জান্তাবিরোধী বিক্ষোভে নিহত অ্যাঞ্জেলকে হাজারো মানুষের শেষ বিদায়
মিয়ানমারে চলমান জান্তাবিরোধী বিক্ষোভে গত বুধবার নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে নিহত হন ১৯ বছর বয়সী তরুণী কায়াল সিন। পরিচিতরা অবশ্য তাঁকে ‘অ্যাঞ্জেল’ নামেই চিনত। মিয়ানমারের মান্দালয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার অ্যাঞ্জেলের শেষকৃত্যানুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন হাজারো মানুষ। সংবাদমাধ্যম বিবিসি এ খবর জানিয়েছে।
বিক্ষোভে অংশগ্রহণকারী অ্যাঞ্জেলের গায়ে ছিল ‘এভরিথিং উইল বি ওকে’ (বাংলায় যার অর্থ দাঁড়ায়—‘সব ঠিক হয়ে যাবে’) লেখা টি-শার্ট।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শ্রদ্ধাঞ্জলিতে ভাসছেন অ্যাঞ্জেল। অনেকের কাছে তিনি বিক্ষোভের ‘হিরো’।
মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর নেতৃত্বে গত ১ ফেব্রুয়ারি রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাতের পর থেকে দেশটিতে চলছে জান্তাবিরোধী বিক্ষোভ। রক্তক্ষয়ী এই বিক্ষোভে এখন পর্যন্ত নিহত হয়েছেন অর্ধশতাধিক এবং আহত হয়েছেন অনেকে। সেনা অভ্যুত্থানের অবসান এবং দেশটির নেত্রী অং সান সু চিসহ সামরিক বাহিনীর হাতে আটক রাজনৈতিক নেতাদের মুক্তির দাবিতে দেশটিতে বিক্ষোভ চলছে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয়ের হিসাব অনুযায়ী, মিয়ানমারে বিক্ষোভে নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে এখন পর্যন্ত নিহত হয়েছেন ৫৪ জনের বেশি। তবে, অন্যান্য প্রতিবেদনে এ সংখ্যা আরও অনেক বেশি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। চলমান বিক্ষোভের সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী দিন ছিল গত বুধবার। মিয়ানমারের বিভিন্ন নগর ও শহরে সেদিন ৩৮ জন বিক্ষোভকারী নিহত হন।
‘শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের ওপর সহিংস দমন-পীড়ন বন্ধ করতে’ নিরাপত্তা বাহিনীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচেলেট।
মিয়ানমারে চলমান সহিংসতায় নিন্দা জানিয়েছে অনেক দেশ। কিন্তু, সেসব বলতে গেলে কানেই নিচ্ছেন না অভ্যুত্থানের নেতারা।
জাতিসংঘে মিয়ানমারের দূত তাঁর দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে ‘আন্তর্জাতিকভাবে কঠোর পদক্ষেপের’ আহ্বান জানানোর পর তাঁকে পদ থেকে সরিয়ে দেয় সামরিক জান্তা।
পদচ্যুত হওয়ার পর কায়ো মোয়ে তুন এক সাক্ষাৎকারে বিবিসিকে বলেন, ‘আপনারা দেখেছেন গত তিন-চার দিনে আমাদের কত নিষ্পাপ ও তরুণপ্রাণ কেড়ে নেওয়া হয়েছে। আমরা মিয়ানমারের জনগণের সুরক্ষা চাই।’
এদিকে, কায়ো মোয়ে তুনকে সরানোর পর তাঁর ডেপুটি তিন মাউং নাইংকে জাতিসংঘে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দেয় সামরিক জান্তা। কিন্তু, পদত্যাগ করে তিন মাউং নাইং জানান, তিনি নন, এখনও কায়ো মোয়ে তুনই রাষ্ট্রদূত পদে বহাল আছেন।
কী হয়েছিল অ্যাঞ্জেলের?
মান্দালয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার অ্যাঞ্জেলের শেষকৃত্যানুষ্ঠানে জড়ো হয়েছিলেন হাজারো মানুষ। শেষ শ্রদ্ধা জানাতে শোকের মিছিলে যোগ দিতে দেখা যায় তাদের।
শোকের মিছিলে অংশগ্রহণকারী শোকার্তেরা বিপ্লবী গান এবং অভ্যুত্থানবিরোধী স্লোগান ধরেন বলে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
বিক্ষোভে অ্যাঞ্জেলের পরা ‘এভরিথিং উইল বি ওকে’ টি-শার্টের ছবি এরই মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।
বিক্ষোভে অংশ নিলে যে বিপদ হতে পারে, তা ভালোভাবেই জানতেন অ্যাঞ্জেল। তাই আগেই তিনি ফেসবুকে তাঁর রক্তের গ্রুপের তথ্য জানিয়ে রেখেছিলেন এবং মরণোত্তর অঙ্গদান করার কথাও জানিয়ে রেখেছিলেন।
অ্যাঞ্জেলের সঙ্গে বুধবার বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিলেন মিয়াত থু। তিনি বলেন, ‘বিক্ষোভকারীরা যাতে চোখে কাঁদানে গ্যাস লাগলে তা ধুয়ে নিতে পারেন, সে জন্য রাস্তার একটি পানির পাইপ ভেঙে সে ব্যবস্থা করেন অ্যাঞ্জেল। মিয়াত থু আরও জানান, পুলিশ গুলি চালালে অ্যাঞ্জেল তাঁকে সাহায্য করার চেষ্টা করেন।
মিয়াত থু বলেন, “সে (অ্যাঞ্জেলা) আমাকে বলেছিল, ‘বসে পড়! তোমার গায়ে বুলেট লাগবে! সে অন্যদের ব্যাপারে খেয়াল রাখতো, তাদের রক্ষা করতো।”
মিয়াত থু জানান, সেদিন পুলিশ প্রথমে তাঁদের ওপর কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে, পরে গুলি করা শুরু করে।
গত বছর জীবনে প্রথমবার জাতীয় নির্বাচনের ভোট দিয়েছিলেন অ্যাঞ্জেল। মিয়াত থু বলেন, ‘অ্যাঞ্জেল ছিল হাসিখুশি একটা মেয়ে। সে তার পরিবারকে ভালোবাসত, আর পরিবারও তাকে ভীষণ ভালোবাসত।’
‘আমাদের এখানে তো যুদ্ধ চলছে না। মানুষের ওপর গুলি চালানোর কোনো কারণই নেই’, যোগ করেন মিয়াত থু।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অ্যাঞ্জেলের প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন তাঁর স্বজন-বন্ধুসহ নেটিজেনরা। এক বন্ধু ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আমার হৃদয় ব্যথিত।’ আরেকজন লিখেছেন, ‘শান্তিতে থেকো বন্ধু আমার। আমরা এই বিপ্লবের শেষ পর্যন্ত লড়ে যাব।’
বিবিসি বার্মিজের সাংবাদিক মোয়ে মাইন্ট জানান, বিক্ষোভে কায়াল সিনের শেষ মুহূর্তের একটি ভিডিওতে দেখা গেছে—তিনি রাস্তায় তরুণ বিক্ষোভকারীদের একটি দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। যখন রাস্তার অন্য দিক থেকে নিরাপত্তা বাহিনী কাঁদানে গ্যাসসহ গুলি ছুড়তে শুরু করে তখন বিক্ষোভকারীরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। কিন্তু অ্যাঞ্জেল ছিলেন অবিচল। তিনি সবার উদ্দেশে চিৎকার করেন—‘আমরা কি ঐক্যবদ্ধ?’, সঙ্গে সঙ্গে সবাই সমস্বরে চিৎকার করে—‘ঐক্যবদ্ধ, ঐক্যবদ্ধ’।
এক পারিবারিক বন্ধুর ভাষায়, অ্যাঞ্জেল ছিলেন সত্যিকারের একজন অনুপ্রেরণাদায়ী নেত্রী।