গ্রিস ভ্রমণ

পুরাতত্ত্বের মিছিলে

Looks like you've blocked notifications!

গ্রিস ভ্রমণের প্রাক্কালে কিছু ইউরোপীয় বন্ধুর পরামর্শ নিয়েছিলাম, কীভাবে সময়কে ভাগ করব এবং কী কী জায়গা অবশ্যই দেখব। একবাক্যে সবাই বলেছে, এথেন্সের প্রত্নতত্ত্ব জাদুঘর যেন কোনো অবস্থাতেই মিস না করি। আমার বন্ধুরা জানে প্রত্নতত্ত্বের ওপর আমার দুর্বলতার কথা।

এথেন্সে পৌঁছে হোটেলে বসে ইন্টারনেটের শরণাপন্ন হলাম প্রত্নতত্ত্ব জাদুঘর সম্পর্কে একটু ধারণা নেওয়ার জন্য। তাতে দেখলাম, ভালো সময় লাগবে জাদুঘরটি ঘুরে দেখতে। যা ধারণা পেলাম, তা হলো পাঁচ/ছয় ঘণ্টা তো লাগবেই।

পরদিন সকালে নাশতা সেরে ৯টার দিকে বেরিয়ে পড়লাম প্রত্নতত্ত্ব জাদুঘরের উদ্দেশে। আমার হোটেল থেকে দূরত্ব দেখাল গুগল ম্যাপ দুই কিলোমিটার। আমি হেঁটেই রওনা দিলাম দুটো কারণে—টাকা বাঁচানো এবং হেঁটে হেঁটে শহর দেখা। প্রায় ৩০ মিনিট হাঁটার পর জাদুঘরের টিকেটঘরের সামনে এসে উপস্থিত হলাম এবং বরাবরের মতো ইউরোপীয় শিক্ষার্থী হওয়ার কারণে ফ্রি প্রবেশাধিকার পাস নিয়ে জাদুঘরে প্রবেশ করলাম।

এথেন্সের জাতীয় প্রত্নতত্ত্ব জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাকাল ১৮২৯ এবং এটি গ্রিসের সবচেয়ে বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ জাদুঘর। শুধু তাই নয়, বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ ১০টি জাদুঘরের মধ্যে এটি একটি। প্রাগৈতিহাসিক কাল, নব্য প্রস্তরযুগীয় নিদর্শন থেকে শুরু করে মধ্য যুগের ১১০০ নিদর্শন সংরক্ষিত আছে এখানে। সব নিদর্শনই ধারাবাহিকভাবে সজ্জিত আছে, শুধু হাতে সময় নিয়ে উপভোগ করতে হবে।

আমি যেদিক থেকে জাদুঘরে প্রবেশ করলাম, তার প্রবেশদ্বারে লেখা আছে খ্রিস্টপূর্ব ৬০০-৫০০ অব্দ। বিশাল এক ঘরে প্রবেশ করলাম এবং ধীরে ধীরে তাদের সংগ্রহ দেখতে থাকলাম। এই জাদুঘরে আপনি ছবি তুলতে পারবেন, ভিডিও করতে পারবেন। প্রতিটি কক্ষের সামনে সব নিদর্শন সম্পর্কে এবং সময়কাল ধরে একটি বর্ণনা লেখা আছে, যা খুবই তথ্যবহুল। সর্বোপরি বর্ণনা ছাড়াও প্রতিটি মূর্তির সামনে নির্দিষ্টভাবে ব্যাখ্যা করা আছে সবকিছু।

প্রতিটি কক্ষের স্ট্যাচুগুলো দেখে আমার মনে হচ্ছিল, এই বুঝি কথা বলে উঠবে। প্রতিটি চরিত্রকে এত জীবন্ত মনে হচ্ছিল যে মনে প্রশ্ন জাগছিল, সেগুলো কি আসলেই কারো কল্পনার তৈরি! ভাবতে বাধ্য হচ্ছিলাম একবিংশ শতাব্দীর কল্পনা আর খ্রিস্টপূর্ব ৭০০/৮০০ বছর আগের কল্পনা কতটুকু এক বা অভিন্ন। নতুন কিছু কি আসলেই সৃষ্টি হয়েছে, না কেবল পরিবর্তিত অবয়ব নিয়ে সবাই কাজ করছে। সভ্যতা, সংস্কৃতি, কৃষ্টি, শিল্পের আধুনিকায়ন আসলে কতটুকু মৌলিক? ভাবনাগুলো খুব তাড়িত করছিল।

এই স্বল্প পরিসরে পুরো মিউজিয়ামের সব পুরাতত্ত্ব, সেসময়ের ব্যবহার্য তৈজসপত্র, অলংকার সম্পর্কে লেখা কষ্টসাধ্য। এখানে অল্প কিছু গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শনের কথা আলাপ করলাম।

কড়ই ও ক্যুরস

কড়ই বলতে বোঝায় কুমারী মেয়ে অথবা কিশোরী আর ক্যুরস বলতে কিশোর অথবা তরুণ। এগুলোর নির্মাণকাল বলা হয়েছে খ্রিস্টপূর্ব ৫৫০-৬০০ অব্দ এবং ভাস্কর্যগুলো আর্কেইক যুগের। আর্কেইক যুগ গ্রিসের ভাস্কর্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সময়। গ্রিসে নতুন আর্ট কালচারের সূচনা হয় আর্কেইক যুগের পর থেকেই। মিসরীয় কৃষ্টি ও সভ্যতার দারুণ প্রভাব ছিল সেই সময় গ্রিসে। এথেন্স শহরের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে মিরান্ডা নামক স্থানে কড়ই এবং ক্যুরসের বেশ কিছু স্ট্যাচু পাওয়া যায় ১৯৭২ সালে।

জিউস অথবা পসেইডন

স্যাটেলাইট ও ইন্টারনেটের যুগে জিউসের ছবির সঙ্গে সবাই মোটামুটি পরিচিত। তারপরও সামনে বিশাল ব্রোঞ্জের জিউসকে দেখে ‘আহা জিউস’ শব্দটি মনের অজান্তেই বেরিয়ে গেল। আমার সফরসঙ্গী কেউ ছিল না, তাই নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশ করার সুযোগ পাচ্ছিলাম না। সুতরাং নিজের সঙ্গে নিজেকে কথা বলতে হচ্ছিল।

এই ব্রোঞ্জের মূর্তিটি নিয়ে প্রত্নতত্ত্ব এবং ইতিহাসবিদদের মধ্যে মতভেদ আছে। অনেকে মনে করেন, এটি দেবতা জিউসের; আবার কারো কারো ধারণা এটি পসেইডনের অবয়ব। পৌরাণিক ইতিহাস বলে দেবতা জিউস এবং পসেইডনের পৃথিবী পরিচালনার ক্ষমতা ও অধিকার একই রকম ছিল। আকাশ পরিচালনা করতেন জিউস আর সমুদ্র পসেইডন।

স্থানীয়রা মনে করেন, ব্রোঞ্জের মূর্তিটি দেবতা জিউসের প্রতিকৃতি। গ্রিসের ইভিয়া দ্বীপে এটি পাওয়া যায়, যার নির্মাণকাল খ্রিস্টপূর্ব ৪৩০ অব্দ।

ঘোড়া এবং দেবতা নাইকি
ঘোড়ার ওপর দেবতা নাইকির ব্রোঞ্জের স্ট্যাচুটি জাদুঘরের মধ্যমণি। নিদর্শনটির সাজসজ্জা দেখলেই বোঝা যায়, এটি বিশেষ গুরুত্ব বহন করছে। জিউসের ব্রোঞ্জের মূর্তির প্রাপ্তি স্থানেই পাওয়া যায় এবং নির্মাণ সময় খ্রিস্টপূর্ব ১৪০ অব্দ। ইতিহাসবিদদের মতে, ব্রোঞ্জের তৈরি জিনিসপত্র খুব বেশি সময় ধরে মাটির নিচে থাকলে সহজেই গলে যায়। কিন্তু বিশেষ ধরনের নির্মাণশৈলীর জন্য হয়তো নিদর্শনটি বেঁচে ছিল।

আগামেমননের মুখোশ

আগামেমননের এই ‘গোল্ড ডেথ মাস্ক’ গ্রিসের ব্রোঞ্জ যুগের একটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন এবং সময়কাল বলা আছে খ্রিস্টপূর্ব ১৫৮০ অব্দ। গ্রিসের প্রাচীন শহর মাইছিনে গোল্ড মাস্কটি পাওয়া যায় ১৮২৬ খ্রিস্টাব্দে।

কেরামিকস সমাধি

১৮৯১ সালে এথেন্স শহরের প্রাচীন সমাধিস্থান কেরামিকস খনন করা হয়। সেখানে খননকালে দুটো কঙ্কাল পাওয়া যায়। কঙ্কালের সঙ্গে মাটির আস্তরযুক্ত একটি শিলালিপি পাওয়া যায়। শিলালিপি এবং কঙ্কালের বয়স খ্রিস্টপূর্ব ৪৬০ অব্দ। কঙ্কাল দুটির পাশে নয়টি করে মাটির ফুলদানি পাওয়া যায়।

স্ট্যাচু অব সাইরেন

গ্রিক পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে সাইরেনকে একটি ভয়ংকর প্রাণী হিসেবে ধরা হয়, যার রয়েছে অসম্ভব সুন্দর গানের কণ্ঠ এবং তারা গান শুনিয়ে নাবিকদের লক্ষ্যভ্রষ্ট করত তাদের দ্বীপ অভিমুখে। সাইরেনের অবয়ব এবং শারীরিক গঠন নারীর মতো; কিন্তু পা পাখিসদৃশ আর শরীরের পেছনে দুটি পাখা আছে। সাইরেনের বাঁ হাতে কচ্ছপের খোলস থেকে তৈরি এক ধরনের বাদ্যযন্ত্র, যা প্রাচীন গ্রিসে ব্যবহৃত হতো। আর ডান হাতে মেজরাব থাকার কথা, কিন্তু মূর্তিটি এভাবেই উদ্ধার হয় প্রাচীন গ্রিক সমাধিস্থান কেরামিকস খনন করার সময়।

অনুমান করা হয়, সাইরেনের নির্মাণকাল খ্রিস্টপূর্ব ৩০০-৩৫০ অব্দ। সে সময় মরদেহের সঙ্গে সাইরেনের স্ট্যাচু পাশে রেখে সমাধিকাজ পূর্ণ করা হতো অথবা সমাধির সামনে সাইরেনের স্ট্যাচু রাখা হতো।

আফ্রোদিতি, প্যান ও ইরোস

দেবী আফ্রোদিতির বেশ কয়েকটি ভাস্কর্য দেখতে পেলাম জাদুঘরে। আফ্রোদিতি, প্যান ও ইরোসের মূর্তিটি আমার নজর কাড়ল।

গ্রিক পুরাণের গল্পে আফ্রোদিতি হলো—ভালোবাসা, সৌন্দর্য ও যৌনতার দেবী। তাঁর জন্মগ্রহণের মেলা কাহিনী রচিত আছে। হোমারের বর্ণনা অনুসারে দেবতা জিউসের মেয়ে আফ্রোদিতি এবং ট্রোজান যুদ্ধের অন্যতম প্ররোচনাকারী হিসেবে দেখা হয় তাঁকেই।

গ্রিক কাহিনীতে প্যানকে বলা হয় বন এবং পশু-পাখির দেবতা। প্যানের শরীরের উপরিভাগ দেখতে মানুষের মতো, মাথার ওপরে দুটি শিং আছে, নাক বড়, চোখগুলো হলুদ এবং পাগুলো ছাগলের পায়ের মতো। প্যানের পারদর্শিতা ছিল কণ্ঠে নানা জাতীয় শব্দ সৃষ্টির। সেই শব্দে বনের পশুপাখিরা সব ভয় পেত। প্যানিক শব্দটির উৎপত্তি তার নাম থেকেই।

আফ্রোদিতি, প্যান ও ইরোসের ভাস্কর্যে দেখানো হয়েছে, প্যান আফ্রোদিতিতে বিরক্ত করছে, আফ্রোদিতি এক হাতে তার নিম্নাঙ্গ লুকিয়ে রেখেছে আর অন্য হাতে স্যান্ডেল দেখিয়ে প্যানকে তিরস্কার করছে। আফ্রোদিতির ছেলে ইরোস তা পছন্দ করছে না বলে প্যানের শিং ধরে আঘাত করার চেষ্টা করছে। এই মূর্তিটি তৈরির সময় নির্ণয় করা হয় খ্রিস্টপূর্ব ১০০ অব্দে। প্রাপ্তিস্থান গ্রিসের ডেলস দ্বীপ।

সিক্লেডিক আর্ট

প্রাচীন সিক্লেডিক সভ্যতা ও সংস্কৃতি গড়ে ওঠে খ্রিস্টপূর্ব ৩৩০০ অব্দে। সে সময়ের উল্লেখযোগ্য সৃষ্টির মধ্যে ছিল মার্বেলের তৈরি ভাস্কর্য, যেগুলোকে বলা হতো ‘আইডলস’ অথবা ‘ফিগারাইন্স’। ভাস্কর্যগুলো দেখে নিরূপণ করার উপায় ছিল না কোনটি পুরুষ বা নারী।

আমার প্রত্নতত্ত্ব জাদুঘর ভ্রমণ শেষ হয় সিক্লেডিক সভ্যতার সৃষ্টিগুলো উপভোগের মধ্য দিয়ে। আসলে গ্রিসের প্রত্নতত্ত্ব জাদুঘরের আস্বাদ পাওয়ার জন্য মাত্র এই কয়েকটি জিনিসের বর্ণনা যথেষ্ট নয়।

তবে প্রায় সাত ঘণ্টার মতো আমি বিচরণ করছিলাম অন্য এক দুনিয়ায়। গ্রিসের প্রত্নতত্ত্ব জাদুঘরটি দেখার আগে প্যারিসের লুভর জাদুঘর দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। কিন্তু গ্রিসের প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শন কিছুটা হলেও লুভরের সৌন্দর্য ম্লান করেছে আমার কাছে।

জাদুঘর থেকে বের হয়ে দেখলাম বাইরে অন্ধকার, আবারও হেঁটে হোটেলের অভিমুখে যাত্রা করলাম। হাঁটতে হাঁটতে একই কথা মাথায় ঘুরছিল, কোন সময়টা আসলে আধুনিক! একবিংশ শতাব্দীর অগমেন্টেড রিয়েলিটির কারিগর নাকি ব্রোঞ্জ অথবা প্রস্তর যুগের কারিগর।

যে সৃষ্টি আমাদের এখনো ভাবায়, যার কিছু কিছু রহস্য এখনো উদ্ঘাটিত হয়নি। যে সৃষ্টি মনুষ্য জাতিকে সীমাহীন উচ্চতায় অধিষ্ঠিত করে, তাকে পুরোনো বলি কী করে!