একচেটিয়া টিকার বাজার, সাহায্য করতে চেয়েও সাড়া পায়নি বাংলাদেশের ইনসেপ্টা

Looks like you've blocked notifications!
বাংলাদেশের ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির কারখানার দৃশ্য। ছবি : সংগৃহীত

যেসব ওষুধ কোম্পানি করোনার টিকা উদ্ভাবন করেছে এবং যেসব প্রতিষ্ঠান টিকা তৈরির অনুমোদন পেয়েছে, তারা উৎপাদিত টিকার প্রথম ডোজের সিংহভাগই বিক্রি করছে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ গুটিকয়েক ধনী দেশগুলোর কাছে। বড় অঙ্কের অর্থ ব্যয় করে প্রথম ধাপে টিকার চালান যোগাড় করতে পারেনি অনেক দেশ। সে দেশগুলো টিকাদানে এমনিতেই পিছিয়ে রয়েছে। তার ওপর যুক্ত হয়েছে টিকা উৎপাদনে ধীর গতি এবং টিকা তৈরির কাঁচামালের সংকট। যে কারণে অনিশ্চিত অপেক্ষার প্রহর গুণছে কয়েকশ কোটি মানুষ।

যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট জানিয়েছে, আফ্রিকা মহাদেশের বেশির ভাগ দেশ এবং দক্ষিণ আমেরিকা ও এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশ ২০২৩ সালের আগে সিংহভাগ জনগণকে টিকার আওতায় আনতে পারবে না বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এই যখন প্রেক্ষাপট, তখন জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় সংশ্লিষ্ট ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সহায়তা করার অনুরোধ জানিয়ে সাড়া পাচ্ছে না উন্নয়নশীল দেশের ওষুধ কোম্পানিগুলো। নিজেদের প্রযুক্তি উন্নয়নশীল দেশের ওষুধ কোম্পানিগুলোর সঙ্গে ভাগাভাগি করতে চাচ্ছে না মডার্না, জনসন অ্যান্ড জনসন ও নোভাভ্যাক্সের মতো করোনার টিকা তৈরির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো। উন্নয়নশীল ও দরিদ্র দেশগুলোর কাছে তারা সরাসরি টিকা বিক্রি করতে আগ্রহী।

মডার্না, জনসন অ্যান্ড জনসন ও নোভাভ্যাক্সের নির্বাহী কর্মকর্তাদের কাছে ইমেইল করেছিলেন বাংলাদেশের ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান ইনসেপ্টার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুল মুক্তাদির। ইমেইলে আবদুল মুক্তাদির জানান, তিনি বিদেশি এসব ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানকে করোনার টিকার শিশি (ভায়াল) ভরতে সাহায্য করতে চান। তিনি জানান, এশিয়ার দেশগুলোতে করোনার টিকা সরবরাহে সহায়তা করতে তাঁর প্রতিষ্ঠান বছরে ৬০ থেকে ৮০ কোটি শিশি ভরতে সক্ষম।

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) নিয়ম অনুযায়ী, স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ২০৩৩ সাল পর্যন্ত স্বয়ংক্রিয়ভাবে মেধাস্বত্বের দায় থেকে মুক্ত। এরপরও কারো স্বত্ব ভঙ্গ না করে প্রযুক্তি বিনিময় করতে চান আবদুল মুক্তাদির। তিনি বলেন, ‘ইনসেপ্টার উন্নত উৎপাদন সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও আমরা অবহেলিত, কারণ আমরা বাংলাদেশে আছি।’

উপর্যুক্ত কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ফিরতি সাড়া পাননি আবদুল মুক্তাদির। প্রতিষ্ঠানগুলোর আগ্রহের ঘাটতি দেখে বাংলাদেশসহ এশিয়ার স্বল্প-আয়ের নাগরিকদের করোনাভাইরাসের ঝুঁকিতে থাকার সময়টা আরও বাড়ছে চিন্তা করে উদ্বিগ্ন হন মুক্তাদির।

জরুরি টিকা উৎপাদনে বাংলাদেশ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে ইনসেপ্টা। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক গত ১৮ মার্চ বলেছেন, ‘আমরা ভ্যাকসিন উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে চাই।’ আশুলিয়ার জিরাবো এলাকায় ইনসেপ্টা ভ্যাকসিন লিমিটেডের ভ্যাকসিন প্ল্যান্ট পরিদর্শনকালে স্বাস্থ্যমন্ত্রী এ মন্তব্য করেন।

এক জুম ইন্টারভিউতে ওয়াশিংটন পোস্টকে মুক্তাদির বলেন, ‘বিশ্বের প্রতিটি কোণে পাওয়া একেকটি সুযোগ কাজে লাগানোর সময় এখন।’

করোনার টিকা প্রস্তুতকারক বিশ্বের শীর্ষ ওষুধ প্রতিষ্ঠানগুলোর বিষয়ে মুক্তাদির বলেন, ‘এসব কোম্পানির উচিত যত বেশি সংখ্যক দেশের সঙ্গে পারা যায় চুক্তি করা।’

ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বব্যাপী করোনার টিকা সরবরাহের লড়াইটা শুধু পশ্চিমা দেশগুলোর নৈতিকতার বিষয় নয়। সব জায়গায় টিকা সরবরাহ করতে না পারলে বা ধীরগতি হলে অন্য মহাদেশগুলোতে সংক্রমণের আশঙ্কা রয়েই যাচ্ছে। ফলে সেখান থেকে আবার পৃথিবীর যেকোনো জায়গায় ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে পারে, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রসহ যেসব দেশে আগেভাগে টিকা দেওয়া সম্ভব হয়েছে সেখানেও।

জুলাইয়ের মধ্যে অধিকাংশ আমেরিকানের টিকাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করার ঘোষণা দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। সম্প্রতি তাঁর করোনা তহবিল নিয়ে আলোচনায় কংগ্রেসে কয়েকজন ডেমোক্র্যাট নেতা পৃথিবীর অন্যান্য দেশে করোনার টিকা নিশ্চিতের বিষয়টি উল্লেখ করেন। তাঁরা বলেন, অন্যদের ভুলে যাবে না যুক্তরাষ্ট্র।

হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভসের সদস্য জ্যান শাকোওস্কি বলেন, ‘আমরা এয়ারলাইনস, আতিথেয়তা ও ভ্রমণ খাতে অনেক ব্যয় করছি। কিন্তু সবাইকে সুরক্ষা না দিতে পারলে এসবের সুফল মিলবে না।’ সম্প্রতি কংগ্রেসে করোনার টিকার স্বত্ব ও প্রস্তুতপ্রণালী হস্তান্তরে নারাজ টিকা প্রস্তুতকারক কোম্পানির কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেন জ্যান শাকোওস্কি।

নর্থইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির আইনের অধ্যাপক ব্রুক বেকার বলেন, ‘এটা কোনো কথা হতে পারে না। ধনী দেশগুলো তাদের লোকজনকে টিকা দিয়ে দেবে, আর অন্য দেশগুলোর অল্পবিস্তর মানুষ টিকা পাবে।’

ব্রুক বেকার গত বছর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে (ডব্লিউএইচও) বলেছিলেন, উন্নয়নশীল দেশগুলোর হাতে করোনার টিকা পৌঁছাতে প্রযুক্তি-বিনিময়ের ব্যবস্থা করতে।

ডব্লিউএইচও সে অনুযায়ী ‘কোভিড-১৯ টেকনোলজি অ্যাক্সেস পুল’ গঠন করে। কিন্তু টিকা উৎপাদক কোম্পানিগুলোর কোনোটিই তাতে যোগ দিতে সম্মত হয়নি। গত বছর ফাইজারের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আলবার্ট ব্যোরলা এই উদ্যোগকে ‘অসার’ বলে মন্তব্য করেন।

ওয়াশিংটন পোস্টকে ডব্লিউএইচও বলেছে, এই টিকা জাতীয়তাবাদের জন্য গোটা বিশ্বের অর্থনীতি ও জনগণ সংকটে রয়েছে।

গত মাসে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস হুঁশিয়ারি দিয়ে জানান, শুধু ১০টি দেশ এ পর্যন্ত উৎপাদিত সব টিকার ৭৫ শতাংশ ব্যবহার করেছে। অন্যদিকে, ১৩০টি দেশ এখনও এক ডোজ টিকাও পায়নি। জাতিসংঘের টিকা সরবরাহ জোট কোভ্যাক্স মাত্র কয়েকটি নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশে টিকা পাঠাতে পেরেছে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের আমলে কোভ্যাক্সে যুক্ত হতে না চাইলেও বাইডেন প্রশাসন এতে যুক্তরাষ্ট্রকে জড়িয়েছেন। টিকা কিনতে ওই তহবিলে গত মাসে ৪০০ কোটি মার্কিন ডলার অর্থ বরাদ্দও দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন।

এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি জনসন অ্যান্ড জনসনের এক ডোজের টিকা ভারতে উৎপাদনের ঘোষণাও দিয়েছেন জো বাইডেন। ২০২২ সালের মধ্যে সেখানে একশ কোটি ডোজ টিকা উৎপাদন হবে বলেও জানানো হয়।

চীনের কাছ থেকে সামান্য কিছু টিকার ডোজ পেয়েছে পাকিস্তান। পৃথিবীর পঞ্চম সর্বাধিক (প্রায় ২২ কোটি) মানুষের দেশ পাকিস্তান এখন পর্যন্ত পশ্চিমা কোনো কোম্পানি থেকে টিকা পায়নি।

এদিকে, বিপুল আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে পশ্চিমা টিকা প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলো। মার্কিন সরকারের সঙ্গে যৌথভাবে টিকা উৎপাদনকারী মডার্না গত ফেব্রুয়ারি মাসে জানায়, তারা এ বছর সাড়ে ১৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। জার্মানির বায়োএনটেকের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান ফাইজারের এ বছরের লক্ষ্যমাত্রা ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

ফাইজার ও মডার্না উভয়ই আরএনএ প্রযুক্তি ব্যবহার করে টিকা উৎপাদন করছে। এটি করোনাভাইরাস সংশ্লিষ্ট আরও রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে বলে এই প্রযুক্তির মূল্য অনেক বেশি।

নতুন টিকার স্বত্ব সাময়িক উম্মুক্ত করে দিতে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা বরাবর আবেদন করেছে ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকাসহ ৮০টি দেশ। অন্যদিকে, এটি যেন না করা হয় সেজন্য যুক্তরাষ্ট্রের ওষুধ কোম্পানিগুলো বাইডেন প্রশাসনে তদবির করেছে। তারা বলছে, গণহারে উৎপাদনের ফলে টিকার মান ধরে রাখা সম্ভব হবে না। দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর কাছে সরাসরি টিকা বিক্রি করার পক্ষপাতী যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলো।

এরই মধ্যে সরাসরি টিকা বিক্রি শুরুও করেছে ফাইজার-বায়োএনটেক। মোট উৎপাদিত টিকার ৩৬ শতাংশ দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য বলে জানিয়েছে ফাইজার।

অন্যদিকে, সুইজারল্যান্ড, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাজ্যের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গত ১০ মার্চ টিকার স্বত্ব উম্মুক্তকরণের সুবিধা বন্ধের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়।

তবে, যুক্তরাজ্যের কোম্পানি অ্যাস্ট্রাজেনেকা প্রযুক্তি বিনিময়ে ব্যাপকভাবে আগ্রহী হওয়া সত্ত্বেও ইউরোপীয় অনেকগুলো দেশ কোম্পানিটির টিকার ব্যবহার স্থগিত করার ফলে এক ধরনের সংকটময় পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।