কেন করোনা ঠেকাতে পারছে না হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন, জানালেন বিজ্ঞানীরা
ম্যালেরিয়ার ওষুধ হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন ও ক্লোরোকুইনকে একটা সময় বলা হচ্ছিল করোনার চিকিৎসায় ‘গেম চেঞ্জার’। কিন্তু এরপর হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন ও ক্লোরোকুইনকে একেবারে বলতে গেলে বাতিলের খাতায় ফেলে দেওয়া হয়েছে। গবেষকরা পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন, করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে পারে না ম্যালেরিয়ার এ দুই ওষুধ। শুধু তাই নয়, হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন ও ক্লোরোকুইনের ডোজের হেরফেরে জটিল পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এবং তা থেকে মৃত্যুও হতে পারে। বিশ্বজুড়েই হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনের ট্রায়াল বন্ধ করে দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। সম্প্রতি একদল জার্মান বিজ্ঞানী দাবি করেছেন, শুধু ফুসফুসেই করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে পারে না হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন। কিন্তু কিডনিতে করোনার সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে পারে এ ওষুধ। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য প্রিন্ট ও দ্য ওয়াল এ খবর জানিয়েছে।
প্রশ্ন উঠছে, কী কারণে সংক্রমণ সারাতে পারছে না হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন? ‘নেচার’ জার্নালে জার্মানির বিজ্ঞানীদের একটি গবেষণার প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় গত ২২ জুলাই। যেখানে বলা হয়েছে, যেহেতু করোনাভাইরাস সরাসরি ফুসফুসকেই নিশানা করে, এপিথেলিয়াল কোষে ভাইরাল স্ট্রেন সহজে ঢুকে পড়তে পারে, তাই করোনাভাইরাস সংক্রমণজনিত কারণে ফুসফুসের জটিল রোগ সারাতে ব্যর্থ হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন। সে কারণেই কোভিড-১৯ সংক্রমণ ঠেকাতে পারছে না এ ওষুধ। তবে সব দায় একা ওষুধের নয়, এর পেছনে করোনাভাইরাসের কারসাজিও আছে।
নতুন গবেষণায় যা জানা গেল
গবেষণাকালে করোনায় আক্রান্ত রোগীর বিভিন্ন অঙ্গের কোষ নিয়ে পরীক্ষা চালানো হয়। একই সঙ্গে আফ্রিকার একটি বিশেষ প্রজাতির বানরের দেহকোষ নিয়েও পরীক্ষা চালান জার্মান বিজ্ঞানীরা। তাতে দেখা গেছে, কিডনির কোষে ভাইরাসের প্রতিলিপি তৈরির ক্ষমতা নষ্ট করে দিতে পারছে হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন। কিন্তু ফুসফুসের ক্ষেত্রেই কাজ করছে না ওষুধটি। আর সার্স-কভ-২ আরএনএ ভাইরাস বা করোনাভাইরাস প্রথমে ফুসফুসকেই আক্রান্ত করে সংক্রমণ ছড়াচ্ছে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, কোষে দুভাবে সংক্রমণ ছড়াতে পারে সার্স-কভ-২। প্রথমত, দেহকোষের রিসেপটর প্রোটিন অ্যাঞ্জিওটেনসিন-কনভার্টিং এনজাইম-২-এর সঙ্গে জোট বেঁধে কোষে ঢুকতে পারে। দ্বিতীয়ত, কোষে ঢোকার পরে এন্ডোজ়োম নামের একটি বিশেষ উপাদানে মিশে যেতে পারে। এ দুই প্রক্রিয়া ঠিকঠাকভাবে হলেই কোষের ভেতরে দ্রুত বিভাজিত হতে শুরু করে নভেল করোনাভাইরাস। আর বিভাজন শুরু হওয়ার মানেই প্রতিলিপি তৈরি করে গোটা ফুসফুসকেই সংক্রমিত করে ফেলা। তবে ভাইরাস কোন কোষে কীভাবে ঢুকবে এবং সংক্রমণ ছড়াবে, সেটা নির্ভর করে কোষের ধরনের ওপরেও।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, কিডনির কোষে সংক্রমণ ছড়াতে হলে সার্স-কভ-২ ভাইরাসের প্রয়োজন হয় ক্যাথেপসিন-এল নামের এনজাইম। এই ক্যাথেপসিন এনজাইম আবার ভাইরাসকে কোষে জায়গা দেওয়ার জন্য এসিডের পরিমাণ বাড়াতে থাকে। হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন ওষুধ এ এসিডের মাত্রা কমিয়ে দিতে পারে। ফলে এনজাইম ঠিকভাবে কাজ করতে পারে না। তাই করোনাভাইরাসও কিডনির কোষে সংক্রমণ ছড়াতে পারে না।
আবার ফুসফুসের কোষে সংক্রমণ ছড়াতে হলে করোনাভাইরাসের দরকার হয় ‘টিএমপিআরএসএস২’ এনজাইম। এই এনজাইম থাকে কোষের সারফেসে বা উপরিভাগে। এই এনজাইম ভাইরাসকে এমনভাবে কোষে ঢুকতে দেয় যে আলাদা কোনো বিশেষ পরিস্থিতি তৈরি হয় না, যেটা হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনের মতো ওষুধ চিহ্নিত করতে পারবে। তাই ভাইরাল স্ট্রেন যদি এ এনজাইমের সঙ্গে মিশে ফুসফুসের কোষে ঢোকে, তাহলে তাকে আটকানোর ক্ষমতা হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনের থাকে না। কেন হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন ও ক্লোরোকুইন ফুসফুসের সংক্রমণ ঠেকাতে পারছে না, তার সবচেয়ে বড় কারণ এটি।
ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ডের প্রাণরসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ক্যাথেরিন সেলে বলেছেন, হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনের প্রয়োগ নিয়ে আরো গবেষণা চালানো হচ্ছে। এ ওষুধকে কীভাবে ব্যবহার করলে লাভজনক হতে পারে, সেটিও পরীক্ষা করে দেখা হবে।