করোনাভাইরাসের মিউটেশন কীভাবে হয়?
নভেল করোনাভাইরাসের বৈশ্বিক মহামারির শুরুর সময় থেকেই বিজ্ঞানীরা ভাইরাসের জেনেটিক গঠনে কোনো পরিবর্তন আসে কি না, তার ওপর নজর রাখছিলেন। সব ভাইরাসেরই মিউটেশন হয়। যার অর্থ হলো ভাইরাস নিজেকে প্রতিনিয়ত পরিবর্তন করতে থাকে। সাধারণত দেখা যায় প্রতি এক মাস সময়কালে একটি বা দুটি পরিবর্তন হয়ে থাকে। সংবাদমাধ্যম বিবিসি এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানিয়েছে।
অনেক সময়ই মিউটেশনের ফলে ভাইরাসের আচরণে তেমন কোনো প্রভাব পড়ে না, বা হলেও তা হয় খুবই নগণ্য।
ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের ড. লুসি ভ্যান ডর্প মানবদেহে রোগ সৃষ্টিকারী অণুজীবের বিবর্তন বিষয়ক একজন বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, ‘বেশির ভাগ সময়ই এগুলো (মিউটেশন) গুরুত্বহীন। এবং খুব বিরল দু-একটি ক্ষেত্র ছাড়া এটা ক্ষতিকর কিছুও নয়। সার্স-কোভ-টুর জেনোমে আমরা যে মিউটেশনগুলো দেখেছি, তার বেশির ভাগই ভাইরাসটির আচরণে কোনো পরিবর্তন আনে না।’
অনেক পরিবর্তনই ভাইরাসের আচরণে কোন প্রভাব ফেলে না। কিন্তু দু-একটি ক্ষেত্রে ভাইরাসটি এমন কিছু মিউটেশন ঘটিয়ে ফেলে, যা তাদের টিকে থাকা এবং বংশবৃদ্ধির ক্ষমতার ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
ড. ভ্যান ডর্প বলেন, ‘যদি মহামারি ছড়ানোর পূর্বশর্তগুলো অনুকুল থাকে, তাহলে এরকম মিউটেশন বহনকারী ভাইরাস তখন প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটাতে থাকে।’
যুক্তরাজ্য থেকে ছড়ানো করোনাভাইরাসের যে মিউটেশনটি নিয়ে এখন সারা দুনিয়ায় হৈচৈ চলছে সেটি অস্বাভাবিক দ্রুতগতিতে ছড়াচ্ছে।
করোনাভাইরাসের গায়ে যে কাঁটার মত স্পাইকগুলো থাকে, মিউটেশনের ফলে সেগুলোর প্রোটিনে এমন কিছু পরিবর্তন হচ্ছে যাতে এটা আরো সহজে মানুষের দেহকোষে ঢুকে পড়তে পারছে। এটিই বিজ্ঞানীদের বিশেষ দুশ্চিন্তার কারণ। এই নতুন ধরনের করোনাভাইরাসে ১৪টি মিউটেশন চিহ্নিত করা হয়েছে।
ভাইরাসের মধ্যে প্রোটিন তৈরির উপাদান হচ্ছে অ্যামিনো এসিড এবং তাতে একটি পরিবর্তন ঘটাচ্ছে এই মিউটেশন।
এসব মিউটেশনের কথা বিজ্ঞানীদের আগেও জানা ছিল, কিন্তু এত বিশদভাবে জানা ছিল না।
কীভাবে চিহ্নিত হলো এই নতুন ধরনের ভাইরাস
করোনাভাইরাসের নতুন এই প্রকার বা ধরনটি চিহ্নিত হয়েছে যুক্তরাজ্যে। কিন্তু এমন হতেই পারে যে তার অনেক আগে থেকেই এটি যুক্তরাজ্যের বাইরে কোথাও ছড়াচ্ছিল।
হয়তো এটির উৎপত্তিও যুক্তরাজ্যের বাইরে, এমন সম্ভাবনাও আছে।
তবে বিজ্ঞানীরা বলছেন, যুক্তরাজ্যে এটি চিহ্নিত হয়েছে কারণ সেখানে নভেল করোনাভাইরাসের ওপর নজরদারির যে বৈজ্ঞানিক অবকাঠামো আছে তা অত্যন্ত শক্তিশালী। এর নাম হচ্ছে কগ-ইউকে বা ‘কোভিড-১৯ জেনোমিক্স কনসোর্টিয়াম’ - এতে দেড় লাখেরও বেশি সার্স-কোভ-টু ভাইরাসের নমুনার জেনেটিক ইতিহাস সংরক্ষণ করা হচ্ছে। সারা পৃথিবীতে এ ভাইরাসের যে পরিমাণ জেনেটিক সিকোয়েন্স সংরক্ষিত আছে, তার অর্ধেকেরও বেশি আছে এখানে।
এ কারণেই করোনাভাইরাসের নতুন কোন মিউটেশন হলে এর মধ্যে যে ছোটো ছোটো পরিবর্তনগুলো হয়, সেগুলো এই কগ-ইউকের বিজ্ঞানীদের চোখে ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই সবচেয়ে বেশি।
এ বছর ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে যখন যুক্তরাজ্যে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ছড়াচ্ছিল, তখন বিজ্ঞানীরা দেখতে পেয়েছিলেন যে ভাইরাসটি যুক্তরাজ্যে আসছে মূলত ইউরোপ থেকে। করোনার আদি উৎপত্তিস্থল চীন থেকে নয়।
যে দেশগুলো করোনাভাইরাসের জেনোমিক সিকোয়েন্সিং করছে সেসব দেশেই ভাইরাসের নতুন কোনো মিউটেশন হলে তা ধরা পড়ে যাচ্ছে, যেমন দক্ষিণ আফ্রিকা, ডেনমার্ক ও নেদারল্যান্ডস।
যুক্তরাজ্যই একমাত্র দেশ নয় যেখানে করোনাভাইরাসের এই নতুন রূপ দেখা গেছে।
ইউরোপের ইতালি, আইসল্যান্ড, ডেনমার্ক ও নেদারল্যান্ডসে ইতোমধ্যেই পাওয়া গেছে এটির অস্তিত্ব। পাওয়া গেছে অস্ট্রেলিয়াতেও।
তা ছাড়া যুক্তরাজ্যে যেহেতু সেপ্টেম্বর থেকেই এই নতুন মিউটেশনটি চিহ্নিত হয়েছিল, তাই মানুষের বিভিন্ন দেশে যাতায়াতের সূত্রে হয়তো এর মধ্যেই নতুন ধরনের করোনাভাইরাসটি আরো কিছু দেশে পৌঁছে গেছে। তবে এখনো তা চিহ্নিত হয়নি।
দক্ষিণ আফ্রিকাতেও পাওয়া গেছে করোনাভাইরাসের একটি নতুন রূপ, যা যুক্তরাজ্যের ধরনটির মতো হুবহু একই রকম নয়, তবে প্রায় কাছাকাছি।
দক্ষিণ আফ্রিকার কর্তৃপক্ষ এরই মধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সঙ্গে মিলে করোনাভাইরাসের এক নতুন সংস্করণের ব্যাপারে তদন্ত শুরু করেছে। এই ভাইরাস এরই মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকার বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক মাত্রায় ছড়াচ্ছে, বিশেষ করে আগেকার তুলনায় এই নতুন রূপের করোনাভাইরাসটি তরুণ জনগোষ্ঠীকে বেশি করে সংক্রমিত করছে। বলা হচ্ছে, এটির সঙ্গে যুক্তরাজ্যে দেখা দেওয়া মিউটেশনটির বেশ কিছু মিল আছে, তবে হুবহু এক রকম নয় । দক্ষিণ আফ্রিকায় এই নতুন ধরনটি এখন করোনাভাইরাসের প্রধান ভ্যারিয়েন্টে পরিণত হয়েছে।
যুক্তরাজ্যেও পৌঁছে গেছে দক্ষিণ আফ্রিকায় বিবর্তিত এই ভাইরাসটি
বুধবারই ব্রিটেনের স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন যে যুক্তরাজ্যে করোনাভাইরাসের আরেকটি নতুন সংস্করণে আক্রান্ত দুজনকে শনাক্ত করা হয়েছে। আক্রান্ত ব্যক্তিদ্বয় দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়েছিল। এই ভ্যারিয়েন্টটিও খুব সহজে মানুষ থেকে মানুষে ছড়াতে পারে।
নতুন ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হওয়ার পর দক্ষিণ আফ্রিকায় ভ্রমণের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে যুক্তরাজ্য। এবং যারা গত ১৫ দিনের মধ্যে সেখানে গিয়েছিল, তাদের অবিলম্বে কোয়ারেন্টিনে যেতে বলা হয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকায় এরই মধ্যে এই বিশেষ ভ্যারিয়েন্টটি ব্যাপকভাবে ছড়াচ্ছে।
যুক্তরাজ্যের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে ছড়ানো ভ্যারিয়েন্টের সঙ্গে এর মিল আছে, তবে তারা আলাদাভাবে বিবর্তিত হয়েছে। দুটি ভ্যারিয়েন্টেরই ‘এন ফাইভ জিরো ওয়ান ওয়াই’ নামের একটি অভিন্ন মিউটেশন হয়েছে, যা মানবদেহকোষে সংক্রমণ ঘটাতে সক্রিয় ভুমিকা রাখে।
দুর্বল রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন কোভিড-১৯ রোগীদের দেহে সহজে ছড়াতে পারে এমন মিউটেশন পাওয়া গিয়েছিল, যেখানে ভাইরাসটি কোনো রকম লক্ষণ দেখা দেওয়ার আগে কয়েকমাস ধরে অবস্থান করতে পারে। বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, নতুন ভ্যারিয়েন্টটি কীভাবে বিবর্তিত হয়েছে তার একটা ধারণা হয়তো এখান থেকে পাওয়া যেতে পারে।
হয়তো দুর্বল রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন রোগীদের দেহে ভাইরাসটি কয়েক মাস ধরে নিরাপদে অবস্থান করেছে এবং সেখানেই এই মিউটেশনগুলো ঘটেছে।
কগ-ইউকের বিজ্ঞানী এবং গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডেভিড রবার্টসন বলছেন, ‘এখন আমরা যেভাবে চিন্তা করছি তা হলো—দীর্ঘমেয়াদি সংক্রমণের প্রেক্ষাপটেই এতগুলো মিউটেশনের মাধ্যমে বিবর্তনগুলো হয়েছে।’
বেজিজাতীয় প্রাণী মিঙ্কের সঙ্গে নতুন ভ্যারিয়েন্টের কোনো সম্পর্ক আছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক রবার্টসন বলেন, ‘মিঙ্ক বা অন্য কোনো প্রাণীর এতে জড়িত থাকার কোনো প্রমাণ নেই। তবে, এ আশঙ্কাটা একেবারে উড়িয়ে না দেওয়াটাই হয়তো উচিত হবে।’
টিকার কার্যকারিতা
চীনের গবেষকেরা জানুয়ারি মাসে প্রথম করোনাভাইরাসের জেনোম সিকোয়েন্স প্রকাশ করার পর থেকে সারা বিশ্বের বিজ্ঞানীদের মধ্যে ব্যাপকহারে এ সংক্রান্ত তথ্য আদানপ্রদান হচ্ছে।
এ পর্যন্ত সারা বিশ্বে আড়াই লাখেরও বেশি সার্স-কোভ-টু জেনোম সিকোয়েন্স তৈরি করেছেন বিজ্ঞানীরা।
এর ফলেই যুক্তরাজ্যে ছড়ানো মিউটেশনটি এত দ্রুত ‘উদ্বেগের কারণ’ হিসেবে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে।
এখন প্রধান প্রশ্ন এটাই যে এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত করোনাভাইরাসের টিকাগুলোর কার্যকারিতার ওপর এই নতুন ধরনের করোনাভাইরাস মিউটেশনগুলোর কোনো প্রভাব পড়বে কি না।
বেশির ভাগ বিশেষজ্ঞই বলছেন, নতুন মিউটেশনের ফলে টিকার কার্যকারিতা কমে যাবে, এমন কোনো সম্ভাবনা অন্তত এখনো নেই।
তবে ড. ভ্যান ডর্প বলছেন, আগামী দিনগুলোতে বিজ্ঞানীদের কাছে এই প্রশ্নটি আরো বেশি করে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।