির্মাণ করা হয়েছে তা নয়। এই শহর নির্মাণের আরো একটি কারণ হরো এথেন্স শহরকে বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করা। কারণ যে উচ্চতায় অ্যাক্রোপোলিসের অবস্থান, সেখান থেকে চারদিকের নজরদারি খুব ভালোভাবে করা যায়।

অ্যাক্রোপোলিসের নির্মাণ কাজ শুরু হয় খ্রিস্টপূর্ব ৪৪৭ অব্দে। এটির নির্মাণ এবং ধর্মীয় উপাসনালয় হিসেবে ব্যবহার শুরু হয় তখন, যখন গ্রিক সভ্যতা, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি তাদের সোনালী সময় পার করছিল। সেখানে ছোট-বড় অনেক মন্দির স্থাপন করা হয়, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো পার্থেনন, যেটি দেবী এথেনাকে উৎসর্গ করে বানানো।

অ্যাক্রোপোলিসের প্রবেশ দ্বারকে বলা হয় প্রপালায়া এবং  প্রপালায়া দিয়ে ঢুকবার সাথে সাথেই দূর থেকেই পার্থেনন দৃষ্টি গোচর হয়। অ্যাক্রোপোলিসে এখন যে কয়েকটি ইমারত ও মন্দিরের অবয়ব পাওয়া যায় সেগুলো হলো – পার্থেনন, প্রবেশ দ্বার প্রপালায়া, এরিকথিওন, পোর্চ অব মেইডান্স,  থিয়েটার অব ডাইনোসাস ও বেল্ভিদেয়ার টাওয়ার ।

পার্থেননের সামনে। ছবি : লেখক

পার্থেনন

পার্থেনন নিয়ে গবেষণা এখনো চলছে। গবেষকদের ধারণা এই মন্দির বানাতে ২২ হাজার টন মার্বেল পাথর ব্যবহার করা হয়েছে। বিশাল দৈত্য আকৃতির ৫৮টি পিলারগুলোতে ব্যবহার করা হয়েছে ১৩ হাজার মার্বেলের টুকরো, ভূমিকম্পেও যেগুলোর নড়চড় হবে না। মন্দিরের পিলারের উপরের কারুকাজ করা এক একটি মার্বেলের ওজন ১০ টন। কিন্তু পার্থেননের কোনো মার্বেলই এথেন্সের না। ইতিহাসবিদ এডিথ হ্যল গবেষণা করছেন অ্যাক্রোপোলিসে  ব্যবহৃত মার্বেল নিয়ে। তার মতে এথেন্স থেকে ১৭ কিলোমিটার দূরে ‘মাউন্ট পেন্তেলিকন’ থেকে মার্বেল বয়ে  এনে বানানো হয়েছে পার্থেনন মন্দির ।

পার্থেনন একটি ডরিক টেম্পল খুব সহজেই তা বোঝা যায়। কারণ ডরিক টেম্পলের থাকে বিশাল আকৃতির পিলার। 

পুনর্নির্মাণের সময় এর  স্থাপত্ত্যশৈলী আশ্চর্য করে দেয় দুনিয়ার বড় বড় গবেষকদের। সেই সময় পাথর সংগ্রহ করা থেকে নির্মাণশৈলী পর্যন্ত সব কিছুই এখনো রহস্যাবৃত। পার্থেননের নির্মাণ এবং  স্থাপত্যকলা আধুনিক সভ্যতা ও স্থাপত্যের পথিকৃৎ হিসেবে কাজ করছে। এই ডিজাইনকে মাথায় রেখে তৈরি করা হয়েছে ফ্রেঞ্চ পার্লামেন্ট, ইউএস সুপ্রিম কোর্ট। মানুষের সৃষ্টিশীলতা ও সৃজনশীলতাকে  এক সীমাহীন উচ্চতায় এনে দাঁড় করিয়েছে পার্থেননের নির্মাণ কৌশল।

পার্থেননের নির্মাণ করতে সময় লাগে নয় বছর। ধারণা করা হয়, এর নির্মাণ কাজে পীথাগোরাসের  সূত্র ব্যবহার করা হয়েছে এবং পীথাগোরাস এথেন্সে ছিলেন যখন পার্থেননের নির্মাণকাজ চলছিল।

এথেনা কুমারী দেবী, এই কারণে মন্দিরের নাম পার্থেনন রাখা হয়েছে। গ্রিক ভাষায় পার্থেনন শব্দের অর্থ কুমারী। মন্দিরের ভিতরে ছিল ১১ মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট এথেনার মূর্তি, যার হাতে ছিল বিজয়ের দেবী নাইকির মূর্তি। এই মন্দির খ্রিস্টপূর্ব ৪২৭ পার্সিয়ানদের দ্বারা ধ্বংস প্রাপ্ত হয় এবং গ্রিস তার স্বাধীনতা ফেরত পাবার পর এটি আবার পুনর্নির্মাণ শুরু করে ১৮৩৪ সালে ।

এরিকথিওন  কমপ্লেক্স এবং পোর্চ অব মেই ড্যান্সমন্দির। ছবি : লেখক

পোর্চ অব দা মেইডেন্স

এই মন্দিরটির অবস্থান পার্থেননের সোজাসোজি। প্রতিবছর বন্য পশু-পাখি, কুমারিত্ব ও  শিশুজন্মের দেবী আর্তিমিসকে উৎসর্গ করে এক ধরনের উৎসব অনুষ্ঠিত হতো। যে উৎসবে কুমারী মেয়েরা এক বিশেষ ধরনের নাচ করত, সে নাচকে বলা হয় ক্যারিয়াটিড। আর সেসব কুমারী মেয়েগুলোকে বলা হতো কোরাই। মন্দিরের ডিজাইনটি খুবই আকর্ষণীয়। ছয়টি নারী মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে প্রহরীর মতো, যাদের সবার দৃষ্টি পার্থেননের দিকে। নারী মূর্তিগুলো তাদের মাথায় বহন করছে এক একটি ভারী পাথর। আসলে সেই মূর্তিগুলোর মাধ্যমে  নারীর ক্ষমতা প্রদর্শিত হচ্ছে। প্রতিটি নারী মূর্তির উচ্চতা সাত ফুট সাত ইঞ্চি।

বেল্ভিদেয়ার টাওয়ার। ছবি : লেখক

বেল্ভিদেয়ার টাওয়ার

মধ্য যুগ থেকে এই টাওয়ারের উপর গ্রিসের পতাকা প্রদর্শিত হচ্ছে। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় কিছু দিনের জন্য সেখানে নাৎসি বাহিনীর পতাকা উড়ানো হয়েছিল। ১৮ বছরের দুই তরুণ তরুণী দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় ১৯৪১ সালে নাৎসি বাহিনীর ওই পতাকাটি নামিয়ে ফেলে। তাদের এই সাহসী কাজে উজ্জীবিত হয় গ্রিক সমাজ।

এরিকথিওন

এরিকথিওনকে  বলা হয় সবচেয়ে পবিত্র ইমারত। যদিও এর অবস্থান  ঠিক কোথায় তা বর্তমান অ্যাক্রোপোলিস দেখে বোঝার উপায় নেই। পোর্চ অব মেইড্যান্সের পুরো কমপ্লেক্সটাকেই  এরিকথিওন বলা হয়। ধারণা করা হয় দেবী এথেনা এবং দেবতা পসেইডনের যুদ্ধ এখানেই হয়েছিল। সেই যুদ্ধে নির্ধারণ হয় কে হবে এথেন্সের বিধাতা। দেবী এথেনা এই যুদ্ধে জয়লাভ করে সমুদ্রের দেবতার সহায়তায়। সেই থেকে এথেন্সবাসী দেবী এথেনার পুজো করে আসছে এবং এই শহরের নামকরণও করা হয় এথেন্স।  কেন এই মন্দিরের নাম এরিকথিওন তা এখনো স্পষ্ট নয় । তবে এরিকথিওনের নাম হোমারের বিখ্যাত কাব্য গ্রন্থ ‘ইলিয়ডে’ উল্লেখ আছে একজন গ্রিক রাজা ও বীর হিসেবে।

সংস্কারের পর থিয়েটার অব ডাইনোসাস। ছবি : লেখক

থিয়েটার অব ডাইনোসাস

নাটকের জন্মভূমি বলা হয় অ্যাক্রোপোলিসের থিয়েটার অব ডাইনোসাসকে। অ্যাক্রোপোলিসের নিচে দক্ষিণপূর্ব দিকে থিয়েটার অব ডাইনোসাসের অবস্থান। সেখানেও  সংস্কারের কাজ চলছে। থিয়েটারের ধার ঘেঁষে অ্যাক্রোপোলিসের দেয়ালের কিছু অংশ দৃষ্টি গোচর হয়। এই থিয়েটার অর্ধেক মানুষ– অর্ধেক ছাগল রূপী ওয়াইনের দেবতা ডাইনোসাসকে উৎসর্গ করে বানানো। ১৭ হাজার দর্শক ধারণ ক্ষমতা  থিয়েটার অব  ডাইনোসাসের। দেবতা ডাইনোসাসকে উদ্দেশ করে বিভিন্ন গান, নাচ এবং নাটক প্রদর্শিত হতো এই থিয়েটারে। শুধু প্রদর্শন নয়, নাটকের বিভিন্ন প্রতিযোগিতাও অনুষ্ঠিত হতো এথেন্সবাসীদের মধ্যে। বিখ্যাত গ্রিক নাট্যকার ইউরিপিদিস, সফোক্লেস,  এসকাইলাসের নাটকগুলো এখানেই প্রদর্শিত হতো।

পুরো অ্যাক্রোপোলিস ঘুরে দেখতে আমার সময় লেগেছে চার ঘণ্টা । বিভিন্ন জায়গায় সংস্কার কাজ চলছে। আমার কাছে মনে হচ্ছিল, সংস্কারের কারণে এর প্রত্নতাত্তিক মূল্য কিছুটা হলেও ক্ষয়ে যাচ্ছে। সেই পুরোনো ভাঙ্গা পাথরের টুকরো অথবা অর্ধেক দেয়াল আমার কাছে অনেক বেশি লোভনীয়। যদিও সরকারী উদ্যোগে  যথাযথ গবেষণার মাধ্যমে সংস্কার কাজগুলো হচ্ছে । 

অ্যাক্রোপোলিসে প্রবেশের টিকেট অনলাইনে করা যায় এবং বুদ্ধিমানের কাজ হলো ‌আগেই অনলাইনে কাজটি সেরে ফেলা, না হলে দীর্ঘ লাইনে পরতে হবে আমার মতো। যেহেতু পুরো জায়গাটি ভালোভাবে ঘুরে দেখতে সময় লাগে চার-পাঁচ ঘণ্টা, তাই দিনের শুরুতেই অ্যাক্রোপোলিসের দেখবার পার্টটি  চুকিয়ে ফেলা ভালো। অ্যাক্রোপোলিস দেখবার সময় নিজের সাথে পানির ব্যবস্থা রাখতে এবং আরামদায়ক জুতা পরতে ভুলবেন না। 

উপরের সব তথ্য অ্যাক্রোপোলিসের প্রতিটি  ইমারতের সামনের বোর্ডে লিখিত গল্প থেকে এবং  অ্যাক্রোপোলিসের টিকেট ঘরের পাশে বুকশপ থেকে কেনা ‘The Acropolis of Athens, The Monuments’  বই থেকে নেওয়া।

গ্রিক সভ্যতা, স্থাপত্য, কৃষ্টি, সংস্কৃতি, প্রাচীন গ্রিসের ইতিহাস ও ধর্মীয় বিশ্বাসের এক  অনন্য,  বৈচিত্র্যপূর্ণ ও অপূর্ব  উদাহরণ এই অ্যাক্রোপোলিস। প্রতি বছর দুই কোটি পর্যটক অ্যাক্রোপোলিসের পাথরের ভাঁজে লুকানো ইতিহাসের স্বাদ ও গন্ধ উপভোগ করে।