মেঘের রাজ্য মেঘালয়

Looks like you've blocked notifications!

চারদিকে উঁচু পাহাড় আর সবুজ পাহাড়ের বুক চিরে নেমে আসা ঝরনা, পাশাপাশি মেঘেদের অবিরাম ছোটাছুটি। কেউ যেন তাদের কানে কানে শুনিয়ে দিচ্ছে ‘কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা’। কখনো মেঘের শীতল স্পর্শ আপনার মনে জাগিয়ে তুলতে পারে অন্য রকম আনন্দ। বলছি বাংলাদেশের সিলেটের সীমান্তবর্তী ভারতের ২১তম রাজ্য মেঘালয়ের কথা। পাহাড়, ঝরনা, বৃষ্টিস্নাত সবুজ প্রকৃতি ইত্যাদি মিলে প্রকৃতি যেন আরেক স্বর্গ রচনা করেছে এখানে। বছরে ছয় থেকে সাত মাস মেঘালয় মেঘে ঢাকা থাকে। মেঘেদের খেলাঘর এই রাজ্যটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে প্রতিবছর লাখ লাখ মানুষ দূর-দূরান্ত থেকে এখানে ছুটে আসে। আমরা যারা পাহাড় ও ঝরনা দেখতে খুব ভালোবাসি তাদের জন্য এই রাজ্যটি হতে পারে একটি পরিতৃপ্তির জায়গা।

আমরা অনেকেই সিলেট বেড়াতে গিয়ে ভারতের সীমান্তঘেঁষা উঁচু পাহাড়গুলো দেখে সেখানে না যেতে পেরে আফসোস করি। মন বারবার ছুটে যেতে চায় এসব পাহাড়ের চূড়ায়, জানতে চায় এ রাজ্যটির সম্পর্কে।

মেঘালয় রাজ্যটি একটি পাহাড়ি রাজ্য এবং এখানে রয়েছে মন হরণকারী অনেক দর্শনীয় স্থান। নিজের ভ্রমণপিপাসু মনের তৃষ্ণা মেটাতে বেশ কয়েকদিনের জন্য আপনিও ঘুরে আসতে পারেন এই মেঘের রাজ্য থেকে ।

কীভাবে যাবেন

ঢাকা থেকে মেঘালয় যাওয়ার সহজ উপায় হলো ঢাকা থেকে সিলেট। তারপর সিলেটের তামাবিল সীমান্ত দিয়ে মেঘালয় রাজ্যে প্রবেশ করা। মেঘালয় যেতে হলে প্রথমে বাসে বা ট্রেনে করে আপনাকে যেতে হবে সিলেট শহরে। সিলেট শহর থেকে বাসে বা সিএনজি করে যেতে হবে তামাবিল সীমান্ত চেকপোস্ট। সেখানে আপনার পাসপোর্ট ভিসা ট্রাভেল টেক্সের রসিদ চেক করা হবে। সবকিছু ঠিক থাকলে সীমান্ত পার হয়ে আপনি ভারতের মেঘালয় রাজ্যে প্রবেশ করবেন। ভারতের প্রবেশের পর একইভাবে আপনার পাসপোর্ট-ভিসা যাচাই করা হবে। ভারতের মেঘালয় রাজ্যে প্রবেশ করেই যে ছোট্ট শহরটিতে প্রবেশ করবেন, তার নাম ডাউকি। তামাবিল থেকে ডাউকি মাত্র দুই কিলোমিটার। সীমান্ত পার হয়েই আপনি ডাউকি যাওয়ার গাড়ি পাবেন। ডাউকিতে নাশতা সেরে আপনাকে যেতে হবে মেঘালয় রাজ্যটির রাজধানী শিলং। জিপে করে যেতে সময় লাগবে আড়াই থেতে তিন ঘণ্টা। তবে যাত্রাপথ আপনার কাছে একটুও বিরক্তিকর লাগবে না বরং উঁচুনিচু পাহাড়ি পথ আপনাকে মোহিত করবে। হয়তো বা পথেই মেঘের রাজ্যের মেঘদের সাক্ষাৎ পেয়ে যেতে পারেন। আমরা সিলেট থেকে যে ডাউকি ব্রিজটি দেখতে পাই, এই ব্রিজটির ওপর দিয়ে আপনাকে যেতে হবে শিলংয়ের দিকে। পাশাপাশি যাত্রাপথে অন্য দেশ থেকে নিজের দেশের ভূমিকে দেখা আপনার মনে অন্যরকম ভালোলাগা জাগিয়ে তুলতে পারে।

কখন যাবেন

আগেই বলেছি মেঘের রাজ্য মেঘালয়। সুউচ্চ পাহাড়, সুন্দর সুন্দর ঝরনা, পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ, খাসিয়াদের জীবনব্যবস্থা সর্বোপরি মেঘেদের অপরূপ খেলা দেখতে প্রতিবছর হাজার হাজার পর্যটক ছুটে আসে এই রাজ্যটিতে। মেঘালয়ে সারা বছর পর্যটকদের আগমন ঘটে তবে সেখানে পিক সিজন এবং অফ পিক সিজন বলে কথা আছে। পিক সিজন হলো মার্চ মাস থেকে জুলাইয়ের মাঝামাঝি এবং সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বরের মাঝামাঝি। এ সময় প্রচুর পর্যটক এখানে বেড়াতে আসেন, তাই সবকিছুর দাম বেশি থাকে। যেমন ভ্রমণ খরচ, হোটেল ভাড়া, খাবার খরচ এ সময় অন্য সময়ের চেয়ে বেশি।

কোথায় থাকবেন

শিলং পাহাড়ি শহর। শিলংয়ের বড়বাজার ও পুলিশবাজার পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয় দুটি এলাকা। কারণ পর্যটকদের থাকার হোটেলগুলোর অধিকাংশই বড়বাজার ও পুলিশবাজার কিংবা তার আশপাশে অবস্থিত। তবে পুলিশবাজার তাদের কাছে বেশি জনপ্রিয়, কারণ এখান থেকে থেকে সহজেই বিভিন্ন টুরিস্ট স্পটগুলোতে যাওয়ার গাড়িগুলো ছেড়ে যায়। শিলংয়ের হোটেলগুলোতে আপনি দিনপ্রতি ৮০০ রুপি থেকে ১০ হাজার রুপির মধ্যে রুম পাবেন। শিলংয়ের হোটেলগুলোর মধ্যে অন্যতম হোটেলগুলো হলো ইডেন রেসিডেন্সি, হোটেল ব্রডওয়ে শিলং, হোটেল আলপিন কন্টিনেন্টাল, দ্য মাজেস্তিক হোটেল, হোটেল এসেম্বলি, হাই উইন্ডসহ অসংখ্য থাকার হোটেল এখানে আছে। অনলাইনের মাধ্যমেও রুম বুকিং দেওয়ার ব্যবস্থাও আছে এই হোটেলগুলোতে।

যেসব খাবার খাবেন

শিলংয়ে বেশ ভালো কিছু খাবারের হোটেল রয়েছে। এ হোটেলগুলোতে মাছ, মাংস, লুচিসহ নানা দেশীয় এবং চায়নিজ খাবার পাওয়া যায়। তবে যাঁরা হালাল-হারাম চিন্তা করে খাবার খেয়ে থাকেন, তাঁরা একটু যাচাই বাছাই করে খাবেন। কারণ খাসিয়াদের অন্যতম প্রিয় খাবার হচ্ছে শূকরের মাংস। তবে শিলংয়ের কিছু খাবার খুব জনপ্রিয়, যার স্বাদ আপনিও গ্রহণ করতে পারেন যেমন পুলিশ বাজারের দিল্লি মিষ্টান্নভাণ্ডারের জিলাপি, ইসি রেস্তোরাঁর কিমা সমুচা। এ ছাড়া এখানকার রেস্তোরাঁগুলোর চাউমিন বেশ প্রশংসিত। এখানে ঘুরতে এসে টুরিস্টরা আরো সেসব খাবারের প্রশংসা করেন তা হলো খাসিয়াদের ঐতিহ্যবাহী কিছু খাবার, আনারস এবং নানা পসরায় সাজানো পান।

যেসব জায়গায় বেড়াবেন

পর্যটকদের মন হরণ করার মতো অনেক দর্শনীয় স্থান এখানে রয়েছে। তাই প্রথমেই আপনার উচিত হবে আপনি আপনার সময় অনুযায়ী কোথায় কোথায় যাবেন তার একটা তালিকা তৈরি করা। আপনাদের সুবিধার জন্য কিছু দর্শনীয় স্থানের নাম নিচে দেওয়া হলো।

১। মাউলিংনং ভিলেজ : এটিকে বলা হয় এশিয়ার সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন গ্রাম। গ্রামটিতে রয়েছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সমাহার। মাউলিংনং ঝরনা এবং জীবন্ত শিকড়ের ব্রিজ এখানকার প্রধান পর্যটন আকর্ষণ।

২। ডাবল ডেকার জীবন্ত সেতুর ব্রিজ : এটি চেরাপুঞ্জির নংগ্রিয়াট গ্রামে অবস্থিত। জীবন্ত গাছের শেকড় দিয়ে তৈরি এই ব্রিজ আপনার মনকে আনন্দে ভরিয়ে তুলবে। এ ছাড়া চেরাপুঞ্জি ভারতের সবচেয়ে বৃষ্টিবহুল এলাকা হিসেবে একসময় পরিচিত ছিল। এখন সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাতের স্থানটি দখল করে আছে চেরাপুঞ্জি থেকে ৬৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত মহসিংডাম।

৩। এলিফ্যান্ট ফলস : এটি শিলং থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এটির নাম কেন হাতির নামে হলো তা নিয়ে নানা লোকমত প্রচলিত আছে এখানে। তবে যাইহোক মনোরম এই ঝরনার বিকেলের দৃশ্য আরো বেশি সুন্দর। টুরিস্টদের অন্যতম পছন্দের জায়গা এটি।

৪। বালপাকরাম ন্যাশনাল পার্ক : এটি মেঘালয়ের তুরা নামক স্থানে অবস্থিত। উঁচু পাহাড়ে গড়ে ওঠা এই পার্কটি আরেক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সমাহার। এই পার্কটি থেকে বাংলাদেশের টাঙ্গুয়ার হাওর দেখা যায়।

৫। ইউমিয়াম লেক : এটি নংপহ নামক স্থানে অবস্থিত। লেকটির আসল সৌন্দর্য দেখা যায় শীতকালে যখন লেকটি পানি পূর্ণ থাকে। এখানে নৌকা দিয়ে লেকটি ঘুরে দেখার ব্যবস্থা আছে।

৬। মাউসমাই গুহা : আর অবস্থান চেরাপুঞ্জির শিলা রোডে (Shella Road, Cherapunjee)। এখানে যারা ঘুরতে আসেন, তাদের কাছে এ গুহাটি ঘুরে দেখার বেশ আগ্রহ থাকে বলে জানা যায়।

৭। সিজু গুহা : তুরায় অবস্থিত এই গুহাটিও পর্যটকদের পছন্দের তালিকায় স্থান পেয়ে থাকে।

৮। নহখালিকাই ফলস ও সেভেন সিস্টার্স ফলস : নহখালিকাই ফলস ও সেভেন সিস্টার্স ফলস দুটিরই অবস্থান চেরাপুঞ্জিতে। নহখালিকাই ফলসটি ভারতে চতুর্থ উচ্চতম ঝরনা। এটির উচ্চতা প্রায় ১০৯৯ ফুট। এটি শিলং থেকে ৫৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।

এগুলো ছাড়াও মেঘালয়ে রয়েছে বেশ সুন্দর সুন্দর কিছু  ভিউ পয়েন্ট, শিলং পিক, জাকরেম হট স্প্রিং, থাংরাং পার্ক, ভারসাম্য পাথর বা বেলেন্সিং রক যা পর্যটকদের মন আকর্ষণ করে।

দর্শনীয় স্থানগুলোতে যেভাবে যাবেন

পুলিশবাজার মোড় থেকে আপনি এই স্থানগুলোতে যাওয়ার বিভিন্ন গাড়ি পাবেন। এ ছাড়া এখানকার ট্যুরিজম সম্পর্কিত সকল তথ্যের জন্য আপনি মেঘালয় ট্যুরিজম ডেভেলপমেন্ট করপোরেশনে যোগাযোগ করতে পারেন। এখান থেকে প্রতিদিন বাসে করে কম খরচে পর্যটকদের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ঘুরিয়ে দেখানো হয়। তবে এর জন্য আপনাকে আগে থেকে টিকেট কেটে রাখতে হবে। এ ছাড়া আপনার সুবিধার জন্য সঙ্গে একজন টুরিস্ট গাইড রাখতে পারেন।

সঙ্গে যা যা রাখবেন

একজন টুরিস্ট হিসেবে আপনার প্রথমেই যা সব সয়য় সঙ্গে রাখা উচিত তা হলো আপনার পাসপোর্ট ও ভিসা। কারণ পুলিশ যেকোনো সময় আপনার পাসপোর্ট ভিসা দেখতে চাইতে পারে। এ ছাড়া যেহেতু মেঘের রাজ্য, সুতরাং ভিজতে না চাইলে অবশ্যই কিছু সরঞ্জাম যেমন ছাতা, রেইন কোর্ট, মোবাইল ভেজা থেকে রক্ষা করতে পলিথিন ব্যাগ ইত্যাদি সঙ্গে রাখুন। পাহাড়ি রাস্তায় হাঁটার জন্য স্লিপার স্যান্ডেল বেশ আরামদায়ক। কিছু মানুষ আছে যাদের উঁচুতে উঠলে মাথাব্যথা হয়, তারা সঙ্গে মাথাব্যথার ট্যাবলেট রাখতে পারেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি আপনার খেয়াল রাখতে হবে তা হলো সঙ্গে পানি নিয়েছেন কি না।

সাবধানতা

১। মেঘালয়ের স্থানীয় অধিবাসীরা পর্যটকদের প্রতি খুবই আন্তরিক কিন্তু কোনোভাবেই তাদের সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় যাবেন না, এতে হিতে বিপরীত হতে পারে।

২। যাঁরা হালাল-হারাম চিন্তা করে খাবার খেয়ে থাকেন, তাঁরা একটু দেখেশুনে খাবার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে খাবার খাবেন।

৩। সকাল সকাল ঘুরতে বের হয়ে সন্ধ্যা হওয়ার আগেই ফিরে আসুন।

৪। সঙ্গে মোবাইল, ক্যামেরা ইত্যাদি থাকলে সেগুলো সাবধানে রাখুন।