যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা ‘অমানবিক ও বেআইনি’, বলল ইরান
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব এবং যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা বিষয়ে একটি বিবৃতি দিয়েছে ঢাকায় ইরানের দূতাবাস। এনটিভি অনলাইনের পাঠকের জন্য ইরানি দূতাবাসের বিবৃতিটি হুবহু দেওয়া হলো।
“বর্তমান সময়ে করোনাভাইরাস বিশ্ব ও গোটা মানবসমাজের জন্য বড় বিপদ হিসেবে দেখা দিয়েছে। প্রতিদিনই এই ভাইরাস একদেশের সীমানা পেরিয়ে ঢুকে পড়ছে অন্য দেশে। এর ফলে বিশ্বের প্রতিটি দেশের নাগরিকদের মধ্যে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়া নিয়ে আতঙ্ক বিরাজ করছে। এমন এক পরিস্থিতিতে আক্রান্ত দেশ ও জাতিগুলোকে ঐক্যবদ্ধ ও সম্মিলিতভাবে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসা সকল দেশ ও জাতির অপরিহার্য দায়িত্ব। এরপাশাপাশি এই ভাইরাসের প্রকোপ নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে সর্বাত্মকভাবে তড়িৎ পদক্ষেপ গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি।
‘দুঃখজনক বিষয় হলো এই কঠিন দুঃসময়ে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান যখন করোনাভাইরাসের সর্বগ্রাসী আক্রমনের হাত থেকে দেশের জনগণকে রক্ষার জন্য সচেষ্ট এবং এইভাইরাস নিমূলের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টায় লিপ্ত ঠিক তখনও তেহরানকে যুক্তরাষ্ট্রের একতরফা অন্যায় নিষেধাজ্ঞা মোকাবিলা করতে হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের এই অমানবিক পদক্ষেপ জাতিসংঘ সনদ এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংবিধিন পরিপন্থী। যুক্তরাষ্ট্রের এহেন কর্ম একদিকে যেমন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ইরানি নাগরিকদেরকে চিকিৎসাসেবা প্রদান এবং ইরানব্যাপী এর বিস্তাররোধ করার প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্থ করছে তেমনিভাবে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিহত করার জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
‘যুক্তরাষ্ট্র সকল আন্তর্জাতিক নিয়মরীতি অমান্য করে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাকে অন্য দেশের উপর চাপসৃষ্টির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে এবং এর মাধ্যমেই রানের জনগণকে চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে। বিশ্বায়নের এইযুগে প্রকৃতপক্ষে আমরা সকলেই এক নৌকোর যাত্রী। কাজেই এই নৌকো কোনো কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হলে সবার জীবন ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।
‘যুক্তরাষ্ট্র সব সময় বলে আসছে যে খাদ্য এবং ঔষধসামগ্রী নিষেধাজ্ঞার আওতার বাইরে থাকবে। কিন্তু তারা আর্থিক লেনদেনের উপর সীমাবদ্ধতা আরোপ করে এবং নিয়মিতভাবে ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোকে হুমকি দিয়ে ইরানে খাদ্য ও চিকিৎসাসামগ্রী সরবরাহের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে যাচ্ছে। এ অবস্থা ইরানের স্বাস্থ্যখাতের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। প্রকৃতপক্ষে ইরানের জনগণের উপর চাপ সৃষ্টির জন্য যুক্তরাষ্ট্র হেন কোনো কাজ নেই যা করছে না। এমনকি করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে যখন ইরানের জনগণ কষ্ট পাচ্ছে, তখনও যুক্তরাষ্ট্র তার অপকর্মগুলো অব্যাহত রেখেছে।
‘করোনাভাইরাস কোন সীমানা চেনে না। জাতি, ধর্ম ও দলমত নির্বিশেষে যেকেউ এর দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। সুতরাং, এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সমন্বিত এবং গঠনমূলক পদক্ষেপ প্রয়োজন, এর পাশাপাশি করোনার বিস্তার রোধ করার জন্য অর্থনৈতিক ও সামাজিক লেনদেনসহ সকল সামাজিক কর্মকাণ্ডের ওপর সীমাবদ্ধতা আরোপ করা এবং ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ানো, জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরী। এ জন্য বিশেষ তহবিল গঠনের জন্য দরকার অন্তত কয়েক বিলিয়ন ডলার। এমন এক দুঃসময়ের মধ্যেও যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক আরোপিত অন্যায় নিষেধাজ্ঞা ও দেশটির অপতৎপরতার কারণে ইরান বড় প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছে।
‘যুক্তরাষ্ট্র গত দুই বছরে ইরানের বিরুদ্ধে অন্তত একশত নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করেছে, এর পাশাপাশি ২০১৮ সালের ৮ মে থেকে এখন পর্যন্ত ইরানের অন্তত ১২০০ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিকে তাদের কালোতালিকার অন্তর্ভুক্ত করেছে। এস নিষেধাজ্ঞার প্রধান লক্ষ্য হলো ইরানের অর্থনীতি। ফলে মার্কিন সরকারের দুর্বৃত্তপনা এবং করোনাভাইরাসের প্রভাবে সম্প্রতি ইরানের অর্থনীতিতে প্রায় ২০০ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি সাধিত হয়েছে। বিশ্বের অধিকাংশ ব্যক্তি ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান এমনকি জেসিপিএ চুক্তি স্বাক্ষরকারী অন্যান্যদেশ যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা অনুসরণ করছে। এসব পদক্ষেপ যে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ২২৩১ নম্বর ইশতেহারসহ মানবাধিকার নীতিমালা ও সকল আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন তা সকলের কাছে সুস্পষ্ট। এমতাবস্থায় নিষেধাজ্ঞা বহির্ভূত মানবিক পণ্যগুলো যেমন খাদ্য ও চিকিৎসাসামগ্রী আমদানি করার দায়িত্ব পালন করা এককভাবে ইরানের বেসরকারি খাতের পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠছে না।
‘পরিশেষে সকলকে এটা পুনরায় স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে করোনা মহামারি মোকাবিলার কাজে সহায়তার জন্য ইরানের জনগণের উপর অন্যায়ভাবে আরোপিত মার্কিন নিষেধাজ্ঞা অচল করে দিতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো প্রত্যেক দেশের সরকার, নাগরিক সমাজ ও মানবতাবাদী ব্যক্তি ও সংগঠনের কর্তব্য। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. জাওয়াদ যারিফ এ বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছেন, ‘এখন আর বিশ্বের উচিত নয় অর্থনেতিক দুর্বৃত্তপনাকে ঔষধ সন্ত্রাসে পরিণত করার মর্কিনপ্র বণতার বিষয়ে নির্লিপ্ত থাকা।’”
‘ইরানের মহান কবি শেখ সাদী তার বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ গুলিস্তানে লিখেছেন–
সব মানুষ একদেহের অঙ্গসম
যেহেতু সবার প্রথম উপাদান একই।
যখন একটি অঙ্গ ব্যথায়আক্রান্ত হয়
বাকি অঙ্গও তখন স্থির থাকতে পারেনা।
অন্যের দুর্যোগে যদি উদ্বিগ্ন না হও
তবে তোমার নাম মানুষ হতে পারে না।’