ঢাকায় তৎপরতা বাড়াতে ব্রিটিশ সহায়তা চেয়েছিল নিষিদ্ধ সংগঠন উলফা!
নিজেদের কার্যকলাপ চালিয়ে যেতে ব্রিটিশ কূটনীতিকদের দ্বারস্থ হয়েছিল ভারতের আসামের নিষিদ্ধ সংগঠন ‘উলফা’। এমন তথ্য জানাচ্ছে লন্ডনের ন্যাশনাল আর্কাইভসের সদ্য প্রকাশিত কিছু নথি। সংবাদমাধ্যম দ্য হিন্দুস্তান টাইমস জানিয়েছে, ১৯৯০ সালে প্রফুল্ল কুমার মহান্তের নেতৃত্বাধীন আসাম সরকার বরখাস্ত হওয়ার কয়েকদিন আগে ঢাকায় এক ব্রিটিশ কূটনীতিকের সঙ্গে দেখা করে উত্তর–পূর্ব ভারতের অন্যতম বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব ইন্ডিয়ার (উলফা) তিন শীর্ষ কর্মকর্তা। এর কিছুদিন পরই উলফার বিরুদ্ধে ‘অপারেশন বজরঙ’ অভিযান চালায় ভারতীয় সেনাবাহিনী।
যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল আর্কাইভসের প্রকাশিত ওই নথি অনুযায়ী, সেসময় আসামের চা বাগানের প্রতি বাণিজ্যিক আগ্রহ প্রকাশ করা যুক্তরাজ্যের কাজে বাধা দিচ্ছিল নিষিদ্ধ সংগঠন ‘উলফা’। আবার একই সময়ে নিজেদের টিকিয়ে রাখার জন্য ব্রিটিশ সরকারের সহায়তারও প্রয়োজন ছিল তাদের। সে কারণেই ডেভিড অস্টিন নামের ওই কূটনীতিককে আসামে নিজেদের ক্যাম্প ও ডেরাগুলো ঘুরে দেখানোর ইচ্ছা প্রকাশ করে ‘উলফা’।
১৯৯০ সালে যখন আসাম রাজনৈতিক ডামাডোলের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল, তখন প্রফুল্ল কুমার মহান্তের নেতৃত্বাধীন আসাম গণপরিষদ (এজিপি) ভি পি সিংয়ের নেতৃত্বে জাতীয় ফ্রন্ট (এনএফ) সরকারের একটি অংশ ছিল। কিন্তু জাতীয় ফ্রন্ট সরকারের পতনের পর ২৭ নভেম্বর আসাম গণপরিষদ শাসিত সরকার বাতিল হয়ে যায়। এরপরই সংখ্যালঘুদের নিয়ে আসামে নতুন সরকার গঠন করেন চন্দ্র শেখর।
এরপর ১৯৯০ সালের ২ অক্টোবর ব্রিটিশ কূটনীতিক ডেভিড অস্টিনের সঙ্গে দেখা করে উলফার তিন নেতা— সাধারণ সম্পাদক অনুপ চেটিয়া (যাঁর আসল নাম গোলাপ বড়ুয়া), প্রচার সম্পাদক সিদ্ধার্থ ফুকান (যাঁর আসল নাম সুনীল নাথ) ও ইকবাল। ওই সাক্ষাৎ পর্বকে ব্যাখ্যা করতে লন্ডনে পাঠানো একটি নোটে শুধুমাত্র একটি শব্দ ব্যবহার করেন ডেভিড; আর, তা হলো— ‘চিত্তাকর্ষক’।
এরপর একই বছরের ৪ অক্টোবর লন্ডন হেডকোয়ার্টারে পাঠানো একটি নোটে ডেভিড অস্টিন জানান, উলফার অনুপ্ররণা ইসরায়েল। অস্টিন মন্তব্য করেন, ‘শত্রু আরব দুনিয়া চতুর্দিক থেকে ঘিরে রাখার পরও যদি ইসরায়েল স্বাধীন হতে পারে, তবে ভারতীয় সেনাবাহিনী ঘিরে থাকার পরও আসাম নিজের রাষ্ট্র ঘোষণা করতে পারবে না কেন?’
ডেভিড অস্টিনকে সেসময় আসামের লখিমপুর জেলার একটি প্রশিক্ষণ শিবির, কিছু লিফলেটসহ বেশ কয়েকটি ছবি দেখিয়েছিল উলফা। তার মধ্যে একটি ছবি ছিল চীন সীমান্তের। তাতে চীনা সেনাবাহিনীর তৎকালীন জনসংযোগ কর্মকর্তার সঙ্গে উলফার অন্যতম সেনাপ্রধান পরেশ বড়ুয়াকে দেখা গেছে।
ডেভিড অস্টিন তাঁর নোটে আরো লিখেছেন, ‘উলফার ওই তিন সদস্য মূলত চারটি সহায়তা বা পরামর্শ চেয়েছে— এক, উলফার কার্যকলাপ ও লক্ষ্যগুলোকে প্রচার করতে যুক্তরাজ্যের সমর্থন। দুই, ইংল্যান্ডে উলফা নিজেদের দপ্তর স্থাপন করতে পারবে কিনা, সে ব্যাপারে পরামর্শ। তিন, ঢাকায় অন্যান্য পশ্চিমা দূতাবাস বা কূটনৈতিক মিশনগুলোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া; এবং চার, সহায়তার ব্যাপারে ইসরায়েল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগের উপায়।
উলফার বিভিন্ন প্রশিক্ষণ শিবিরে যাওয়ার ডাকে কান দেননি ডেভিড অস্টিন। তিনি লিখেছেন, ‘উলফার প্রচার পাওয়ার এই কৌশল একেবারে নতুন ছিল। ভারতের রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইংয়ের (র) হস্তক্ষেপ ছাড়াই বাংলাদেশে বিদেশি কূটনৈতিক মিশনগুলোতে যেতে সক্ষম হয়েছিল উলফা। যেটা নয়াদিল্লিতে কোনোভাবেই পারেনি তারা।’
ডেভিড অস্টিনের ওই নোটকে ১৯৯০ সালের ৫ নভেম্বর ‘অসাধারণ’ বলে উল্লেখ করেন দিল্লিতে ব্রিটিশ হাইকমিশন দপ্তরের কূটনীতিক ডি ডি ডব্লুউ মার্টিন। মার্টিন ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তরের উদ্দেশে লেখেন, ‘তারা (উলফা) এখন পশ্চিমা কূটনীতিকদের নিশানা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’ মার্টিনের মতে, ডেভিড অস্টিনের নোটে চীনের ব্যাপারে যা কিছু উল্লেখ রয়েছে তা বেশ ‘নতুন ও আকর্ষণীয়’।
ব্রিটিশ কূটনীতিক ডি ডি ডব্লুউ মার্টিন লিখেছেন, ‘এর আগে আসামেরই এক কংগ্রেস বিধায়কের মুখে চীন ও উলফার এই ভ্রাতৃত্বের ব্যাপারে শুনেছিলাম। তাঁর অভিযোগ ছিল, চীনের এই আধিপত্যের ব্যাপারে সবকিছুই জানতেন ভারতীয় গোয়েন্দারা। কিন্তু ভারত–চীন সম্পর্ক অটুট রাখতে তাঁরা এ ব্যাপারে মুখ বন্ধ রাখেন।’