শিকাগোর চিঠি
নাম তার ‘বাতাসের শহর’
শিকাগোর ও'হারা ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে এমিরেটসের বোয়িং-এর দরজা দিয়ে বের হতেই হিমেল হাওয়ায় শরীর কেঁপে উঠল। ঢাকায় বসে জানতে চেয়েছিলাম ঠান্ডা কেমন? ওরা বলেছিল- না, চাচা ঠান্ডা নেই। সামার চলে আসছে। ওদের ঠান্ডা নেই মানেই আমার হাচ্চো। আজকের টেম্পারেচার ৯ ডিগ্রি, আমাদের দেশের চরম শীত। গরম কাপড় আনিনি, ভোগাবে মনে হয়।
ইমিগ্রেশনের লম্বা লাইনে দাঁড়ালাম। আমেরিকান ইমিগ্রেশনের নানা ভীতিকর গল্প শুনেছি, বিশেষ করে ৯/১১-এর পর। আর আমার নামের শেষে আছে ‘খান’। তাই নানা অপমানকর প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত হলাম। তবে তেমন কিছুই হলো না। খান বলে একবার তাকাল। আমি হেসে বলি আমি গুড খান। ইমিগ্রেশন অফিসার ভিসার পাতাটা একটা মেশিনে ধরে, হাতের ছাপ নিয়ে ছয় মাস থাকার সিল মেরে দিলেন।
সন্ধ্যা প্রায় হয়ে এসেছে। ভাতিজা আকাশ নিতে এসেছে স্বপরিবারে। আমরা শহরতলি স্কুকির পথ ধরলাম। শিকাগোবাসী সারা দিন ব্যস্ত শহরে শশব্যস্ত সময় কাটায় কিন্তু রাতের বেলায় শহরতলির নীরব-নিভৃত বাড়িতে থাকতে পছন্দ করে। ওরা বলে সাবার্ব। আকাশদের বাসাও এমনই এক সুন্দর ছিমছাম এলাকায়। ছবিতে অনেকবার দেখেছি। প্রশস্ত রাস্তা ধরে ছুটে চলেছি অনেকটা অস্বস্তি নিয়ে। কারণ গাড়ি চলছে রাস্তার বাঁ দিক দিয়ে যাতে মোটেও অভ্যস্ত নই আমরা।
শিকাগো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শহরগুলোর মধ্যে তৃতীয় বৃহত্তম শহর। ইলিনয় অঙ্গরাজ্যে অবস্থিত শহরটি অফিশিয়ালি প্রতিষ্ঠিত হয় ৪ মার্চ ১৮৩৭ সালে। শিকাগোর অন্য নাম Windy city বা বাতাসের শহর। শিকাগো শহরটি সৌম্য আর আভিজাত্যে মিশেল একটি শহর। এখানে অনেক সুউচ্চ ভবন কিন্তু কনক্রিটের জঞ্জাল বলা যাবে না মোটেও। শিল্প সাহিত্যে অনন্য এক শহর।
মিনিট তিরিশেক লাগল পৌঁছাতে বাসায়। হাত-মুখ ধুয়েই খাবার টেবিলে চলে এলাম। পুরো বাঙালি খাবার। শোল মাছ, গরুর মাংস, লালশাক আর আম ডাল। নাহ, লেখা পরে হবে। আগে খেয়ে নেই।
আগেই বলেছি আমেরিকার অন্য অনেক শহরের মতো শিকাগোর বাসিন্দারাও থাকার জন্য নিরিবিলি কোনো এলাকা বেছে নেয় যেগুলোকে সাবার্ব বলে। যারা হৈ হুল্লোড় এভয়েড করে নীরবে-নিভৃতে থাকতে চায় তাদের জন্য এ সাবার্ব। এসব জায়গার বাড়িগুলো হয় আলাদা, সামনে-পেছনে জায়গা থাকে। এ ছাড়া এসব এলাকায় স্কুলগুলোর গ্রেডিংও ভালো থাকে ডাউনটাউনের স্কুলগুলো থেকে। এসব কারণে সাবার্ব-এ বাড়ির দাম বা ভাড়া ডাউনটাউন বা মূল শহর থেকে একটু বেশি হয়।
আমি যে এলাকায় উঠেছি সেটার নাম স্কুকি ভিলেজ। ভারতের মৌলনং নাকি পৃথিবীর সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন গ্রাম। তো সেটা যদি ১০-এ ৬ পায়, স্কুকি পাবে ১০-এ ১০। এতটাই পরিচ্ছন্ন চারদিকটা। ময়লা-আবর্জনা বাইরে ফেলার জো নেই, ক্যামেরা দেওয়া আছে চারদিকে জরিমানা করে দেবে। বাইরে কোনো গাছ কাটা বা নষ্ট করলেও একই অবস্থা। এমনকি নিজের বাসায় কোনো কনস্ট্রাকশন কাজ করতে হলেও কর্তৃপক্ষের অনুমতি লাগবে। তারা এসে দেখে যদি অনুমতি দেয় তবেই কাজ করা যাবে।
রাতে গেলাম ওয়ালমার্টে। বিশাল সুপার স্টোর। বাড়ির নিত্যব্যবহার্য সব জিনিস পাওয়া যায়। আমার নজর অন্যদিকে। আমি সোজা চলে এলাম গার্মেন্টস আইটেম সেকশনে। যা খুঁজছি, একনজরেই চোখে পড়ল। Made in Bangladesh লেখা অনেক জামাকাপড় দেখলাম। একটা জামা কদিন আগে আমার ছোট বাবুটার জন্য কিনেছি বসুন্ধরা থেকে। দাম নিয়েছিল ৬০০ টাকা। এখানে সেটার দাম আট ডলার, মানে ৬৪০ টাকা।
অন্যান্য জিনিসের দামও বেশ কম। তবে দেশে বসে এদের অনেক সুনাম শুনেছি কিন্তু এখানে শুনলাম ওয়ালমার্ট থেকে কিছু কাপড় কিনলে দুবার ধোয়ার পর নাকি নষ্ট হয়ে যায়। এ জন্য আমার ভাতিজারা ওয়ালমার্ট থেকে কাপড়চোপড় কেনে না। আজ সকালে ঘুম ভাঙে ৭টার সময়। মুখ ধুয়ে হাঁটতে বের হয়ে যাই। এত ভোরেও ব্যস্ত রাস্তাঘাট। এত গাড়ি কিন্তু শো শো শব্দ ছাড়া হর্নের কোনো শব্দ নেই। শিকাগো নামার পর থেকে গাড়ির হর্ন শুনিনি। এরা অকারণে হর্ন বাজায় না। রাস্তা পার হব, দেখলাম রাস্তার পাশে একটা সুইচ দেওয়া আছে। ওটায় চাপ দিলাম। একটু পরই গাড়ি থেমে গেল আর আমাকে রাস্তা পার হওর সবুজ আলোর সংকেত দিল। রাস্তা পার হতেই হাতের ডানে পেলাম ন্যাচারাল পার্ক। বিশাল এলাকাজুড়ে বড় বড় গাছপালা। মানুষজন নেই। একটু ঘুরেফিরে এলাম বাসায়। নাশতায় বানানো হলো পরাটা, সবজি, ডিম ভাজি আর নানা ফলমূল।
দুপুরে খাবার পর হালকা ঘুম দিলাম। এরপর উঠে চামেলি আর ওদের মেয়ে পৃথাকে নিয়ে চলে গেলাম চামেলির ভাইয়ের বাসায়। ওদের তিন ভাইই শিকাগো থাকে। মেজো ভাই মানে আনিস চাচার বউও কাল এয়ারপোর্ট গিয়েছিলেন আমাকে আনতে। তখন থেকেই চাচা বাসায় যাওয়ার জন্য বলে আসছেন ফোনে।
বাসা শিকাগোর ডেভোন এলাকায়। জায়গাটায় ভারতীয়দের রাজত্ব। দোকানপাটে ভারতীয় জিনিস ভর্তি। মালিকও ভারতীয়। দু-তিনটি বাংলাদেশি মালিকানার দোকানও দেখলাম। সেখানে নানা বাংলাদেশি জিনিস পাওয়া যায়। একটা পটেটো ক্রেকারসের দাম ৯৯ সেন্ট বা প্রায় ৮০ টাকা। যাওয়ার পথে লেক মিশিগানে একটা ঢু মেরে গেলাম। বিশাল নীল জলের হ্রদ। কাল যাব শিকাগো ডাউনটাউনে।