ছুটির দিনে
রোমাঞ্চকর কালা পাহাড়
যারা প্রতিনিয়ত অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় ঘুরে বেড়ায় তাদের ঝুলিতে গল্পের কমতি থাকে না। তবে কিছু গল্প মাঝেমধ্যে অপ্রত্যাশিতভাবেই বেশি স্মরণীয় হয়ে যায়। সিলেট বিভাগের সর্বোচ্চ চূড়া কালাপাহাড় ভ্রমণের স্মৃতিও তেমনি একটু বেশি মধুর হয়ে আছে নানা কারণে।
প্রচণ্ড দাবদাহে যখন পুরো দেশ প্রায় পুড়ছে ঘটনাক্রমে তখনই আমাদের মৌলভীবাজারের কালাপাহাড় যাওয়ার তারিখ নির্ধারিত হয়। একদিকে প্রচণ্ড গরম অন্যদিকে আচমকা ঝড়ের পূর্বাভাসে সহযাত্রীরা কিছুটা থমকে গেল। তবু পিছিয়ে আসা তো দূরে থাক কারো উদ্যোমের কোনো কমতি ছিল না।
নির্ধারিত তারিখে রাতের বাসেই সবাই রওনা হলাম চায়ের রাজধানী মৌলভিবাজারের পথে। যানজটের ঝক্কি পেরিয়ে পৌঁছাতেই মোটামুটি সকাল হলো। কুলাউড়া নেমে ফ্রেশ হয়ে স্থানীয় হোটেলেই নাস্তা পর্ব সেরে নিলাম। অতঃপর সেখান থেকে অটোতে রওনা হলাম পৃথিমপাশা জমিদার বাড়ি। মূলত কর্মধা ইউনিয়নের আজগরাবাদ চা বাগান থেকেই আমাদের যাত্রা শুরু হলেও মাঝখানে পৃথিমপাশার চমৎকার স্থাপনাটা মিস করতে চাইনি।
প্রায় ২০০ বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে পৃথিমপাশা জমিদার বাড়ি। এখানে পুরোনো কয়েকটি স্থাপনার সঙ্গে রয়েছে জমিদার নির্মিত শিয়া সম্প্রদায়ের একটি চমৎকার নকশাখচিত ইমামবাড়া। প্রত্যেকটি স্থাপনাতে আভিজাত্যের ছাপ স্পষ্ট। এ ছাড়া পাশেই রয়েছে চমৎকার শান বাঁধানো ঘাটসহ সুবিশাল দীঘি।
চমৎকার স্থাপনায় সবাই মুগ্ধ হলেও ছবি তোলায় বাগড়া দিচ্ছিল বাড়ির কেয়ারটেকার। বাড়ির পাশের গ্যারেজে গাড়ি দেখে মালিকপক্ষের উপস্থিতি ধারণা করা গেল। খুব বেশি সময় আর দেরি না করে আমাদের যাত্রা শুরু হলো আবার। প্রায় আধা ঘণ্টার মধ্যেই এসে পৌঁছলাম আজগরাবাদ চা বাগানে।
সবাই পোশাক পাল্টে ট্রেকিং উপযোগী ট্রাউজার, জুতা পরে নিল। এর মধ্যেই গাইড ঠিক করা হলো। গাইডের নির্দেশনায় চা বাগানের মধ্য দিয়ে কালা পাহাড়ের উদ্দেশে হাঁটা শুরু হলো। মাথার উপর সূর্য যেন তার সবটুকু তেজ ঢেলে আমাদের কাহিল করার পণ নিয়েছে।
কালাপাহাড় সিলেট তথা দেশের এ অঞ্চলের সর্বোচ্চ পাহাড়চূড়া। উচ্চতা প্রায় ১১০০ ফিট। স্থানীয়রা এই পাহাড়কে বলে ‘লংলা পাহাড়’। এর এক পাশে কুলাউড়া, অন্য পাশে জুড়ি উপজেলা ও ভারত সীমান্ত দিয়ে ঘেরা এই পাহাড় বেশ দুর্গমও বটে।
চা বাগানের রাস্তা শেষে পাহাড়ি পথ ধরে বেগুনছড়া পুঞ্জির উদ্দেশে হাঁটতে লাগলাম। মাঝে পার হয়ে এলাম পাহাড়ি ঝিরি আর কয়েকটা বাঁশের সাঁকো। প্রায় ৪০ মিনিট পরে দূর থেকেই চোখে পড়ল টিনের ছাদ আর পাঁকা বাড়ি সমেত বেগুনছড়া পুঞ্জি। এখানকার স্থানীয় পাড়াগুলোকে বলা হয়ে থাকে পুঞ্জি। এখানকার খাসিয়া জনগোষ্ঠীর আয়ের প্রধান উৎস পান চাষ। চোখে পড়ল অধিবাসীদের প্রার্থনার স্থান আর একটা ছোট স্কুলঘরও।
পুঞ্জিতে আসতেই সবাই মোটামুটি কাহিল হয়ে গেল। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবার যখন রওনা হলাম তখনই আমাদের আশঙ্কা সত্যি করে আকাশ কালো হয়ে এলো। বিক্ষুব্ধ সূর্য মেঘের আড়ালে গিয়ে লুকালো। এর মধ্যে কয়েকবার বিদ্যুৎ চমকে ভয় দেখালেও বৃষ্টি শুরু হয়নি তখনো। প্রায় ঘন্টাখানেক ট্রেকিং শেষেই শুরু হলো তুমুল বৃষ্টি। বৃষ্টির পানি পাহাড়ের গায়ে পড়তেই দেখা দিল টাইগার জোঁকের দল। সহযাত্রীদের মোটামুটি আপন করে নিল তারা। হাতে থাকা কাঁচি দিয়ে কেটেও মোটামুটি নিস্তার পাওয়া যাচ্ছিল না। টিমের মধ্যে যারা একটু নতুন একটু পর পরই জোঁকের আতঙ্কে তাদের চিৎকার শোনা যাচ্ছিল। এর মধ্যেই চলছিল জোঁক নিয়ে নানান হাঁসি-ঠাট্টা।
প্রবল বৃষ্টিতে পাহাড়ি পথ হয়ে উঠল প্রচণ্ড পিচ্ছিল। তারমধ্যেই খাঁড়া জায়গাগুলোর মাটি আলগা হয়ে ধ্বসে পড়াতে আরোহন করা বেশ দুরূহই হয়ে উঠল। কিছু জায়গায় হাতির বিষ্ঠা দেখে জানতে পারলাম পাহাড়ে হাতির বিচরণের কথা। তবে গাইড জানালো এগুলো মূলত পোষ্য হাতি। সীমান্তের কাঁটারের বেড়ায় আটকে গেছে বন্যহাতির অবাধ বিচরণ।
ঘণ্টাখানেক পর অবশেষে আমরা এসে পৌঁছলাম কালা পাহাড়ের চূড়ায়। যৌথ ফটোসেশনও হলো বেশ। এর মধ্যে বৃষ্টি প্রায় থেমে গেছে। কিন্তু বৃষ্টির কারণে আমরা পরিকল্পনা থেকে বেশ অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছি। পূর্ব পরকল্পনা মোতাবেক জুড়ি উপজেলার ফুলতলা হয়ে বের হওয়ার কথা থাকলেও সময়ের হিসাবে তা ভাবনায় ফেলে দিল। তবু এ পথ ধরে এখন এগুলে পৌঁছাতে বেশ রাতই হয়ে যাবে। সব কিছু বিবেচনায় আমাদের মূল টার্গেট কালা পাহাড় সামিট শেষে আবার ফেরার পথ ধরলাম। নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে পাহাড় বেয়ে ঝিরিতে পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই আবার শুরু হয়ে গেল তুমুল বৃষ্টি। ঝিরির ক্রমবর্ধমান পানি দেখে ফ্ল্যাশ ফ্লাডের আশঙ্কা আর উড়িয়ে দেওয়ার উপায় থাকল না। যাওয়ার সময় যেখানে গোড়ালি পর্যন্ত পানি দেখে গেছি সেখানে ইতিমধ্যেই প্রায় এক হাঁটু পানি জমেছে। বাকি পথ যেতে যেতে এই পানি কতটা বাড়বে তা একটু চিন্তায়ই ফেলে দিয়েছিল বটে। তবে সৃষ্টিকর্তা যেন একটু বেশি সদয় হলেন আমাদের প্রতি। কিছু সামনে আসতেই দেখা মিলল কয়েকজন স্থানীয় বাঁশ ব্যবসায়ীর সঙ্গে। তারা জানাল পাহাড় থেকে ঢলের সাথে নেমে আসছে তাদের ভাসিয়ে দেওয়া বাঁশের ভেলা যেগুলোতে ভেসে আমরা চাইলে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারি। তাদের যেন তখন মনে হচ্ছিল একেকজন দেবদূতের মতো। একে একে ভেসে আসতে লাগল বাঁশের ভেলা। সব ভেলা মিলিয়ে আমাদের সবার জায়গা হয়ে গেল। স্রোতের টানে ভেসে ভেলা যেতে থাকল দ্রুত গতিতে। এ যেন এক অভূতপূর্ব স্মরণীয় যাত্রা। দুই পাহাড়ের মাঝের ঝিড়ি ধরে আমাদের ভেলা যেতে থাকল আজগরাবাদ চা বাগানের দিকে। অবশেষে প্রায় ঘণ্টা দেড়েকের ভেলা যাত্রা শেষ হলো।
চা বাগান এলাকা থেকেই গোসল সেরে রওনা হলাম কুলাউড়া হয়ে মৌলভীবাজার শহরের পথে। পানসী হোটেলের সুস্বাদু সব খাবারের আয়োজন যেন আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে।
কালা পাহাড় আসতে হলে
ঢাকা থেকে কালা পাহাড় আসতে হলে কুলাউড়াগামী ট্রেন অথবা বাসে কুলাউড়া আসা যায়। এ ছাড়া মৌলভীবাজার হয়েও কুলাউড়া আসা যায়। সেখান থেকে অটোতে রবিরবাজার হয়ে আজগরাবাদ চা বাগানে আসতে হবে। লোকাল সিএনজিতে গেলে পার পারসন ৫০-৬০ টাকার মতো খরচ পড়বে। আজগরাবাদ অথবা বেগুনছড়া পুঞ্জি থেকেই একজন অভিজ্ঞ গাইড খুঁজে নিতে হবে। যেহেতু কালা পাহাড়ের পাশেই ভারত সীমান্ত, তাই পথ ভুল হলে তা বড় ধরনের বিপদের কারণ হতে পারে।
ট্যুরের বাধ্যতামূলক জিনিসপত্র হিসেবে সঙ্গে রাখতে হবে ট্রেকিং উপযোগী জুতা, ট্রাউজার, শুকনো খাবার, পানি, টর্চ ও এক্সট্রা পলিথিন। এ ছাড়া জোঁকের আক্রমণ থেকে বাঁচতে সঙ্গে রাখতে পারেন কাঁচি এবং অন্যান্য ফার্স্ট এইড। আর অবশ্যই দয়া করে কেউ সাথে নিয়ে যাওয়া পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর কোনো অপচনশীল দ্রব্য বা প্যাকেট ফেলে আসবেন না।