জয় করুন কেওক্রাডং

Looks like you've blocked notifications!

বাংলাদেশের ভ্রমণপিয়াসী মানুষের কাছে বান্দরবান এক প্রিয় নাম। দেশি-বিদেশি পর্যটকে সব সময় সরগরম এই এলাকা। কিন্তু এখানে ট্যুর প্ল্যান করলে সবার আগে মাথা ধরে যায় কোথায় যাব সেটা ভাবতে ভাবতে। শহরের পাশে নীলগিরি, নীলাচল, স্বর্ণ মন্দির, চিম্বুক পাহাড় আর মেঘলা জায়গাগুলো বেশ জনপ্রিয় পর্যটকদের কাছে। কি পরিবার কি বন্ধুবান্ধব, সবাইকে নিয়ে ঘোরার জন্য দারুণ জায়গা। চাইলেই চট করে একটা গাড়ি নিয়ে সবাই মিলে ঘুরে আসা যায়। তবে অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমী হলে আপনার যেতে হবে বান্দরবানের গহিনে, তাহলেই মিলবে ট্র্যাকিংয়ের রোমাঞ্চ। বাংলাদেশের ট্র্যাকারদের জন্য সবচেয়ে জনপ্রিয় রুটটি হচ্ছে বগা লেক-কেওক্রাডং-জাদিপাই। দু-তিন দিন হাতে সময় নিয়ে অসম্ভব সুন্দর কিছু মুহূর্ত আর দুর্দান্ত রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা নিয়ে আসতে পারবেন, গ্যারান্টি দিচ্ছি। সাথে চাইলে জিতে আসতে পারবেন বাংলাদেশের পঞ্চম উচ্চতম (উইকিপিডিয়া) পাহাড়চূড়া। একদম শুরু থেকে শেষপর্যন্ত কীভাবে কী করবেন, তার বিশদ বিবরণ জেনে নিন। 

যানবাহনের খোঁজখবর
বান্দরবানে বছরের যেকোনো সময়ই যাওয়া যায়। তবে বর্ষা আর শীতকালকেই বেশির ভাগ মানুষ বেছে নেন। গরমকালে পাহাড়ে ওঠাটা একটু কষ্টই বটে। পাহাড়ে উঠতে হলে কোনোভাবেই সাহস হারালে চলবে না। কিশোর থেকে বুড়ো কিংবা পাতলা থেকে বেজায় মোটা মানুষও জয় করেছে কেওক্রাডং। শরীরের সক্ষমতার চেয়ে মানসিক দৃঢ়তাই বেশি দরকারি। তাই নিজেকে প্রস্তুত করে নিন এই অভিযানের জন্য।

ঢাকা থেকে বান্দরবান যেতে চাইলে বাস এবং ট্রেন, দুভাবেই যাওয়া যায়। তবে সরাসরি যেতে চাইলে যেতে হবে বাসে। বিভিন্ন কোম্পানির বাস আছে, যেগুলো বিভিন্ন সময় ঢাকা ছেড়ে যায় বান্দরবানের উদ্দেশে। কল্যাণপুর কিংবা আরামবাগ থেকে বাসে উঠতে হবে। টিকিট করতে হবে অন্তত একদিন আগে। আর যদি কোনো কারণে বান্দরবানের টিকিট না পান, তাহলে যেতে হবে চট্টগ্রাম হয়ে। প্রথমে চট্টগ্রামে পৌঁছে যেতে হবে বহদ্দারহাট বাসস্ট্যান্ডে। সেখান থেকে ধরতে হবে বান্দরবানের বাস। ট্রেনে করে গেলেও প্রথমে চট্টগ্রামে নেমে বাস ধরতে হবে। ঢাকা থেকে বান্দরবানের নন এসি বাসের টিকিট মূল্য ৬২০ টাকা। এসি বাসে গেলে গুনতে হবে কমপক্ষে ৯০০ টাকা। আর ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম গেলে ভাড়া ৪৮০ টাকা নন এসি, এসি ৮০০ থেকে শুরু।

ট্রেন ভাড়া শোভন চেয়ার ৩২০ টাকা। চট্টগ্রাম থেকে বান্দরবানের বাস আছে দুটি। পূর্বাণী এবং পূরবী নামক বাস দুটিতে এসি খুঁজে লাভ নেই। নন এসি বাস দুটির ভাড়া ১০০ করে।

হোটেলে রাত্রিযাপন
ঢাকা থেকে রাতে রওনা দেওয়া ভালো। কারণ ভোরে যাতে বান্দরবান শহরে পৌঁছে দিনে দিনে শুরু করতে পারেন পরবর্তী যাত্রা। আবার শহরে একদিন কাটিয়ে পরদিন থেকে শুরু করতে পারেন। যদি শহরে একদিন কাটাতেই চান তবে উঠতে হবে একটি হোটেলে। তবে হ্যাঁ! এর আগে করে নেবেন ফিরতি টিকিট। টিকিট করে খুঁজতে বের হন হোটেল। বলে রাখা ভালো, শহরের হোটেলগুলোর অবস্থা তেমন সুবিধের নয়! মোটামুটি মানের যে কোনো একটি হোটেলে উঠে যান। হোটেলের রুম ভাড়ায় ঋতুভেদে একেক রকম। সিঙ্গেল বেড ৩০০ থেকে শুরু করে এক হাজার টাকা পর্যন্ত আছে। ডাবল বেড ৫০০ থেকে আছে হাজার দুয়েক টাকা পর্যন্ত। তবে হোটেল ম্যানেজারের কাছে আকাশচুম্বী ভাড়া শুনে ভয় পাবেন না। দরদাম করার সব কৌশল কাজে লাগান। 

অ্যাডভেঞ্চার ভালোবাসেন তো!
শহরে খাবার-দাবারের মানও তেমন ভালো না। তবে তাজিনডং ক্যাফে সম্প্রতি বেশ সুনাম কুড়িয়েছে এই শিল্পে। ওখানে যাওয়ার আগে অবশ্য পকেটটাও ভারী করে যাবেন। যদি ইচ্ছা এবং সময় থাকে, তাহলে শহরের পাশে স্বর্ণ মন্দির, নীলাচল কিংবা মেঘলা ঘুরে আসতে পারেন। সে ক্ষেত্রে চলাচলের জন্য ব্যবহার করতে হবে সিএনজি অথবা চান্দের গাড়ি। একেবারে রিজার্ভ করে নিলে ভালো। চালকের সাথে কয়টি জায়গা যাবেন সেটি ঠিক করে নিলে সে ভাড়া হাঁকবে। সাধারণত সিএনজির ক্ষেত্রে হাজার থেকে এক হাজার ৫০০-এর মতো লাগে। আর চান্দের গাড়ির ভাড়া লাগবে তিন হাজারের মতো কিংবা এর বেশি। তবে এখানেও দরদাম করে নিতে হবে। বান্দরবান শহরে দরদাম না করতে জানলে আপনার পকেট থেকে টাকা বের করার মানুষের অভাব হবে না।

এবার আসা যাক মূল অ্যাডভেঞ্চারে। বগা লেক যেতে আপনাকে সবার আগে পৌঁছাতে হবে রুমায়। বান্দরবান শহরের যেকোনো জায়গা থেকে একটি অটো কিংবা সিএনজি নিয়ে যান রুমার বাসস্ট্যান্ডে। চালককে বললেই সে আপনাকে পৌঁছে দেবে। সেখানে গিয়ে বাস ধরতে হবে রুমার। দুপুর পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে বাস রুমার উদ্দেশে রওনা হয়। গিয়েই আপনার যাত্রা সময় ঠিক করে নিন। লোকাল সার্ভিসে বাস চলে। সিট খালি না থাকলে আপনাকে জোর করে বাসের ছাদে উঠিয়ে দিতে চাইবে বাসের লোকজন। তবে বাসের ছাদের জার্নিটাও খারাপ না। কিন্তু ঝুঁকি না নিতে চাইলে অপেক্ষা করুন পরের বাসের জন্য। বাসের ভাড়া ১০০ টাকা। আঁকাবাঁকা আর উঁচুনিচু পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে আপনি এগোতে থাকবেন রুমার উদ্দেশে। এই যাত্রাকে আরামদায়ক করতে চাইলে একটি জিপ রিজার্ভ নিতে পারেন। তবে সে ক্ষেত্রে আপনাকে প্রায় চার হাজার টাকা গুনতে হবে। 

রুমায় নেমে পড়ুন। এবার যেতে হবে রুমা বাজার। সে ক্ষেত্রে লোকাল চান্দের গাড়ি ছাড়া উপায় নেই। জনপ্রতি ৩০ টাকা ভাড়ার বিনিময়ে আপনাকে পৌঁছাতে হবে রুমা বাজারে। বাজারে এসে সবার আগে ঠিক করতে হবে গাইড। গাইডের বেশ কয়েকটি সমিতি আছে। যেকোনো একটা থেকে বেছে নিন। গাইডের ভাড়া এক হাজার টাকা থেকে শুরু। ঋতুভেদে আরো বাড়বে-কমবে। তবে ভালো হয় আগে থেকে কোনো গাইডের সাথে কথা বলে গেলে। গাইডের সাথে আর্মি ক্যাম্পে গিয়ে নাম অ্যান্ট্রি করে ফেলুন। মনে রাখবেন, আপনার যাত্রার জায়গায় জায়গায় গাইডসহ ট্যুর টিমের সবার নাম অ্যান্ট্রি করতে হবে। কখনোই এটি ফাঁকি দিতে যাবেন না, কারণ এটি আপনাদের ভালোর জন্য করা হচ্ছে। নাম অ্যান্ট্রি শেষে বাজার থেকে কিছু শুকনো খাবার কিনে নিতে পারেন। আর ট্র্যাকিংয়ের জন্য স্যান্ডেল কিনতে পারেন। দোকানে গিয়ে পাহাড়ে ওঠার জন্য ভালো স্যান্ডেল বললেই তারা বের করে দেবে আপনাকে। 

এবার যাত্রা কমলা বাজারের উদ্দেশে। সেখান থেকে ট্র্যাকিং করে যেতে হবে বগা লেক। কমলা বাজার পর্যন্ত যেতে লাগবে চান্দের গাড়ি। সেটি আপনার গাইডই ঠিক করে দেবে। চান্দের গাড়ি ভাড়া দেবে আড়াই হাজার টাকা। যদি আপনার দল ছোট থাকে, তাহলে অন্য কোনো দলের সাথে মিশে ১০-১২ জন হয়ে যান। তারপর চান্দের গাড়ি ভাড়া করুন। এটি করতে পারলে ভাড়ার বেশ টাকা আপনার বেঁচে যাবে। প্রায় দুই ঘণ্টার ঝাঁকি আর ধুলামিশ্রিত যাত্রা শেষে আপনি পৌঁছাবেন কমলা বাজার। সেখান থেকে ১০ টাকা করে লাঠি কিনে নিন। লাঠি পরবর্তীতে অনেক কাজে লাগবে আপনার। আর ব্যাগে গ্লুকোজ কিংবা স্যালাইন মিশ্রিত পানির বোতল রাখুন। 

এবার শুরু করুন পাহাড়ে ওঠা! বগা লেক ওঠার পথটা বেশ খাঁড়া। তাই হয়তো অল্প কিছুক্ষণের মাঝে হাঁপিয়ে উঠতে পারেন। কিন্তু দমে গেলে চলবে না। একটু একটু করে বিশ্রাম নিয়ে আর পানির বোতল খুলে মুখ ভিজিয়ে আবার হাঁটা শুরু করুন। ভুলেও পানি খেয়ে পেট ভারী করবেন না। পেট ভারী হলে আর হাঁটতে পারবেন না স্বাচ্ছন্দ্যে। আর মুখ হাঁ করে নিশ্বাস নেবেন না। এতে ফুসফুস আরো দুর্বল হয়ে যায়। পারলে নাক দিয়ে নিশ্বাস নিয়ে মুখ দিয়ে ছাড়বেন। বড় বড় ট্র্যাকাররা এটি করতেই উপদেশ দেয়। আধাঘণ্টা ট্র্যাকিং শেষে পৌঁছে যাবেন বগা লেক। ক্লান্তিভরা চোখ এবার জুড়িয়ে যাবে। আর জুড়াবে না-ই বা কেন! সমুদ্র থেকে প্রায় এক হাজার ৭০০ ফুট ওপরে পাহাড়ের চূড়ায় ১৫ একর জায়গার এ রকম লেক আর কোথায় মিলবে বলুন? এই লেকটি তৈরি হয়েছিল একটি মৃত আগ্নেয়গিরি পানি চুয়ে চুয়ে। তাই একে ড্রাগন লেকও বলা হয়ে থাকে। আর এখন পাহাড়চূড়ার এই নীল আস্তর আকাশের সাথে মিশে তৈরি করেছে এক অপরূপ প্রাকৃতিক ছবি। 

বগায় পৌঁছে আর্মির ক্যাম্পে রিপোর্ট শেষে উঠে পড়ুন সিয়াম দিদি, লারাম কিংবা অন্য কারো কটেজে। ওনাদেরকে আপনার খুঁজে বের করতে হবে না। আপনার গাইডই দেখবেন সব রেডি করে ফেলবে। কটেজে ব্যাগগুলো রেখে ঝুপঝাপ লাফিয়ে পড়ুন লেকের পানিতে। স্বচ্ছ আর ঠাণ্ডা পানি দেখবেন কী করে ধুয়েমুছে রেখে দেয় আপনার কয়েক ঘণ্টার ক্লান্তি! কটেজে ফিরে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে বিশ্রাম নিন। চাইলে আজকেই আপনি কেওক্রাডংয়ের উদ্দেশে রওনা হতে পারেন। তবে বগা লেকের রাতের সৌন্দর্য দেখতে থেকে যান এক রাত। যদি সেদিন আবার পূর্ণিমা হয়, তবে আপনার মতো ভাগ্যবান কম আছে। চাঁদের আলোতে বগা লেকের সৌন্দর্য বর্ণনা করার মতো ক্ষমতা কারো নেই। 

ও একটা কথা, কটেজ ভাড়া হচ্ছে জনপ্রতি ১০০ টাকা করে। আর প্রতি বেলা খেতেও আপনাকে দিতে হবে ১০০ টাকা। খাবার বলতে মোটা চালের ভাত, ডিম ভাজি, আলু ভর্তা, সবজি, ডাল, সালাদ আর ছোট ছোট পোড়া মরিচ। এই খাবারের মতো অমৃত আপনি হাজার টাকা খরচ করেও অনেক জায়গায় পাবেন না। আপনার গাইডের থাকা এবং খাওয়ার খরচও কিন্তু আপনার। এটা ভুলে যাবেন না।

পরদিন ঘুম থেকে উঠুন অনেক সকালে। পারলে সূর্য ওঠার আগেই। ঘুম থেকে উঠে খিচুড়ি আর ডিম ভাজি খেয়ে নিন। আর যদি খিচুড়ি খেতে ভালো না লাগে তাহলে বিস্কুট-কলা খেয়ে নিন। তবে ভুলেও পেট খালি রাখবেন না। কারণ এখনই শুরু হতে যাচ্ছে আপনার কেওক্রাডং জয়ের যাত্রা। যাওয়ার সময় ভারী জিনিস সব কটেজে রেখে যাত্রা শুরু করুন। অনেকে বগা লেক উঠতে গিয়ে এত হাঁপিয়ে উঠে যে কেওক্রাডংয়ের পথের দিকে আর পা বাড়ায় না। কিন্তু তা করবেন না। ট্র্যাকিংয়ের প্রথমদিন সবারই কষ্ট হয়। পরদিন দেখবেন অনেকটা সাবলীল হয়ে আসছে সবকিছু। এবারও ঠিক আগের মতো হাঁটতে থাকুন। মাঝের কিছু খাঁড়া পথ ছাড়া বেশি একটা কষ্ট হবে না। মাঝে মাঝে একটু বিশ্রাম নিন। আবার হাঁটা শুরু করুন। যাত্রীছাউনিতে কিছু খেয়ে নিন। 

মাঝে চিংড়ি ঝরনা পড়বে। ওটার ওপরে গিয়ে দেখে আসুন ঝরনার আসল রূপ। ঝরনার মিষ্টি পানিও খেয়ে দেখুন একটু। আরো কিছু ঝরনা পড়বে মাঝে। যদি সময় এবং ধৈর্য্য থাকে, সবই পরখ করে নিতে পারেন। দুই ঘণ্টা পর এসে পৌঁছাবেন দার্জিলিংপাড়া। এ পাড়ায় দার্জিলিংয়ের মতো ঠাণ্ডা দেখে এমন নামকরণ। গ্রামটি এমনিতে অনেক সুন্দর। এখানে কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে শুরু করুন কেওক্রাডংয়ের উদ্দেশে শেষ যাত্রা। আরো প্রায় আধা ঘণ্টা ট্রেকিং শেষে আপনি পা রাখবেন কেওক্রাডংয়ে। ছোটবেলায় সাধারণ জ্ঞানের বইয়ে লেখা দেশের সর্বোচ্চ চূড়া! এখন সে লিস্টে পাঁচ নম্বরে থাকলেও এর রূপ তো আর ক্ষয়ে যায়নি! কেওক্রাডং নামটি এসেছে মারমা ভাষা থেকে। মারমা ভাষায় ‘কেও’ মানে পাথর, ‘ক্রা’ মানে পাহাড় আর এবং ‘ডং’ মানে সবচেয়ে উঁচু। অর্থাৎ কেওক্রাডং মানে সবচেয়ে উঁচু পাথরের পাহাড়। কেওক্রাডংয়ে পা রাখাটা হতে পারে আপনার জীবনের অন্যতম সেরা একটি মুহূর্ত। আশপাশে যা দেখবেন, সবকিছু আপনার পায়ের অনেক নিচে। যে দার্জিলিংপাড়া পাড়ি দিয়ে এলেন, সেটিকেও দেখবেন কত ছোট দেখাচ্ছে এখান থেকে। ইচ্ছামতো লাফালাফি আর ছবি তুলে নিন। যদি কেওক্রাডংয়ে রাত কাটানোর ইচ্ছে থাকে, তাহলে দুপুরে খাওয়ার অর্ডার এবং রাতে কটেজে বুকিং দিয়ে ফেলুন। অনেকে একই দিনে আবার বগাতেই ফিরে যায়। কিন্তু কেওক্রাডংয়ে রাত কাটানোর মতো লোভনীয় সুযোগ আর হবে না। আর বান্দরবানের প্রতিটি জায়গারই দুটি রূপ আছে। একটি সূর্যের আলোতে এবং অপরটি রাতে। দিনে গিয়ে দিনে ফিরে আসার পরিকল্পনা না করে প্রকৃতির এই লীলাখেলা ষোলোআনা ভোগ করে আসুন। তাই এখানে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্তটি উত্তম হবে। লালার কটেজে জনপ্রতি থাকার খরচ ১০০ টাকা আর খাবার ১২০ টাকা করে। 

শেষ গন্তব্য জাদিপাই ঝরনা
লালার কটেজে বুকিং শেষ করে আবার যাত্রা করুন। এবার আপনার শেষ লক্ষ্য জাদিপাই ঝরনা। এবার পালা শুধু নামা আর নামা! এই রাস্তাটির ব্যাপারে অনেক ধরনের কথা প্রচলিত আছে। কেউ বলবে জাদিপাই জয় করা তেমন কোনো ব্যাপারই না। আবার কেউ কেউ শোনাবে তাদের আধমরা হয়ে যাওয়ার ঘটনা। সারা দিন ট্রেকিং করার কারণে আসলেই একটু ক্লান্তি এবং দুর্বল লাগে জাদিপাই নামতে গিয়ে। তবে জয় করা খুব একটা কঠিন না। প্রথমে পাসিংপাড়া এবং এরপর জাদিপাইপাড়া পাড়ি দিয়ে মোট দুই ঘণ্টার মতো লাগবে আপনার জাদিপাই ঝরনা পৌঁছাতে। পথে বেশ দূর থেকেই ঝরনার আওয়াজ শুনতে পাবেন। এসে পড়েছি ভেবে মন ভালো করার কিছু নেই। কারণ আরো অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে সামনে। তবে শেষে ২০০ মিটার রাস্তা প্রচণ্ড ভয়ানক। রাস্তা খুব একটা ভালো না এবং প্রচুর খাড়া। মাটি এবং আশপাশে লতাপাতার সাহায্য নিয়ে নিচে নামতে থাকুন। ঝরনার কাছে এসে আপনার মনটাই ভালো হয়ে যাবে। বান্দরবানের প্রতিটি জায়গার বড় বৈশিষ্ট্য এটি। প্রচণ্ড কষ্ট হলেও কিছু জয় করার পর মন একদম ভরে যায়। দেশের অনেক ট্র্যাকার তাঁদের জীবনে দেখা সেরা ঝরনার নাম বলেন জাদিপাই। এবার আপনিও তার সত্যতা খুঁজে পাবেন। দুটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য বলা যায়। এক, ঝরনাটি বিশাল এবং প্রশস্ত। যদি বর্ষায় আসেন তবে ঝরনার আসল তেজ দেখতে পাবেন। দ্বিতীয়টি হচ্ছে ঝরনার নেমে আসা পানিতে দেখা যায় স্পষ্ট রংধনু। এটি একেবারেই বিরল। ঝরনায় আসবেন, আর গোসল করবেন না! ঝরনার নিচে দাঁড়িয়ে বুলেটগতির পানির ঝাঁপটা দেখবেন, অনেকটাই আপনাকে প্রশান্তি এনে দেবে।

ফেরার পালা
আপনার ট্র্যাকিং রুট এখানেই শেষ। এবার সময় হলা ফেরার। ঠিক আগের মতো করেই। তবে এবার ফিরতে একটু কষ্ট হতে পারে। জাদিপাই থেকে কেওক্রাডংয়ে ওঠার রাস্তাটা মোটামুটি বেশ খাড়া। তাই পানি এবং হালকা খাবার নিয়ে গেলে শক্তি পাবেন উঠতে। আর এবার উঠে গেলে আর কোনো কষ্ট নেই। কেওক্রাডংয়ে ফিরে খেয়ে আবার বিশ্রাম করুন কটেজে। সন্ধ্যায় সূর্যাস্ত দেখতে উঠে যান আবার চূড়ায়। অসাধারণ এক অনুভূতি হবে। আবার আসবেন রাতে। একসাথে পুরো আকাশের তারাগুলো দেখার সুযোগ খুব কম হবে। তা ছাড়া ঠাণ্ডা এবং সুন্দর আবহাওয়া আপনার মনটাই ভালো করে দেবে। ঘুম শেষে সূর্যোদয় দেখে ফিরে যাত্রা করুন বগার উদ্দেশে। এর পর থেকে ঠিক আগের মতোই শেষ করতে থাকুন এই অসাধারণ অ্যাডভেঞ্চার। 
পুরো ট্র্যাকিংয়ে আপনাকে মুগ্ধ করবে পায়ের নিচে থাকা মেঘগুলো। মুগ্ধ হবেন স্থানীয় মানুষজনের সারল্য এবং আন্তরিকতা দেখে। মুগ্ধ হবেন নিজের প্রাণের স্পন্দন দেখে। কেওক্রাডং জয় করতে না এলে কতকিছুই না অদেখা থাকত!

মনে রাখা জরুরি 
১। খুব বেশি জামাকাপড় নেবেন না। শুধু যেগুলো একদম না নিলেই নয়, সেগুলো নেবেন। ভারী হওয়া ব্যাগই পরবর্তীকালে আপনার সবচেয়ে বড় শত্রু হয়ে উঠতে পারে যাত্রাপথে।

২। মজবুত কেডস অথবা স্যান্ডেল নেবেন। দুটির মাঝে আপনি যেটিতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন, সেটিই পরবেন।

৩। ব্যাকপ্যাক নেবেন। হাতের কোনো ব্যাগ নিলে চলবে না। 

৪। পানির বোতল নেবেন হাফ লিটারের। সেটাতে যেন সব সময়ই পানি থাকে। স্যালাইন রাখবেন সাথে।

৫। জোঁকের সংক্রমণ আছে। তাই লবণ নেবেন সাথে।

৬। মশার কামড় থেকে বাঁচতে ওডমস ক্রিম রাখুন সাথে। 

৭। ট্র্যাকিংয়ের সময় শুকনা খাবার এবং এমনিতে সারা দিন কলা খান। কলা আপনার পেশিকে কর্মক্ষম রাখবে। 

৮। হালকা কিছু ওষুধ আর অ্যান্টিসেপটিক ক্রিম রাখুন সাথে।

৯। একটা টর্চলাইট নেবেন সাথে। অনেক কাজে আসবে। 

১০। মোবাইল চার্জ দেওয়ার ফুসরত খুব একটা মিলবে না। তাই পারলে একটি পাওয়ার ব্যাংক নিয়ে নিন সাথে।

১১। রবি আর টেলিটক ছাড়া বাকি অপারেটরদের নেটওয়ার্ক সব সময় থাকে না। তাই এই দুটি মোবাইলের সিম সাথে নিয়ে যাবেন। 

১২। ক্যাপ পরে নেবেন সব সময়। 

১৩। সিগারেটের ফিল্টার, বিস্কুট, চানাচুর, চিপসের প্যাকেট যেখানে সেখানে ফেলবেন না দয়া করে। ডাস্টবিনে কিংবা ফেলার জন্য নির্দিষ্ট কোনো জায়গায় ফেলুন।