তাজমহলের তালাবদ্ধ কক্ষগুলোতে কী লুকিয়ে আছে?
সম্প্রতি তাজমহলের তালাবদ্ধ কক্ষগুলো নিয়ে শুরু হয়েছে নানা জল্পনা-কল্পনা। তালাবদ্ধ এ কক্ষগুলোর পেছনে আদৌ কোনো গোপন রহস্য লুকিয়ে রয়েছে কি না, তা নিয়ে চলছে বাগ্বিতণ্ডা।
সংবাদমাধ্যম বিবিসি জানিয়েছে–তাজমহলের তালাবদ্ধ কক্ষের বিষয়ে ভারতের হাইকোর্টে পিটিশন দায়ের করেন রজনীশ সিং নামের ভারতের ক্ষমতাসীন দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) এক সদস্য। তাজমহলের ২০টির বেশি ‘স্থায়ীভাবে বন্ধ কক্ষ’ খুলে ‘স্মৃতিস্তম্ভের (তাজমহল) প্রকৃত ইতিহাস’ খুঁজে বের করার দাবি জানানো হয়েছিল ওই পিটিশনে।
কিন্তু, গত বৃহস্পতিবার এক শুনানির পর পিটিশনটি খারিজ করে দেন ভারতীয় আদালত। কেননা, তাজমহলের তালাবদ্ধ ওই কক্ষগুলোর নেপথ্যে কোনো রহস্য নেই বলেই মনে করছেন বিচারকেরা।
খারিজ করা ওই পিটিশনে রজনীশ বলেছিলেন, ‘ইতিহাসবেত্তা ও হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের দাবি’ অনুযায়ী, তাজমহলের ওই কক্ষগুলোতে হিন্দু দেবতা শিবের মন্দির রয়েছে। এই দাবি সত্য কি না, সেটিই জানতে চান রজনীশ। তিনি বদ্ধ ওই কক্ষগুলোর পেছনে ‘লুকানো রহস্য’ সামনে নিয়ে আসতে আদালতকে অনুরোধ করেছিলেন।
রজনীশ সিং তাজমহলের যে কক্ষগুলো খুলে দেওয়ার দাবি করেন, সে কক্ষগুলো আসলে স্মৃতিসৌধটির ভূগর্ভে অবস্থিত।
এবা কচ মুঘল স্থাপত্যরীতির একজন বিশিষ্ট ও নেতৃস্থানীয় গবেষক ও লেখক। গবেষণার সময় তিনি তাজমহলের বেশ কিছ বন্ধ কক্ষ এবং সেগুলোর বারান্দা খুঁজে পেয়েছিলেন। তিনি সেগুলোর ছবিও তুলে রেখেছিলেন।
ওই কক্ষগুলো একটি ‘তাহখানা’র অংশ ছিল, যা মূলত গ্রীষ্মের দাবদাহ থেকে আরাম পাওয়ার জন্য তৈরি করা হয়েছিল। কচ এ ধরনের ১৫টি কক্ষ খুঁজে পেয়েছিলেন।
বিবিসি বলছে—তাজমহলে এমন সাতটি বিশাল কক্ষ ছিল, যেগুলো দুপাশে কুলুঙ্গির মাধ্যমে বড় করা হয়েছিল। এ ছাড়া ছয়টি মোটামুটি বর্গাকৃতির কক্ষ এবং দুটি অষ্টভুজাকৃতি কক্ষও ছিল।
এসব কক্ষের বিষয়ে ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ের এশীয় শিল্পবিষয়ক অধ্যাপক এবা কচ লিখেছেন, ‘সম্রাট যখন তাঁর পত্নী-উপপত্নী ও সমভিব্যাহারীরা যখন সমাধিটি ভ্রমণে আসতেন, তখন নিশ্চয়ই এ ঘরগুলো বেশ আলো-বাতাসপূর্ণ ছিল। (কিন্তু), এখন আর এগুলোতে প্রাকৃতিক আলো প্রবেশ করতে পারে না।’
এ ধরনের ভূগর্ভস্থ কক্ষ মুঘল স্থাপত্যের পরিচিত নিদর্শন। পাকিস্তানের লাহোর শহরের একটি মুঘল দুর্গে এবং বিভিন্ন জলাধারের কাছাকাছি এ ধরনের বহু কক্ষ মুঘল আমলে নির্মাণ করা হয়েছিল।
সম্রাট শাহজাহান প্রায়ই যমুনা নদী দিয়ে নৌকায় করে তাজমহলে আসতেন। প্রশস্ত ঘাট পার হয়ে তিনি তাজমহলে ভেতরে প্রবেশ করতেন।
অমিতা বেগ নামের এক ভারতীয় গবেষক প্রায় ২০ বছর আগে তাজমহল দেখতে গিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘তাজমহলে ঘুরতে গিয়ে ওই সুন্দর নকশা-কাটা বারান্দা দেখার কথা আমার এখনও মনে আছে। এ বারান্দা শেষ হয়েছে একটি বড় চত্বরের সামনে এসে। স্পষ্টই বোঝা যায়—স্বয়ং সম্রাট এ বারান্দায় হাঁটাচলা করতেন।’
আগ্রায় জন্ম নেওয়া দিল্লিভিত্তিক ইতিহাসবিদ রানা সাফভি’র তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৮ সালের বন্যা পর্যন্ত তাজমহলের ভূগর্ভস্থ কক্ষগুলো দর্শকের জন্য উন্মুক্ত ছিল।
‘বন্যার পানি তাজমহলের ভেতরে ঢুকে যায়। এতে অনেকগুলো পাতালঘর কাদামাটিতে ভরে যায়। এমনকি কোনো কোনোটিতে ফাটলও দেখা দেয়। এরপর কর্তৃপক্ষ সাধারণ দর্শনার্থীদের জন্য ওই ঘরগুলো বন্ধ করে দেয়। ওগুলোর ভেতরে কিছুই নেই’, বলেন রানা সাফভি।
ওই ঘরগুলো সংস্কার কাজের জন্য সময়ে সময়ে খোলা হয় বলে বিবিসি জানিয়েছে।
বিশ্বের অন্যসব আশ্চর্য স্থাপত্য নিদর্শনের মতো তাজমহল নিয়েও নানা গল্পকথা ও কিংবদন্তি প্রচলিত আছে। যেমন, অনেকে মনে করেন—শ্বেতপাথরের তাজমহলের উলটো দিকে সম্রাট শাহজাহান আরেকটি ‘কালো তাজমহল’ তৈরি করতে চেয়েছিলেন এবং তাজমহল নির্মাণ করেছিলেন কোনো এক ইউরোপীয় স্থপতি।
কিছু পশ্চিমা পণ্ডিত মনে করেন, মুঘল আমলে মুসলিম সমাজে নারীদের যেমন নিচু অবস্থানে দেখা হতো, সে সমাজের একজন নারীর জন্য তাজমহল নির্মিত হতে পারে না। তবে, এ ধরনের মতবাদ—মুসলিম-বিশ্বের নারীদের জন্য নির্মিত অন্যান্য সমাধিগুলোকে উপেক্ষা করেছে বলে ধরে নেওয়া যায়।
এ ছাড়া তাজমহলে আসা পর্যটকদের কাছে সেখানকার অত্যুত্সাহী গাইডেরা স্থাপত্যটির নির্মাণ সম্পন্ন হওয়ার পরে কীভাবে সম্রাট শাহজাহান তাজমহলের স্থপতি ও শ্রমিকদের হত্যা করেছিলেন, সে সম্পর্কে নানা গল্প করে থাকেন।
ভারতে তাজমহল নিয়ে নানা প্রচলিত গল্পকথার মধ্যে একটি হলো—এখন তাজমহল যেখানে, সেটি আসলে ছিল একটি শিব মন্দির। আরও শোনা যায়—১৭৬১ সালে সরজ মাল নামের এক হিন্দু রাজা আগ্রা দখল করে নেওয়ার পরে তাঁর রাজসভার এক পুরোহিত তাজমহলকে মন্দিরে রূপান্তরে পরামর্শ দেন। পিএন ওক নামের গবেষক তাঁর একটি বইতে দাবি করেছেন—তাজমহল আসলে শিবমন্দির ছিল।
২০১৭ সালে সংগীত সোম নামের এক বিজেপিনেতা তাজমহলকে ভারতীয় সংস্কৃতিতে ‘কলঙ্ক’ বলে অভিহিত করেন। কারণ, তাঁর মতে এটি বিশ্বাসঘাতকদের হাতে নির্মিত।
চলতি সপ্তাহে দিয়া কুমারী নামের এক বিজেপি এমপি দাবি করেন, সম্রাট শাহজাহান এক হিন্দু রাজ পরিবারের জমি দখল করে সেখানে তাজমহল বানিয়েছেন।
ইতিহাসবিদ রানা সাফভি বলেন, গত এক দশকে ডানপন্থিদের একটি অংশের কাছে তাজমহল নিয়ে ষড়যন্ত্রতত্ত্বগুলো নতুন মাত্রা পেয়েছে। যেমন—গবেষক ও লেখক কচের ভাষায়, ‘অবস্থাদৃষ্টে বলতেই হচ্ছে—তাজমহলকে নিয়ে গবেষণাধর্মী লেখার চেয়ে গালগল্পই বেশি হয়েছে।’
বিশ্বের সপ্তাশ্চর্যের একটি—তাজমহল। তাজমহলকে মুঘল স্থাপত্যশৈলীর এক অনন্য নিদর্শন হিসেবে দেখা হয়। সাদা মার্বেলের গম্বুজ আর দৃষ্টিনন্দন কারুকাজের জন্যই বেশি সমাদৃত রাজকীয় সমাধিটি। কিন্তু, তাজমহল আসলে সামগ্রিকভাবে এক জটিল ও অখণ্ড স্থাপত্য। বলা হয়ে থাকে—মুঘল সম্রাট শাহজাহান তাঁর প্রিয়তম স্ত্রী আরজুমান্দ বানু বেগমের স্মৃতির উদ্দেশে অপূর্ব-অনন্যসাধারণ এ সৌধটি নির্মাণ করেন। আরজুমান্দ বানু বেগম তাঁর ১৪তম সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা যান। তিনি মুমতাজ বা মমতাজ নামেও পরিচিত ছিলেন। আর, তাঁর এ নামের সঙ্গে মিল রেখেই তাঁর সমাধির নাম হয় ‘তাজমহল’।