বিজ্ঞান সাময়িকী বলছে, বসে প্রস্রাব করা ভালো
বেশিরভাগ পুরুষ হয়তো ভাবনাচিন্তা না করেই মূত্রত্যাগের কাজটি সেরে ফেলেন, কিন্তু তারা কিভাবে প্রস্রাব করেন, তা কিসের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়?
অনেক সমাজে বাচ্চাদের শেখানো হয় ছেলেরা দাঁড়িয়ে মূত্রত্যাগ করবে আর মেয়েরা বসে। কিন্তু বহুল প্রচলিত ও আপাতদৃষ্টিতে নির্বিচার জলবিয়োগের এই ধরন নিয়ে বিভিন্ন দেশের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ এখন প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন।
বিবিসি বাংলার খবরে বলা হয়েছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুরুষের প্রস্রাব করার ধরন পরিবর্তনের পেছনে সুস্বাস্থ্য ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাকে কারণ হিসেবে বিবেচনার কথা বলা হয়। তবে কারো কাছে আবার এটি সমান অধিকারের প্রশ্নও বটে। কিন্তু তাহলে পুরুষের জন্য সবচেয়ে ভালো উপায়টা কী?
কম সময়ে কর্ম-সম্পাদন
বেশিরভাগ পুরুষের জন্য মূত্রত্যাগের কাজটি দাঁড়িয়ে করাই সবচেয়ে সহজ। পুরুষদের পাবলিক টয়লেটের সামনে দাঁড়ালেই আপনি বুঝতে পারবেন, কাজটি সারতে আসলেই কত কম সময় লাগে এবং তা বাস্তবসম্মতও। দেখবেন কোনো লম্বা লাইন নেই। ছেলেরা যেন টয়লেটে ঢোকে আর মূহুর্তের মধ্যেই বেরিয়ে আসে।
মূলত দুইটি কারণে এটা ঘটে :
১. পুরুষরা দ্রুত প্রস্রাব করতে পারে, কারণ তাদেরকে শরীর থেকে কয়েক স্তরের কাপড় সরাতে হয় না, আর
২. যেহেতু ইউরিনাল অর্থাৎ পুরুষদের মূত্রত্যাগের কমোডের জন্য কম জায়গা প্রয়োজন হয়, সে কারণে এক জায়গায় বেশি সংখ্যক ইউরিনাল বসানো যায় এবং বেশি পুরুষ এক সঙ্গে মূত্রত্যাগ করতে পারেন।
কিন্তু বেশ কয়েকটি বিশেষায়িত ওয়েবসাইট বলছে, মূত্রত্যাগের সময় শরীরের পজিশনের কারণে প্রস্রাবের পরিমাণ কম-বেশি হতে পারে।
মূত্রত্যাগের শারীরিক প্রক্রিয়া
মানুষের কিডনিতে উৎপাদন হয় মূত্র, যা আমাদের রক্ত থেকে বর্জ্যকে সরিয়ে দেয়। এরপর সেটি আমাদের ব্লাডারে সংরক্ষিত হয়, যার ফলে যখন-তখন টয়লেটে যাওয়ার বেগ ছাড়াই আমরা দৈনন্দিন কাজকর্ম যথাযথভাবে সমাধা করতে এবং রাতে ঘুমাতে পারি। যদিও ব্লাডারের সর্বোচ্চ ধারণক্ষমতা ৩০০ থেকে ৬০০ মিলিলিটার পর্যন্ত, কিন্তু সাধারণত দুই-তৃতীয়াশ ভর্তি হলেই মানুষ প্রস্রাবের বেগ অনুভব করে।
আর ব্লাডার পুরোপুরি খালি করতে হলে, একজন মানুষের স্নায়বিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বা ‘নার্ভাস কন্ট্রোল সিস্টেম’ হতে হবে একেবারে যথার্থ, অর্থাৎ যা শরীরকে সংকেত দেবে কখন টয়লেটে যেতে হবে, কিংবা যদি তখন টয়লেটের ব্যবস্থা না থাকে, প্রস্রাব আটকে রাখতে পারবে।
এরপর অবস্থা যখন সুবিধাজনক হবে, তখন মানুষের পেলভিক ফ্লোরের মাংসপেশিসমূহ এবং ব্লাডারের স্ফিংটার মানে টিউবের চারপাশ ঘিরে যে গোলাকৃতি মাংসপেশি থাকে, যাকে মূত্রনালী বলা হয়, তা শিথিল হয়। ব্লাডার তখন সংকুচিত হয় এবং জমা হওয়া তরল মূত্রনালীতে পাঠিয়ে দেয়, এবং এরপরই প্রস্রাব করে একজন মানুষ।
বসে না দাঁড়িয়ে?
একজন সুস্থ মানুষের মূত্রত্যাগে অসুবিধা হবার কথা নয়। কিন্তু হতে পারে একজন পুরুষের হয়তো কোনো কারণে প্রস্রাব করতে সাময়িক অথবা স্থায়ী সমস্যা থাকতে পারে। বিজ্ঞান সাময়িকী প্লোস ওয়ানের এক জরিপ অনুযায়ী, যেসব পুরুষের প্রোস্টেটে জ্বালাপোড়ার সমস্যা থাকার কারণে জলবিয়োগে সমস্যা হয়, বসে মূত্রত্যাগ করলে তাদের সুবিধা হবে।
এই গবেষণায় সুস্থ পুরুষ এবং প্রোস্টেটে সমস্যা আছে, তাদের মধ্যে তুলনা করা হয়েছে। এতে দেখা গেছে, যেসব পুরুষের প্রোস্টেটে সমস্যা মানে লোয়ার ইউরিনারি ট্র্যাক্ট সিমটম রয়েছে, তাদের জন্য বসে মূত্রত্যাগ করলে মূত্রনালীতে চাপ কম পড়ে। এবং এর ফলে জলবিয়োগের কাজটি আরামদায়ক এবং দ্রুত সমাধা সম্ভব। কিন্তু স্বাস্থ্যবান পুরুষদের জন্য বসে বা দাঁড়িয়ে মূত্রত্যাগে বিশেষ কোনো পার্থক্য দেখা যায়নি।
যাদের মূত্রত্যাগে সমস্যা রয়েছে, যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস বলছে, তাদের উচিত আরামদায়ক এবং শান্ত পরিবেশে বসে প্রস্রাব করা। তবে প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, বসে প্রস্রাব করলে প্রোস্টেট ক্যানসার ঠেকানো সম্ভব এবং এর ফলে পুরুষের যৌন জীবন আরো ভালো হয়। তবে এসব ধারণার পক্ষে প্লোস ওয়ানের গবেষণায় কোনো প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়নি।
সবার জন্য এক টয়লেট কি স্বাস্থ্যকর?
যতদূর জানা যায়, ২০১২ সালে সুইডেনের একটি ঘটনা থেকে এ আলোচনার সূত্রপাত। সেখানকার একজন স্থানীয় রাজনীতিবিদ তাঁর শহরের পাবলিক টয়লেটের অবস্থা দেখে বিরক্ত হয়ে এর সমাধান খোঁজার ঘোষণা দেন।
হাইজিনের বিষয়টি মাথায় রেখে তিনি ঘোষণা দেন যে তিনি চান, টয়লেটে গিয়ে মানুষকে ‘সন্দেহজনক ঘোলাটে জলীয় পদার্থের’ মুখোমুখি হতে হবে না। সেই বিতর্ক পরে বেশ কয়েকটি ইউরোপীয় দেশে বিশেষ করে জার্মানিতেও ছড়িয়ে পড়ে। জার্মানিতে পাবলিক টয়লেটে সাধারণ কমোডে দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করা নিষেধ।
কোনো কোনো টয়লেটে ট্রাফিক লাইটের মত লাল সংকেত দিয়ে ‘দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করা নিষেধ’ বিষয়টি মনে করিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু আবার যারা বসে মূত্রত্যাগ করেন, তাঁদের ‘সিটজস্পিঙ্কলার’ বলা হয়। এর অর্থ দাঁড়ায়, ওই কাজটি ঠিক পুরুষালী নয়। এর প্রভাব গিয়ে পড়ে বেসরকারিভাবে পরিচালিত আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলোতেও, সেখানে কখনো কখনো টয়লেটের পাশে রাখা সাইনপোস্টে আহ্বান জানানো হয়, যেন পুরুষ অতিথিরা বসে কাজটি সারেন।
২০১৫ সালে জার্মানিতে একটি মামলা হয়েছিল, যেখানে বাড়িমালিক দাবি করেন, বাড়ির বাথরুমের মেঝে অতিথির প্রস্রাবের কারণে নষ্ট হয়েছে। সেজন্য তিনি ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা করেন। রায়ে বিচারক বলেন, বাড়িমালিকের প্রত্যাশিত পদ্ধতিটি তাঁর সাংস্কৃতিক আচারের সঙ্গে সম্পর্কিত, কিন্তু ‘দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করাটাই সাধারণত সবখানে চালু আছে’।