পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর ওপর কেন এতো ক্ষোভ ইমরান সমর্থকদের
গত ৯ মে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় শহর লাহোরে ধারণ করা ৩৪ সেকেন্ডের একটি ভিডিওতে দেখা যায়, একদল লোক একটি বিলাসবহুল বাড়িতে প্রবেশ করছেন। তাদের মধ্যে ছিলেন নারীরাও। হাতে ছিল লাঠিসোটা। তারা ইমরান খানের পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) দলের পতাকা নিয়ে শ্লোগান দিচ্ছিলেন।
যে লোকটি ভিডিও ধারণ করছিলেন তাকে বলতে শোনা যায়, ‘লোকজন ভেঙে ফেলা গেট দিয়ে প্রবেশ করেছে আর এই মুহূর্তে রয়েছে কোর কমান্ডারের বাসভবনে।’ একজন জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তার কথা বলা হয় এসময়। এরপর তিনি বাগানের কোনায় দাঁড়িয়ে থাকা একজন সৈন্যের দিকে এগিয়ে যান। এসময় জনতা ওই মাঠে প্রবেশ করে আর বলে ওঠে, ‘স্যার, আমরা বলেছিলাম ইমরান খানকে ছোঁবেন না।’
ওই বিলাসবহুল বাড়িটি লাহোরে শুধুমাত্র একজন শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তার বাসভবনই নয়, পাশাপাশি দেশটিতে রয়েছে এর ঐতিহাসিক তাৎপর্য। ভবনটির নাম জিন্নাহ হাউস, যা পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর নামে প্রতিষ্ঠিত। সেই ভবনটিতেই পরে আগুন ধরিয়ে দেয় প্রতিবাদকারীরা।
ইসলামাবাদের আদালতে দুর্নীতির মামলায় হাজিরা দিতে গেলে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে দেশটির জাতীয় দায়বদ্ধতা ব্যুরো (এনএবি) যখন গ্রেপ্তার করে ঠিক তার পরপরই, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া এই ভিডিওটি ধারণ করা হয়।
এ ধরনের আরও বেশ কয়েকটি ভিডিওতে দেখা যায়, ইমরান খানকে গ্রেপ্তারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারীরা বিভিন্ন শহরে পাকিস্তানের শক্তিশালী সেনাবাহিনীর বিভিন্ন স্থাপনা ও ভবন লক্ষ্য করে হামলা চালাচ্ছে।
গ্যারিসন শহর রাউয়ালপিন্ডিতে ধারণ করা একটি ভিডিওতে দেখা যায় সুরক্ষিত একটি কমপ্লেক্সের প্রবেশমুখে একজন নারী প্রতিবাদকারী গেট খুলে দেওয়ার জন্য চিৎকার করছে আর কয়েকজন নারী তাকে ঘিরে আছে।
আরেকটি ভিডিওতে দেখা যায় পিটিআইয়ের পতাকা নিয়ে কয়েকশ’ লোক পিটিআইয়ের স্কার্ফ পরে ওই গেটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ গেট বেয়ে ওঠার চেষ্টা করছে আর লাঠি দিয়ে সেখানে আঘাত করছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট রুল জারি করে বলে যে, ইমরান খানকে অবৈধভাবে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ কারণে দ্রুত তাকে মুক্তির নির্দেশও দেওয়া হয়। আর আজ তাকে দুই সপ্তাহের জামিনে মুক্তি দেওয়া হয়।
দেশটির অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর রয়েছে প্রচণ্ড প্রভাব। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর দেশটির সেনাবাহিনী তিনবার ক্ষমতা দখল করে। তিন যুগেরও বেশি সময় দেশটি শাসন করে সেনাবাহিনী।
২০১৮ সালে ইমরান খানের পিটিআই যখন জাতীয় নির্বাচনে ঐতিহাসিক জয়লাভ করে, তখন বিরোধী রাজনীতিকরা ও পর্যবেক্ষকরা বলেছিলেন, সেনাবাহিনীর সমর্থনের কারণেই তার বিজয় হয়েছে। এমনকি, কেউ কেউ ভোট কারচুপির অভিযোগও আনে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। ২০১৮ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় সেনাবাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে ইমরানের নিবিড় সমন্বয়েরও ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তবে, ইমরান খান ও সেনাবাহিনীর মধ্যে তৈরি হওয়া উত্তেজনা পররাষ্ট্র নীতিতেও প্রভাব ফেলে। বাড়তে থাকা উত্তেজনার মধ্যেই ২০২২ সালে ইমরানকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়, এজন্য সেনাবাহিনী নেপথ্যে ভূমিকা রেখেছে বলে অভিযোগ করে আসছেন তিনি।
এ প্রসঙ্গে লাহোরের অধিবাসী আবদুল আজিজ বলেন, ‘ইমরান খান সব সময় বলতেন, তার শাসনামলে পাকিস্তানের জন্য শক্তিশালী সেনাবাহিনী দরকার। এটি এই দেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আর আমরা ভেবেছিলাম, তারা সেটি বুঝবে। তবে, আস্থা ভোটে হেরে যান তিনি। এটি ছিল দুঃখজনক। আমি কখনও ভাবিনি, ঘটনা এতো দূর যাবে।’
২০২২ সালের এপ্রিল মাস থেকে ইমরান খান দেশজুড়ে সমাবেশ করে আসছেন। তার প্রধান দাবি ছিল এ বছরের অক্টোবরের মধ্যে আগাম নির্বাচন। গত বছরের নভেম্বরে তার ওপর আততায়ীর হামলাও চালানো হয়। ইমরান দাবি করেন, তাকে হত্যা করতে চালানো ওই হামলার যড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত রয়েছে সরকার ও কিছু সামরিক কর্মকর্তা।
এ প্রসঙ্গে খাইবার পাখতুনওয়ালা প্রদেশের একজন অধিবাসী আবদুল্লাহ আফ্রিদি আল-জাজিরাকে বলেন, ‘সেনাবাহিনী যতক্ষণ দেশের সংবিধান ও আমাদের নেতার পাশে ছিল, আমরা সেনাবাহিনীর পাশে ছিলাম। আমরা মনে করেছিলাম, তারা কোনটা সঠিক বা বেঠিক–তা বোঝেন। কিন্তু, যখন আমরা দেখলাম, সেনাবাহিনী ইমরান খান ও তার আদর্শের বিরুদ্ধে চলে গেল এবং আমাদের কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা করা হলো, আমি আর তাদের সঙ্গে থাকতে পারলাম না।’
গত মঙ্গলবার লাহোরে সামরিক কমান্ডারের বাড়ি তছনছ করার ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন আজিজ। তিনি আল-জাজিরাকে বলেন, ‘ইমরানের প্রতি যে বর্বরতা দেখানো হয়েছে, তার একটি সীমা থাকা দরকার। সীমা অতিক্রম করলে বিস্ফোরণ ঘটে। তখন কিছু করার থাকে না।’
যদিও হামলার ঘটনায় জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেন আজিজ, তবে তিনি বলেন, ‘প্রতিবাদকারীরা যাতে ওই বাসভবনে হামলা চালায়, সেজন্য বেশ কিছু অপরিচিত মুখ তাদের প্ররোচিত করেছিল।’
আজিজ বলেন, ‘আমরা আমাদের প্রতিবাদ শান্তিপূর্ণ উপায়ে প্রকাশ করে আসছিলাম। তবে, যখন আপনার পিঠ দেয়ালে ঠেকে যাবে, তখন জনতা প্রতিরোধ করে তুলবে আর শেকল ছিঁড়ে ফেলবে। যখন জনতা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে, তখন তাদের নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন।’
খাইবার প্রদেশের একজন রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী আফ্রিদি জানান, তিনি পেশওয়ারের বালা হিসার দুর্গের সামনে বিক্ষোভে অংশ নিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘এটা বলা যেতে পারে যে, আমাদের প্রতিবাদ বেআইনি বা ভুল ছিল। কিন্তু, সেনাবাহিনী যে কাজ করছে, সেটা সম্পর্কে কেন কেউ কিছু বলছে না?’