বিলিয়ন স্টারের নিচে একটা রাত
থ্রি স্টার, ফাইভ স্টার হোটেলে তো অনেকই থাকলাম। এবার ইচ্ছা হলো বিলিয়ন স্টারের নিচে একটা রাত কাটাব। সে অনুযায়ী ফেসবুক গ্রুপ ভিজিট বাংলাদেশ-এর পক্ষ থেকে আড়াইহাজারের মেঘনার একটি চরে থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম। কয়েক দিনের মধ্যে ৪৫ জন ভ্রমণপ্রিয় মানুষ কনফার্ম করে ফেললেন আমাদের সঙ্গে যাওয়ার জন্য। এর মধ্যে তিন বছরের শিশু থেকে ৬৫ বছরের প্রবীণও আছে। আমাদের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলেন স্থানীয় শাহীনুর আড়াই হাজারী ও আশ্রাফুল ইসলাম ভাই।
নির্ধারিত দিনে সকাল ৭টার দিকে রিজার্ভ বাস নিয়ে রওনা দিলাম। কুড়িল ফ্লাইওভার পার হয়ে ৩০০ ফুট রাস্তা ধরে দুই ঘণ্টায় পৌঁছে গেলাম আড়াইহাজার। সেখানে পৌঁছেই শাহীনুর আড়াই হাজারী ভাইয়ের বাসায় হালকা নাশতা করলাম আর পুরোনো দু-একটি বাড়ি ঘুরে দেখলাম। এরপর আবার যাত্রা শুরু হলো বিষনন্দী ফেরিঘাটের উদ্দেশে। প্রায় ৪০ মিনিট পর পৌঁছালাম বিষনন্দী ফেরিঘাট। আমাদের সামনেই প্রমত্তা মেঘনা নদী। পানি সবে বাড়তে শুরু করেছে। আমরা গরুর দুধের চা খেয়ে আগে থেকে প্রস্তুত থাকা ট্রলারে চেপে বসলাম। ট্রলার মেঘনা নদী দিয়ে চলতে শুরু করল।
এখানে অনেকেই আগে এত বড় নদী দেখেনি। কিছুটা ভয় আর অনেকটা উত্তেজনা নিয়ে তারা নদী জার্নি উপভোগ করতে লাগল। প্রায় ৪০ মিনিট পর পৌঁছালাম নদীর মাঝে চৌদ্দের চর নামে একটি চরে। প্রায় দেড় কিলোমিটার লম্বা আর ৩০০ মিটারের মতো চওড়া এ চর। জোয়ারের সময় আয়তন আরো কমে যায়। আর বর্ষাকালে পুরোটাই চলে যায় পানির নিচে। চরে নেমেই অবাক হয়ে গেলাম এখানকার পরিবেশ দেখে। চরটা সবুজ ঘাসে আবৃত, পাড়গুলো সমুদ্র তীরের মতো বালুকাময়। ছোট ছোট ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে বেলাভূমিতে। যেন একদম স্বপ্নে দেখা একটা দ্বীপ। আমরা এর নামকরণ করলাম স্বপ্ন দ্বীপ। নদীর পানি ঘোলা থাকে, কিন্তু এখানে পানিও যথেষ্ট পরিষ্কার। আমাদের মধ্যে কজন ট্রলার থেকে নেমে ব্যাগ রেখেই পানিতে ঝাঁপ দিলেন।
কিন্তু আমাদের ঝাঁপ দিলে হবে না। কিছু প্রাথমিক কাজ আছে। প্রথমে কয়েকটি বাঁশ গেড়ে একটি শামিয়ানা টানিয়ে নিলাম রোদে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য। একটি অস্থায়ী টয়লেটও বানিয়ে নিলাম। এর পর যে কজন তাঁবু এনেছিলাম, তারা তা খাটিয়ে নিলাম। দুপুরে রান্নার ব্যবস্থা করেছিলাম ফেরিঘাটের একটি রেস্টুরেন্টে। দুপুর প্রায় হয়ে এলো। খাবার রেডি করে যে-ই না বিতরণ করতে গেলাম, অমনি এক অদ্ভুত সমস্যায় পড়তে হলো। কেউই আর মাটিতে নেই। সবাই পানিতে নেমে গেছে। মেঘনার পরিচ্ছন্ন শীতল পানি দেখে লোভ সামলাতে পারেনি তারা। কী আর করা, আমরা প্লেটে খাবার সাজিয়ে নদীর মাঝে দাপাদাপি করা মানুষগুলোর কাছে খাবার পৌঁছে দিলাম। কেউ নদীর পানিতে বসে, কেউ বা শুয়ে খাবার খেতে লাগল। সে এক দেখার মতো দৃশ্য।
খাওয়ার পর আমরা কজনও নেমে পড়লাম। পানি আসলেই শীতল। মাথার ওপরে গনগনে সূর্যের তাপ উপেক্ষা করে মেঘনার পানি তার শীতলতা বজায় রেখেছে। আমরা শীতল সে জলে নিজেদের সঁপে দিলাম। সাঁতার প্রতিযোগিতা, পানি ছোটাছুটি খেলা, ডুব দিয়ে বসে থাকা—সবই চলতে থাকল। এভাবে ঘণ্টা তিনেক থাকলাম নদীতে। অন্যরা আরো থাকতে চাইলেও আমাদের উপায় নেই। রাতের রান্নার আয়োজন করতে হবে। ট্রলার নিয়ে চলে গেলাম খাগকান্দা বাজারে। সেখান থেকে চাল, ডাল, লাকরি, মসলা আর প্রয়োজনীয় সব জিনিস কিনলাম। সঙ্গে বার-বি-কিউর অন্যান্য জিনিসপত্র। ট্রলারে ওঠার সময় দেখি, এক জেলে বিশাল এক রুই মাছ ধরে নিয়ে আসছে মেঘনা নদী থেকে। প্রায় ছয় কেজি ওজনের জীবিত মাছটি দেখে সবাই হৈচৈ করে উঠল। একে তো বড় মাছ তার ওপর মেঘনা নদীর। অনেক দামাদামি করে এক হাজার ৬০০ টাকায় কিনে ফেললাম। এর পর কাটালাম স্থানীয় একটি দোকানে নিয়ে। এবার ফিরে চলা চৌদ্দের চরে।
চরে ফিরতে ফিরতে রাত ৮টা বেজে গেল। এবার রান্না করার পালা। আশ্রাফ ভাই তাঁর গ্রিল করার চুলাটা নিয়ে এসেছিলেন। সেটাতেই লাকরি ঠেসে দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দিলাম। প্রথমেই ভাত, ডাল আর মাছ ভুনা করে ফেললাম। এর পর শুরু হলো চিকেন গ্রিল করা। রাত সাড়ে ১১টার দিকে সব খাবার প্রস্তুত হয়ে গেল। সবাই লাইন ধরে প্লেটে করে খাবার নিয়ে নিলাম। আধো অন্ধকারের লাকরির চুলায় রান্না করা সেসব খাবারের স্বাদ ছিল অসাধারণ, বিশেষ করে রুই মাছটার কথা মনে থাকবে অনেক দিন। সবচেয়ে বড় কথা, এমন একটা পরিবেশে বসে খাওয়াটার অভিজ্ঞতাও ছিল অসাধারণ।
খাবার পালা শেষ, এবার আকাশটার দিকে তাকানোর ফুরসত হলো। মেঘমুক্ত আকাশে লক্ষ তারার ঝিকমিকি। কাছাকাছি কোনো আলোর শহর না থাকার কারণে তারাগুলোর উজ্জ্বলতা যেন কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছিল। আমরা ঘাসে শুয়ে বসে তারকারাজির সৌন্দর্য উপভোগ করতে লাগলাম। মাঝে আড়াইহাজারের ওসি সাহেব ফোর্স পাঠালেন কজন। তাঁরা দেখে গেলেন ঠিক আছি কি না, আর প্রয়োজনে ফোন করতে বললেন। আমাদের যাঁরা টেন্ট এনেছিলেন, তাঁরা ঘোষণা দিলেন এমন বিলিয়ন স্টারের নিচে টেন্টে থাকা পাপ। তাঁরা থাকবেন খোলা আকাশের নিচে সবুজ ঘাসে চাদর বিছিয়ে। তাই টেন্টগুলোতে বাচ্চাদের শুইয়ে দেওয়া হলো। আর আমরা কেউ বা স্লিপিং ব্যাগ, কেউ বা চাদর বিছিয়ে শুয়ে পড়লাম। আবার শুরু হলো গান। কোরার এককে চলতে লাগল হাসন রাজা, রবীন্দ্র, লালন শাহ আর আবদুল করিমের গান। সুর হয়তো ঠিক নেই, তবে আন্তরিকতা আর পরিবেশের কারণে সে গানও অনেক মধুর মনে হলো। পাশেই নদীতে মাঝিরা মাছ ধরছেন আর আমাদের লাইট জ্বালিয়ে দেখে যাচ্ছেন একবার করে। এভাবে চলল রাত ৩টা পর্যন্ত।
রাত সাড়ে ৩টার দিকে শুতে গেলাম। কেউ ঘাসের ওপর, কেউ বা চলে গেলাম নৌকার ছাদে। তারা দেখতে দেখতে কখন যে ঘুমিয়ে গেলাম, তার ঠিক নেই। ঘুম ভাঙল সুয্যি মামার স্পর্শে। হাত-মুখ ধুয়ে সবাই রেডি হয়ে গেলাম ফেরার জন্য। এর আগে পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালালাম। কাল রাতের সব আবর্জনা এক করে পুরো চর পরিষ্কার করে ফেললাম। ৮টার দিকে আবার রওনা দিলাম ফেরিঘাটে। সেখানে নেমে নাশতা করে বাসে উঠলাম ঢাকার উদ্দেশে। সঙ্গে স্মৃতি নিয়ে এলাম সারাজীবন মনে করার মতো একটি অসাধারণ রাতের।
কীভাবে যাবেন
নানাভাবে যাওয়া যায়। ঢাকার সায়েদাবাদ থেকে অভিলাশ পরিবহনের গাড়ি যায় বিষনন্দী ফেরিঘাটে। ভাড়া নেবে ৭৫ টাকা, সময় লাগবে দুই ঘণ্টার মতো। এ ছাড়া কলাবাগান থেকে মেঘলা পরিবহনে উঠে ভুলতা নেমে যাবেন। এর পর রাস্তা পার হয়ে সিএনজিতে করে আড়াইহাজার। ভাড়া ৩০ টাকা। আড়াইহাজার থেকে বিষনন্দী ফেরিঘাট শেয়ারড সিএনজিতে ৪০ টাকা। পূর্বাচল যাওয়ার ৩০০ ফুট রাস্তা দিয়ে শেয়ারড কারেও যাওয়া যায় ভুলতা। ভাড়া জনপ্রতি ৮০ টাকা। এর পর সিএনজিতে। এর পর ট্রলারে চৌদ্দের চর। সারা দিনের জন্য ভাড়া নেবে দুই হাজার টাকার মতো।
সতর্কতা
সঙ্গে অবশ্যই লাইফ জ্যাকেট নিয়ে যাবেন। রাতে থাকতে চাইলে স্থানীয় প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে নেবেন।
আরেকটি কথা। চরে কোনো প্রকার ময়লা ফেলে আসবেন না। সব ময়লা একটি ব্যাগে ভরে ফেরিঘাটে এনে ডাস্টবিনে ফেলে দেবেন।