গ্রিস ভ্রমণ

এথেনিয়ান ট্রিলজি

Looks like you've blocked notifications!
ইউনিভার্সিটি অব এথেন্সের মূল ভবনের সামনে লেখক। ছবি : লেখক

‘ট্রিলজি’ শব্দটি শুনলে সঙ্গে সঙ্গে মনে হয় কোনো নাটক, সিনেমা অথবা উপন্যাসের তিন পর্বের গল্পের কথা। না, এথেনিয়ান ট্রিলজি কোনো নাটক, সিনেমা বা উপন্যাস নয়, অন্য কিছু। সেটা কী, বলছি একটু পরই।

আমি তখন নেদারল্যান্ডসে। নেদারল্যান্ডস থেকে মাত্র তিন ঘণ্টা ১৫ মিনিটের মেঘ পাড়ি দিয়ে পৌঁছলাম গ্রিসের রাজধানী এথেন্সের ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে। এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে হোটেল খুঁজে পেতে তেমন বেগ পেতে হলো না। তবে বাইরের তাপমাত্রা ভালোই জানান দিচ্ছিল গ্রীষ্মকালীন ইউরোপের। হোটেলে পৌঁছলাম দুপুর আর বিকেলের মাঝামাঝি সময় হবে সেটা হয়তো। ইউরোপের গ্রীষ্মকালীন বিকেল বুঝতে আমার অসুবিধা হয়। কারণ সূর্য অস্ত যাওয়ার সময় তখন সন্ধ্যা ৮টা ১৫/৩০ মিনিট হবে। সুতরাং বিকেল ৩টা, দুপুর না বিকেল বলব, তা নিয়ে সব সময় সন্দিহান থাকি। ইউরোপের কিছু কিছু দেশে দুপুরের খাবার সময় দুপুর ১২টা থেকে ১টা, তা সে শীতকাল হোক আর গ্রীষ্মকালই। হোটেল থেকে বেরিয়ে হালকা একটু খেয়ে বের হলাম হেঁটে শহর দেখব বলে।

ইউনিভার্সিটি অব এথেন্সের মূল ভবনের সামনে লেখক। ছবি : লেখক

প্রায় ৩০ মিনিট হাঁটার পর বেশ প্রশস্ত একটা রাস্তায় এসে উঠলাম। সেই রাস্তার কিছুদূর হাঁটার পর দূর থেকে চোখে পড়ছিল দেবী এথেনা এবং দেবতা অ্যাপোলোর মূর্তি। মূর্তি লক্ষ করে সেদিকেই অগ্রসর হলাম। কিন্তু সেই স্থাপনাটি আগে আরো একটি ডরিক ডিজাইনের স্থাপনা দেখতে পেলাম। তখন বুঝতে পারলাম, আমি দেখা পেয়েছি এথেন্স ট্রিলজির। এই ট্রিলজির কাজ শুরু হয় ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে। সে সময় এথেন্স শহরের কেন্দ্রে তিনটি ভবন নির্মাণ করা হয় নব্য ধ্রুপদি যুগের সূচনাকল্পে গ্রিসের ডরিক ডিজাইনকে মাথায় রেখে। এই তিনটি ভবনকে একসঙ্গে বলা হয় ‘এথেনিয়ান ট্রিলজি’। ভবনগুলো হলো : গ্রিসের জাতীয় গ্রন্থাগার, এথেন্স একাডেমি ও এথেন্স ইউনিভার্সিটি। তিনটি ভবনের ডিজাইন করেন ড্যানিস স্থপতি থিওফিল হান্সেন এবং খ্রিস্তিয়ান হান্সেন।

তাহলে অল্প করে পরিচিত হই প্রতিটি ভবন সম্পর্কে। প্রথম ঘুরে দেখলাম গ্রিসের জাতীয় গ্রন্থাগার।

গ্রিসের জাতীয় গ্রন্থাগার। ছবি : লেখক

গ্রিসের জাতীয় গ্রন্থাগার

১৮৩০ সালের শেষের দিকে গ্রিসে প্রথম গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠিত হয় এজাইনা দ্বীপে। তারপর ১৯৩৪ সালে সেটি স্থানান্তর করা হয় এথেন্সে, যখন এথেন্সকে নতুন রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ১৮৪২ সালে ইউনিভার্সিটি অব এথেন্সের লাইব্রেরি এবং জাতীয় লাইব্রেরি একসঙ্গে ১৫ হাজার গ্রন্থের বিশাল ভাণ্ডার নিয়ে যাত্রা শুরু করে গ্রিসের নতুন জাতীয় গ্রন্থাগার।

নির্মাণকাজ শুরু হয় ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে। তবে সদস্য ছাড়া ভেতরে ট্যুরিস্টদের প্রবেশের অনুমতি নেই। আরো একটি কারণ হলো, লাইব্রেরিটি সম্প্রসারিত করা হচ্ছে এবং আধুনিকায়নের কাজ চলছে। বর্তমানে এই লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত বইয়ের সংখ্যা হলো সাত লাখ।

ইউনিভার্সিটি অব এথেন্স। ছবি : লেখক

ইউনিভার্সিটি অব এথেন্স

জাতীয় গ্রন্থগার থেকে বেরিয়ে অল্প কিছুক্ষণ হাঁটলেই দেখা মিলবে ইউনিভার্সিটি অব এথেন্সের। গ্রিসের সব থেকে পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয় এটি, প্রতিষ্ঠাকাল ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দ। গ্রিসের রাজা ওটোর নামানুসারে প্রথমে এই ইউনিভার্সিটির নামকরণ করা হয় ওটোনিয়ান ইউনিভার্সিটি। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কয়েক দফা এর নাম পরিবর্তন হয়। ১৮৬২ সালে এটির নাম হয় ‘জাতীয় এবং ক্যাপদিস্ত্রিয়ান ইউনিভার্সিটি’। ক্যাপদিস্ত্রিয়ান ছিলেন স্বাধীন গ্রিসের প্রথম রাষ্ট্রনায়ক। ফের ১৯৩২ সালে নাম পরিবর্তন করে ‘ইউনিভার্সিটি অব এথেন্স’ করা হয়।

মূল প্রবেশদ্বার দিয়ে ঢুকলে প্রথমে চোখে পড়ে দুটি ফলক। কাছে গিয়ে দেখলাম ফলক দুটি বিভিন্ন সময়ে যুদ্ধে নিহত ছাত্রদের স্মৃতিফলক। একটি ১৮৯৭ সালে তুরস্কের সঙ্গে যুদ্ধের এবং অন্যটি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতিফলক।

মূল একাডেমিক ভবনে প্রবেশের আগে দুটো জলপাই গাছ চোখে পড়ে। গাছ দুটো এড়িয়ে আমি মূল ভবনের দিকে যাচ্ছিলাম। গাছের সামনে একটি সাইনবোর্ডে কিছু লেখা আছে দেখে আগ্রহ হলো। লেখাটি পড়ে অভিভূত হলাম। জলপাই গাছ দুটো আটশ বছরের পুরোনো।

তারপর বেশ কিছুদুর হেঁটে গেলে ইউনিভার্সিটির মূল ভবনে প্রবেশ করলে তৈলচিত্র দৃষ্টিগোচর হয়। তৈলচিত্রগুলো দেখলে প্রথমে মনে হতে পারে হয়তো কোনো মিউজিয়ামের গেট। ইউনিভার্সিটির ভেতরে করিডোরগুলোর ছাদেও সুন্দর সুন্দর তৈলচিত্র চোখে পড়বে, প্রাচীন গ্রিসের ইতিহাসের ওপর।

একাডেমি অব এথেন্স। ছবি : লেখক

একাডেমি অব এথেন্স

ইউনিভার্সিটি অব এথেন্সের পরের ভবনটি একাডেমি অব এথেন্স। এই ভবনের ওপরেই দেখতে পেলাম এথেনা আর অ্যাপোলোর মূর্তি, যেটিকে অনুসরণ করেই পেলাম ট্রিলজির দর্শন।

ঢোকার মুখেই চোখে পড়ল প্লেটো আর সক্রেটিসের বিশাল দুটি ভাস্কর্য। বুঝতে অসুবিধা হলো না একাডেমি অব এথেন্স হল দর্শনের স্কুল। ভেতরে প্রবেশ করতে করতে দেখলাম একই রকম ডরিক ডিজাইন মূল ভবনটির। ভবনের দুপাশে এথেনা আর অ্যাপোলোর মূর্তি।

এই একাডেমির প্রতিষ্ঠাকাল খ্রিস্টপূর্ব ৩৪৭ অব্দ এবং প্রতিষ্ঠাতা আর কেউ নন, গ্রিক দার্শনিক প্লেটো। তবে ৫২৯ খ্রিস্টাব্দে এই একাডেমির কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়, কারণ তখন প্রায়োগিক শিক্ষার প্রচলন শুরু হয়। তত্ত্বের চাইতে তথ্যের ওপর চর্চা শুরুর প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। এর বহু পরে মূলত রেনেসাঁর সময় থেকে মানুষ আবার দর্শনতত্ত্বের ওপর আগ্রহ দেখাতে শুরু করে। তারপর বিভিন্ন দেশে দর্শন একাডেমির প্রতিষ্ঠা হতে থাকে। গ্রিসেও সেই একই প্রচেষ্টা চলতে থাকে এবং সফলতা পায় ১৯২৬ সালে পুনরায় একাডেমি অব এথেন্সের প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে।

বর্তমানে এই একাডেমি গবেষণাধর্মী কাজ করছে বিজ্ঞান ও মানুষের প্রতিকৃতির বিভিন্ন দিক নিয়ে। একাডেমির ভেতরের সাজসজ্জাও বাকি দুই ভবনের মতো বিভিন্ন তৈলচিত্র দিয়ে সাজানো। গবেষকদের আলোচনার স্থানটিও বেশ দৃষ্টিনন্দন।

একাডেমি অব এথেন্সের ভেতরের তৈলচিত্র। ছবি : লেখক

একটি ভালো সিনেমা উপভোগ করার পর যেমন আমরা বলি ‘ইট ওয়াজ এ ভিজুয়াল ট্রিট’, তেমনি অনুভূতি হয়েছে আমার এথেনিয়ান ট্রিলজি দেখে। এথেনিয়ান ট্রিলজি দেখা শেষ হলো যখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই করছে। হোটেলের দিকে অগ্রসর হওয়ার পথ ধরলাম। আবারও হেঁটে।

হাঁটতে হাঁটতে মনে পড়ল মুনতাসীর মামুনের ‘ঢাকা স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী’ বইতে পড়েছিলাম ইউরোপিয়ানদের মধ্যে গ্রিকরা ঢাকা এসেছিলেন সবার পরে। কলকাতার গ্রিক সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা আরগিরি ১৭৭৭ সালে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। ১৮৩২ সালের দিকে ঢাকায় গ্রিকদের ২১টি বাড়ি ছিল। ঢাকায় একটি গ্রিক গির্জাও ছিল। শেষ দুজন গ্রিক সম্প্রদায়ের লোকের কথা শোনা যায়, যারা ১৯৫৬ সালের দিকে নারায়ণগঞ্জে খুলেছিলেন র‍্যালি ব্রাদার্স নামে পাটের কারখানা। তবে এখনো ঢাকায় গ্রিক সম্প্রদায়ের স্মৃতি বহন করছে একটি মাত্র গ্রিক স্মৃতিসৌধ, যেটির অবস্থান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের চত্বরে।

এথেন্স রাজধানী শহর এবং গ্রিসের অন্যতম ব্যস্ত নগরী। তারপরও শহরের কেন্দ্রে তারা নির্মাণ করেছে তিনটি ঐতিহাসিক স্থাপনা, যা অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন। তার চেয়েও বড় কথা, সেগুলো সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করে বিশ্ববাসীর সামনে উপস্থাপন করা হচ্ছে এবং তা থেকে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ অর্থ আয় হচ্ছে। আমাদেরও রাজধানী ঢাকার কেন্দ্রে এবং এর আশপাশে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য ঐতিহাসিক স্থাপনা। যেগুলোর বেশির ভাগের অবস্থা খুবই নাজুক।

যা হোক, হয়তো আমরাও একদিন পারব আমাদের ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোর যথাযথ উপস্থাপন করতে পুরো পৃথিবীর সামনে।