ঘুরে আসুন পানাম রাজ্য

Looks like you've blocked notifications!

নগরজীবনে নানা ব্যস্ততার মধ্যে আপনি বিষিয়ে উঠেছেন। তাই একটু অবসরে নগরের বাইরে ঘুরতে চান। আর সেটা যদি হয় বিশেষ দিনে, বিশেষ অনুষ্ঠানে তবে তো কথাই নেই। তার মজাই আলাদা। সুখবর হলো, সামনেই আসছে স্বাধীনতা দিবসের ছুটি। এই ছুটিতে চলে আসতে পারেন সোনারগাঁ। হাজারো সংস্কৃতি আর ঐতিহ্য বহন করে যুগের পর যুগ ধরে রাজধানীর পাশেই রয়েছে পানাম সিটি যা অনেকের কাছে সোনারগাঁ  নামে পরিচিত। তো আর দেরি কেন, ঘুরে আসা যাক সোনারগাঁ নামে খ্যাত পানাম সিটিতে। তাই আমরা চারজন বন্ধু মিলে রওনা হলাম পানাম সিটির উদ্দেশে।

বাস চলছে দ্রুতগতিতে আর আমি বারবার জানালা দিয়ে বাইরে তাকাচ্ছি। ঘণ্টা পার হলো, ঢাকা থেকে সোনারগাঁ যাচ্ছি। অপেক্ষার প্রহর যেন শেষই হচ্ছে না। আরো কিছুক্ষণ পর অবশেষে মোগড়াপাড়ায় এসে থামলাম। সেখান থেকে রিকশা ঠিক করলাম পানাম সিটির উদ্দেশে।

রিকশা থেকে নেমেই চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। মনে হলো ভুল কোনো শতাব্দীতে ঢুকে পড়েছি। শুধু একটা মাত্র দালান হলেও কথা ছিল। কিন্তু এ যে চোখের সামনে পঞ্চদশ শতকের এক হারানো রাজ্য, চারশো বছরের পুরোনো পানামনগরী।

সোনারগাঁ লোক ও কারুশিল্প জাদুঘর থেকে মাত্র আধা কিলোমিটার দূরে এই পানামনগর, ঈশা খাঁর নগর। একসময় ছিল তাঁত ব্যবসায়ীদের আবাসস্থল, বাংলার মসলিন ঐতিহ্যের কেন্দ্রবিন্দু। ২০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে গড়ে ওঠা এই নগরী তৎকালীন কাছেপিঠের অন্য সব নগর থেকে ছিল বেশি আকর্ষণীয়। এখানে শুধু যে দালানকোঠা আছে, তা কিন্তু নয়। মসজিদ, মন্দির, কূপ, সরাইখানা, পঞ্চপীরের মাজার এমন আরো অনেক কিছু চোখে পড়বে পানামে এলে। বিকেলের আলোতে পুরোনো দালানগুলো যেন ঝলমলিয়ে ওঠে।

আমরা চার বন্ধু গিয়েছিলাম পানামনগরীতে। কথা বললাম ওখানকার কর্তব্যরত আনসার গার্ড মিরাজের সঙ্গে। উনি জানালেন, এই নগরীর পুরোটাই খাল দিয়ে বেষ্টিত যার নাম পঙ্খীরাজ খাল। এই খাল পূর্বদিকে মেনিখালী নদ হয়ে মেঘনা নদীতে এসে মিশেছে। নগরীর পূর্বে মেঘনা আর পশ্চিমে শীতলক্ষ্যা। এই পথেই বিলেত থেকে আসত বিলাতি থানকাপড় আর দেশ থেকে যেত মসলিন। আর আছে বিশাল সুরক্ষিত গেট যা সন্ধ্যা হলেই বন্ধ হয়ে যেত। এখনো সন্ধ্যার আগ পর্যন্তই এটা নগরী দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত থাকে।

পানামনগরীর বিভিন্ন দালানের নির্মাণশৈলীতেও ভিন্নতা লক্ষ করা যায়। ব্যবসায়ী আর জমিদারদের বসবাসের এই নগরীর প্রতিটি দালান অপূর্ব কারুকার্যমণ্ডিত। নগরীকে চিরে দুই ভাগ করে চলে যাওয়া পাঁচ মিটার প্রশস্ত ও ৬০০ মিটার দীর্ঘ একটি সড়কের দুই পাশে একতলা, দোতলা ও তিনতলা মিলিয়ে রয়েছে প্রায় ৫২টি ভবন। সড়কের উত্তর পাশে আছে ৩১টি ভবন এবং দক্ষিণ পাশে আছে ২১টি ভবন। ওয়ার্ল্ড মনুমেন্ট ফান্ড ২০০৬ সালে পানামনগরকে বিশ্বের ধ্বংসপ্রায় ১০০টি ঐতিহাসিক স্থাপনার তালিকায় স্থান দেয়।

ভবনগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় নির্দেশাবলি অনুযায়ী কোনোটারই ওপরে ওঠা নিষেধ। কিন্তু ঢুকেই হাতের ডান দিকের বিল্ডিংটা ভিআইপি আর বিদেশিদের জন্য উন্মুক্ত। বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করার জন্য এই অভিনব ব্যবস্থা। সঙ্গে বিদেশি থাকায় সুযোগ বুঝে ওপরে চলে গেলাম। উঁচু উঁচু সিঁড়ি পার হয়ে দোতলায় উঠে একটা বিশাল হলরুমে পৌঁছালাম। চারিদিকের দেয়ালে রঙিন কারুকার্য। পিলার তো বটেই, সিলিংয়েও। আমাদের গাইড জানালেন, এখানেই নাচের আসর বসত এককালে। পুরোনো শতাব্দীর সেই কথা মনে করে শিহরিত হচ্ছিলাম, নূপুরের আওয়াজ শুনছিলাম নিজের অজান্তেই।

কীভাবে যাবেন

ঢাকার গুলিস্তান থেকে বাসে করে যেতে পারেন। দোয়েল, বোরাক আর স্বদেশের বাস ছাড়ে সেখান থেকে। ভাড়া বাসভেদে ২৫-৪৫ টাকা। নামবেন সোনারগাঁয়ের মোগড়াপাড়া বাসস্ট্যান্ড। ওখান থেকে রিকশায় ১৫-২০ টাকা।

বাংলাদেশিদের জন্য টিকেট ৩০ টাকা, বিদেশিদের ক্ষেত্রে তা ১০০ টাকা।
দ্রষ্টব্য : পুরনো ভবনগুলোর বেশির ভাগই ঝুঁকিপূর্ণ। ‘ঝুঁকিপূর্ণ ভবন’ নির্দেশনা সংবলিত ভবনগুলোর ভেতরে প্রবেশ করবেন না। আর এসব স্থান আমাদের জাতীয় সম্পদ। কোনো প্রকার ক্ষয়ক্ষতি বা ময়লা-আবর্জনা ফেলে নোংরা করবেন না।

পরিশেষে একটা কথাই বলতে চাই, বাংলাদেশে থেকে পানামনগরীতে না গিয়ে থাকলে পুরোই মিস! কিউবার রাজধানী, সেই পুরোনো হাভানার সাদৃশ্য পাবেন অনেক। তাহলে আর দেরি কেন, সুযোগ বুঝে ঝটপট দেখে আসুন বাংলাদেশের ঐতিহ্য পানামনগরী।