শীতে ছুটিতে
চলুন যাই ভরত রাজার দেউলে
ব্যস্ত নগরজীবনে কাজকর্মের চাপে যখন পিষ্ট হয়ে যাচ্ছেন, ঠিক তখনই কোনো দর্শনীয় স্থান ঘুরে আসতে পারেন। একঘেয়েমি দূর হওয়ার পাশাপাশি ইতিহাস-ঐতিহ্যের সান্নিধ্য পাবেন খুব কাছ থেকে।তাই যান্ত্রিক জীবন থেকে মুক্তি ও শীতের আমেজকে একটু অন্যভাবে রাঙিয়ে তুলতে ঘুরে আসতে পারেন দক্ষিণের জনপদ যশোর জেলার কেশবপুর উপজেলা থেকে ১৯ কিলোমিটার দূরে ইতিহাস-ঐতিহ্য পরিপূর্ণ ভরত ভায়নার (ভরত বাজার) দেউল। ভরত দেউলের একপাশে রয়েছে সবুজে ঘেরা বিস্তৃত গ্রাম আর অন্যপাশে ভদ্রা নদী।
প্রায় ১৮০০ বছর আগে গুপ্ত যুগে এ বিশাল আকৃতির সপ্তকটি নির্মাণ করেছিলেন ভরত রাজা। কালের সাক্ষী হিসেবে সগৌরবে এখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে ভরত ভায়নার দেউল। এটি ইতিহাস আর ঐতিহ্যের প্রতীক।স্থানীয়দের কাছে দীর্ঘদিন ধরে ভরতের দেউল বা ভরত রাজার দেউল নামে পরিচিত।
বিশেষজ্ঞদের অনুসন্ধানে জানা যায়, দেউলটি খ্রিস্টাব্দে বিশ’ শতকে গুপ্তযুগে নির্মিত। ১৮০০ বছর আগে ভরত নামে তৎকালীন এক প্রভাবশালী রাজা ভদ্রানদীর তীরবর্তী এলাকাসহ সুন্দরবনের অনেকাংশে রাজত্ব আদায় করেছিলেন। কালের আবর্তে তার স্মৃতি ধরে রাখার জন্য তিনি ভদ্রানদীর তীরে ভরত ভায়না নির্মাণ করেন।
ইতিহাস থেকে আরো জানা যায়,প্রত্নস্থানে খ্রিস্টীয় বিশ শতকের গোড়ার দিকে ১২ দশমিক ২২ মিটার উঁচু এবং ২৬৬ মিটার পরিধি বিশিষ্ট একটি ঢিবির অস্তিত্ব ছিল। ১৮৮৯ সালে ব্রিটিশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সুপারিন্টেন্ডেন্ট কাশীনাথ দীক্ষিত এ দেউল পরিদর্শনে এসে মন্তব্য করেন যে এটি ৫০ ফুটের অধিক উঁচু এবং ব্যাস ৯০০ ফুটেরও অধিক।
বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ ১৯৮৪ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে সাত অর্থ বছরের বরাদ্দ পেয়ে এ দেউলে খননের কাজ চালায়। খননের ফলে দেউলটির পূর্ণ অবয়ব মানুষের দৃষ্টিতে আসে।কিন্তু খননের ফলে জানা যায় ১৮৯৭ সালে ভূমিকম্পে এ দেউলের উপরিভাগ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।খননে সমগ্র প্রাসাদটির ভিত থেকে শেষ পর্যন্ত মোট ৯৪টি কক্ষ পাওয়া যায়। চারপাশে চারটি উইং ওয়াল। এর মধ্যে ১২টি কক্ষ। বাকি ৮২টি কক্ষের সমন্বয়ে এ বৌদ্ধ স্তূপটি তৈরি। স্তূপটির চূড়ায় চারটি কক্ষ। এ কক্ষের দুই পাশে আরো আটটি ছোট ছোট কক্ষ রয়েছে। অধিকাংশ কক্ষগুলো মাটি দ্বারা পরিপূর্ণ।ধারণা করা হয় বৌদ্ধ সপ্তকের উপরিভাগে জাঁকজমকপূর্ণ একটি উপাসনালয় ছিল। প্রাসাদটির চারপাশে তিন মিটার চওড়া রাস্তা রয়েছে। উপাসনালয়ের চারপাশে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা প্রদক্ষিণ করে পূণ্য অর্জন করত। চারটি উইং দেয়ালে যে ঘরগুলো ছিল সম্ভবত সেগুলোতে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা বসবাস করতেন বা অবসর সময় কাটাতেন।
প্রতিটি কক্ষের দেয়াল তিন মিটার থেকে ১৩ মিটার পর্যন্ত চওড়া। অনেক ইট ৩৬ সেন্টিমিটার থেকে ৫০ সেন্টিমিটার। ইটগুলো দেখলে মনে হবে হাত দিয়ে তৈরি। অবাক করার বিষয় নির্মাণে যে ইট ব্যবহার হয়েছে এত বড় আকারের ইট এতদঞ্চলের অন্য কোনো পুরাকীর্তিতে ব্যবহার করা হয়নি।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, খননকার্য চলাকলীন যেসব পুরাকীর্তি ও জিনিসপত্র পাওয়া গেছে- তার মধ্যে পোড়া মাটির বাঘের মুখমণ্ডল, মানুষের মুখমণ্ডল, দেব-দেবীর হাতের ভগ্নাংশ। বিভিন্ন প্রকৃতির নকশা করা ইট, পোড়া মাটির খেলনা।প্রত্নতাত্ত্বিক জিনিসগুলো সংরক্ষিত আছে খুলনা বিভাগীয় জাদুঘরে।
ভরতের দেউলের একাংশ আগলে রেখছে বিরাট এক প্রাচীন বটবৃক্ষ। এর পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে ভদ্রা নদী। সবকিছু মিলেমিশে ভরতের দেউলের স্থানটি বেশ মনোরম এবং প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী খুবই চমৎকার।
যেভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে প্রথমে বাস অথবা ট্রেন খুলনা যেতে হবে।কারণ স্থানটি যশোর জেলাতে হলেও খুলনা হয়ে যাওয়াটা সহজ।
খুলনা থেকে যাওয়ার রুট- প্রথমে অটোতে খুলনার দৌলতপুর হয়ে মহসিন মোড়ে আসতে হবে। তারপর আবার অটোতে(মাহেন্দ্র) করে শাহপুর বাজার আসতে হবে (ভাড়া ২০ টাকা)। শাহপুর বাজারে নেমে এবার ভ্যান অথবা অটোতে যেতে হবে ভরতের দেউল।তবে ভ্যানচালকদের ভরতের দেল না বললে চিনবে না। (ভ্যান ভাড়া ২০ টাকা) ছয়-সাত কিলোমিটার দূরত্ব। তবে ফেরার পথে ভ্যান/অটো সহজে পাওয়া যায় না। ভালো হয় আপনি যে ভ্যানে যাবেন ওই ভ্যান ড্রাইভারকে বললে উনি আবার নিয়ে আসবেন আপনাকে।
কোথায় খাবেন
ফেরার পথে চুকনগরের বিখ্যাত আব্বাসের হোটেল থেকে খাসির মাংশ খেয়ে আসতে পারেন।
কোথায় থাকবেন
আশপাশে থাকার কোনো হোটেল নেই। ভালো হয় খুলনা ফিরে কোনো একটা হোটেলে রাতে থাকলে। সেই সাথে সন্ধ্যায় খানজাহান আলী সেতু থেকে ঘুরে আসতে পারেন।