ট্রাম্প ক্যাপিটলে সহিংসতার ‘প্রধান উসকানিদাতা’ : অভিশংসন শুনানিতে ডেমোক্র্যাটরা
মার্কিন সিনেটে অভিশংসন শুনানির দ্বিতীয় দিনে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে কংগ্রেস ভবন ক্যাপিটলে সহিংসতার প্রধান উসকানিদাতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ট্রাম্পকে তাঁর উশৃঙ্খল সমর্থকদের ‘ইনসাইটার ইন চিফ’ বা ‘প্রধান উসকানিদাতা’ উল্লেখ করে অভিশংসনের পক্ষের ডেমোক্রেটিক সিনেটরেরা বলেছেন, ক্যাপিটল হিলে হামলার সময় ট্রাম্প নিজের ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সসহ তাঁর রাজনৈতিক সহকর্মীদের মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছিলেন। সংবাদমাধ্যম বিবিসি ও ভয়েস অব আমেরিকা এ খবর জানিয়েছে।
মার্কিন কংগ্রেসের সিনেটে গতকাল বুধবার ছিল সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিশংসন বিচারের শুনানির দ্বিতীয় দিন। এর আগে গত মঙ্গলবার শুনানির কার্যক্রম শুরুর জন্য সাংবিধানিক বৈধতার বিষয়ে নিয়ম অনুযায়ী ভোটাভুটি হয়।
শুনানির দ্বিতীয় দিন গতকাল ডেমোক্র্যাটরা ডোনাল্ড ট্রাম্পকে দোষী সাব্যস্ত করতে নানা সময়ে ট্রাম্পের বলা কথা ও টুইট বার্তা ব্যবহার করেন। এ সময় ডেমোক্রেটিক সিনেটরেরা ট্রাম্পকে ক্যাপিটলে হামলায় উসকানির প্রধান হোতা হিসেবে উল্লেখ করে তথ্য-প্রমাণ হাজির করেন। বিচারপর্বে ডেমোক্র্যাটরা যুক্তি তুলে ধরেন যে, ক্যাপিটলে হামলার দিন ডোনাল্ড ট্রাম্প কোনো ‘নিরপরাধ দর্শক’ ছিলেন না, বরং কংগ্রেসম্যান জেমি রাসকিন বলেন, ট্রাম্প তাঁর সমর্থকদের ক্যাপিটল ভবনে ‘ফাইট লাইক হেল’ বা ‘মরণপণ ঝাঁপিয়ে পড়’ বলে উসকানি দিয়েছিলেন। যার ফলশ্রুতিতে এক নজিরবিহীন বিশৃঙ্খলা দেখেছে বিশ্ব। সেই সহিংসতার ঘটনায় সেদিন একজন পুলিশ কর্মকর্তাসহ পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছিল।
জেমি রাসকিন ১০০ সদস্যের সিনেটরদের উদ্দেশে বলেন, ‘ট্রাম্প এই হামলায় উসকানি দিয়েছেন এবং এই বিদ্রোহে উসকানি দেওয়ার কারণে তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করতে হবে। কারণ, ট্রাম্প ‘কমান্ডার ইন চিফের’ ভূমিকা ছেড়ে, ‘প্রধান প্ররোচনাকারীর’ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঐতিহাসিক দ্বিতীয় অভিশংসনের বিচারের মধ্য দিয়ে গত ৬ জানুয়ারি ট্রাম্প ক্যাপিটলে ভবনে তাঁর সমর্থকদের দিয়ে বিদ্রোহে প্ররোচিত করেছিলেন কি না, সে বিষয়ে সিনেটের রায় জানা যাবে।
ক্যাপিটলে হামলার ঘটনার জেরে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এই প্রথম সিনেটে কোনো সাবেক প্রেসিডেন্ট বিচারের সম্মুখীন হলেন।
ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০২০ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন বলে মিথ্যা দাবি করার পর তাঁর সমর্থকদের ইলেকটোরাল কলেজের ফলাফল বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের পক্ষে যেন না যায়, সেজন্য লড়াইয়ের আহ্বান জানিয়েছিলেন।
সিনেটর সংখ্যাগরিষ্ঠ দলীয় নেতা চাক শুমার বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এই প্রথমবার কোনো প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে ভয়ানক অভিযোগ আনা হয়েছে।’
গত ৬ জানুয়ারির দাঙ্গার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে এখন পর্যন্ত দুই শতাধিক লোককে অভিযুক্ত করা হয়েছে। আইনপ্রণেতারা সতর্ক করেছেন যে অভ্যন্তরীণ উগ্রবাদ এবং প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার অপব্যবহারের জন্য অনুপ্রেরণা হিসেবে ৬ জানুয়ারি দিনটি যেন প্রতিষ্ঠা না পায়।
এর আগে গত মঙ্গলবার হাউস ইমপিচমেন্ট ম্যানেজার জেমি রাসকিন বলেছিলেন, ‘এটা আমেরিকার ভবিষ্যৎ হতে পারে না। প্রেসিডেন্ট আমাদের সরকার ও আমাদের প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে জনতাকে উসকে দেবেন, উত্তেজিত করবেন, তা আমরা মেনে নিতে পারি না।’
ডেমোক্র্যাট ডেভিড সিসিলিন বলেন, ‘আমরা প্রমাণ করব যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এককভাবে এবং সরাসরি ক্যাপিটলে আক্রমণকে উসকে দেওয়ার জন্য প্রত্যক্ষভাবে দায়ী।’
এ ছাড়া অভিশংসনের বিচারে যুক্তি তোলা হয় যে, ট্রাম্প এখন প্রেসিডেন্ট না থাকলেও তাঁকে পরিণামের মুখোমুখি হতে হবে।
ডেমোক্র্যাট জো নেগুস বলেন, ‘প্রেসিডেন্টরা এভাবে বিদ্রোহ তৈরি করতে পারেন না এবং তারপর কিছুই হয়নি বলে চলে যেতে পারেন না।’
সংবাদমাধ্যম ডয়েচে ভেলের প্রতিবেদনে বলা হয়, ভার্জিনিয়ার ডেমোক্র্যাট প্রতিনিধি স্ট্র্যাসি প্ল্যাসকেট জানিয়েছেন, ট্রাম্প আগে থেকেই সব বুঝতে পেরেছিলেন। তারপরেও তিনি ইচ্ছে করে উসকানি দিয়েছিলেন। তিনি সহিংসতার আবহ তৈরি করে দিয়েছিলেন। তারপর তাঁর সমর্থকরা সহিংস হয়েছে।
ক্যাপিটল-তাণ্ডবের দিন সিকিউরিটি ক্যামেরায় ধরা পড়া ফুটেজও প্রকাশ করেছেন প্ল্যাসকেট। সেখানে দেখা যাচ্ছে, প্রাউড বয়জের বেশ কিছু সদস্য ক্যাপিটলে ঢুকে জানলার কাঁচ ভাঙছে। তারপর তারা করিডোরে ঢুকছে। ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স এবং অন্যদের নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আর দাঙ্গাকারীরা চিৎকার করছে, ‘মাইক পেন্সকে মার’, ‘ন্যান্সি পেলোসিসহ যাকে হাতের কাছে পাব, তাকেই মারব’।
প্ল্যাসকেটের বক্তব্য, ট্রাম্প এসব করার জন্যই সমর্থকদের পাঠিয়েছিলেন। দাঙ্গাকারীরা বিশেষ করে পেলোসিকে খুঁজছিল। তাঁর অফিসে ঢুকে তারা ভাঙচুর করে। একজনের হাতে ছড়ির মতো অস্ত্র ছিল। হাউসের সদস্যরা যখন নিরাপদ জায়গায় যাচ্ছিলেন, তখনই দাঙ্গাকারীরা হাউসে ঢুকে পড়ে। মিনিটখানেক আগে তারা ঢুকতে পারলেই ভয়ংকর অবস্থা হতো।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে দোষী সাব্যস্ত করার জন্য সিনেটের দুই-তৃতীয়াংশ ভোটের প্রয়োজন। তার অর্থ হচ্ছে ৫০ জন ডেমোক্র্যাটসহ অন্তত ১৭ জন রিপাবলিকান সিনেটরকেও ট্রাম্পকে দোষী সাব্যস্ত করার পক্ষে ভোট দিতে হবে।
অভিশংসন বিচারে ট্রাম্প দোষী সাব্যস্ত হলে সিনেটরেরা আবারও ভোটের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেবেন যে, ট্রাম্প পুনরায় প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না।
অন্যদিকে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরামর্শদাতা ডেভিড শোয়েন বলেন, ‘মার্কিনিরা এই প্রক্রিয়াটিকে মার্কিন রাজনৈতিক দৃশ্যপট থেকে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে সরিয়ে দেওয়ার এবং ৭৪ মিলিয়নের বেশি মার্কিন ভোটারদের রায়কে অবমাননা করার চেষ্টা হিসেবে দেখছে।’
সিনেটে এই অভিশংসন বিচারে ডেমোক্রেটিক ও রিপাবলিকান—উভয় পক্ষকে যুক্তিতর্ক এবং প্রমাণ উপস্থাপনের জন্য ১৬ ঘণ্টা করে দেওয়া হবে এবং এই বিচার চলবে অন্তত রোববার পর্যন্ত।