রাজতন্ত্রবিরোধী বিক্ষোভ : থাইল্যান্ডের প্রতিটি পরিবার এখন যে ইস্যুতে বিভক্ত

Looks like you've blocked notifications!
রাজতন্ত্রের প্রশ্নে থাইল্যান্ডের প্রায় প্রতিটি পরিবারে এখন চলছে দ্বন্দ্ব। পিতা-পুত্রের সম্পর্কে তৈরি হচ্ছে তিক্ততা। ছবি : সংগৃহীত

‘আমার বাবা আমাকে শিখিয়েছিলেন রাজার সমালোচনা করা পাপ। এটি নিষিদ্ধ।’ কিন্তু ১৯ বছর বয়সী ডানাই এখন বাবার এই হুঁশিয়ারি মানছেন না। ডানাই ব্যাংককে থাকেন, আইনের ছাত্র। কয়েক মাস ধরে ব্যাংককে যে হাজার হাজার মানুষ রাজতন্ত্রের সংস্কারের দাবিতে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করছে, ডানাই তাদের একজন।

ডানাইর বাবা পাকর্ন উচ্চ মধ্যবিত্ত। তিনি অনেক দেশ ঘুরেছেন। বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনটিতে এঁদের দুজনের বেলাতেই ছদ্মনাম ব্যবহার করা হচ্ছে তাঁদের পরিচয় গোপন রাখার জন্য। এঁরা দুজন যদিও একই বাড়িতে থাকেন না, তারপরও দুজনের মধ্যে নিয়মিত দেখা হয়। কিন্তু যতবারই তাঁরা মুখোমুখি হন, একটি বিষয় নিয়ে আলাপ তাঁরা এড়িয়ে যান, সেটি হচ্ছে ‘রাজতন্ত্র’।

রাজা ভাজিরালংকর্নের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে। ছবি : সংগৃহীত

ডানাই বলছেন, ‘যদি আমরা এটি নিয়ে কথা বলি, আমাদের মধ্যে তর্ক শুরু হয়ে যাবে। তারপর দিনটাই মাটি হবে। একবার গাড়িতে বসে রাজার সমালোচনা করার পর আমাদের মধ্যে তর্ক শুরু হয়েছিল। আমার বাবার কাছে রাজা হচ্ছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে, আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেন? তখন তিনি বলেছিলেন, আমার বয়স অনেক কম, আমি বুঝব না। তিনি বেশ রেগে গিয়েছিলেন। তারপর তিনি চুপ মেরে গেলেন। আমার সঙ্গে আর কথা বলছিলেন না।’

ডানাইর পরিবার একা নয়। এ রকম ঘটনা ঘটছে এখন থাইল্যান্ডের শহরে-গ্রামে সর্বত্র; ঘরে ঘরে। থাইল্যান্ডে রাজতন্ত্রকে গণ্য করা হয় অত্যন্ত পবিত্র, অলঙ্ঘ এক প্রতিষ্ঠান হিসেবে।

অনলাইনে বিতর্ক

রাজতন্ত্র নিয়ে এ রকম বিতর্ক যে কেবল সামনাসামনি চলছে তা নয়, এটি ঘটছে অনলাইনে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও। এই বিতর্ক অনেক সময় চরম পর্যায়েও চলে যাচ্ছে।

গত মাসে থাইল্যান্ডের উত্তরাঞ্চলীয় চিয়াং মাই শহরের এক বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী ফেসবুকে জানান, রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার কারণে তাঁর বাবা তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করতে চেয়েছেন। তখন মেয়েটির বাবা বলেন, তিনি যেন আর পারিবারিক উপাধি ব্যবহার না করেন।

পাকর্ন তাঁর ছেলের আচরণের জন্য দায়ী করছেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের।

পাকর্ন বলছেন, ‘থাই সমাজে কিছু কট্টরপন্থি গোষ্ঠী আছে, যারা রাজতন্ত্রবিরোধী। এর পাশাপাশি ইন্টারনেট এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনবরত মিথ্যা এবং বিভ্রান্তিকর খবর ছড়িয়ে যাচ্ছে। তরুণরা কোনো বাছবিচার না করে এসব গিলছে।’

ডানাই তাঁর বাবাকে রাজতন্ত্রের বিষয়ে প্রথম চ্যালেঞ্জ করেন ১৭ বছর বয়সে।

থাইল্যান্ডের রাজতন্ত্রবিরোধী এই বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে ব্যাংককের বাইরেও। ছবি : সংগৃহীত

ডানাই বলেন, ‘আমরা সিনেমা দেখতে গিয়েছিলাম। ছবি শুরু হওয়ার আগে যখন নিয়মমাফিক রাজকীয় সংগীত বাজছিল, সবাই উঠে দাঁড়াল রাজার প্রতি সম্মান দেখাতে। আমি এটা করতে চাইনি, কাজেই আমি আমার সিটে বসে রইলাম। আমার বাবা আমাকে উঠে দাঁড়াতে জোরাজুরি করছিলেন। কিন্তু আমি দাঁড়াচ্ছিলাম না। যখন লোকজন আমাদের দিকে তাকাতে শুরু করল, তখন আমি শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে দাঁড়ালাম।’

থাইল্যান্ডে রাজকীয় সংগীত বাজার সময় কেউ উঠে দাঁড়াতে অস্বীকৃতি জানানো বেআইনি ছিল। তবে ২০১০ সালে আইনটি সংশোধন করা হয়। তবে এখনো কেউ এই কাজ করতে অস্বীকৃতি জানালে সেটিকে রাজতন্ত্রের প্রতি অশ্রদ্ধার প্রকাশ বলে গণ্য করেন অনেকে।

ঐতিহাসিক রীতি

জন্মের পর থেকেই থাইল্যান্ডের মানুষকে শেখানো হয় রাজাকে শ্রদ্ধা করতে, ভালোবাসতে। একই সঙ্গে রাজার বিরুদ্ধে কিছু বললে কী পরিণতি হতে পারে, সেটা নিয়ে ভয়ও তৈরি করা হয়।

থাইল্যান্ড পরিচিত সদাহাস্যময় মানুষের দেশ বলে। কিন্তু একই সঙ্গে এটি হচ্ছে সেই গুটিকয় দেশের একটি, যেখানে রাজার অবমাননা অপরাধ বলে গণ্য করা হয়। রাজা বা রানির বা রাজসিংহাসনের উত্তরাধিকারীর কোনোরকম সমালোচনা করা বেআইনি। এর জন্য ১৫ বছর পর্যন্ত সাজা হতে পারে।

এখন অবশ্য সিনেমায় গিয়ে ডানাই আর রাজকীয় সংগীতের সময় উঠে দাঁড়ান না।

গত জুলাই থেকে হাজার হাজার বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রছাত্রী রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করছেন। থাইল্যান্ডে জরুরি অবস্থা জারি এবং এই বিক্ষোভের অনেক নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কিন্তু তাতে বিক্ষোভ থামেনি।

জেল-জুলুমের ভয় উপেক্ষা করে নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করছে, থাইল্যান্ডের রাজার অসীম ক্ষমতা খর্ব করার দাবি জানাচ্ছে তারা। রাজার জন্য জনগণের অর্থ ব্যয়েরও সীমা বেঁধে দিতে চায় তারা।

বিশ্বের অন্য অনেক দেশে এসব দাবি সে রকম বড় কিছু নয় বলে মনে হতে পারে, থাইল্যান্ডের আধুনিক ইতিহাসে রাজাকে এ রকম প্রকাশ্যে চ্যালেঞ্জ করার উদাহরণ আর নেই।

ছাত্রদের এই বিক্ষোভে বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে থাইল্যান্ডের বেশিরভাগ মানুষ। ডানাইর বাবা পাকর্ন তাঁদের একজন। পাকর্ন বলেন, ‘আমার জন্ম রাজা নবম রামার শাসনকালে। তিনি নিজের সন্তানদের চেয়ে তাঁর প্রজাদের জন্য বেশি করেছেন। যখন তিনি অসুস্থ হলেন, আমি তাঁর সুস্থতার জন্য নিজে এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে রাজি ছিলাম, যদি তাতেও রাজা দীর্ঘায়ু হন। কিন্তু আজকের প্রজন্ম, আমার ছেলে, তাদের সেই অভিজ্ঞতা নেই।’

এক নতুন রাজা

মাত্র কয়েক বছর আগেও দুই প্রজন্মের এই সংঘাত অকল্পনীয় ছিল। কিন্তু যখন রাজা মাহা ভাজিরালংকর্ন সিংহাসনে বসলেন, সবকিছু বদলে গেল।

নতুন রাজাকে প্রকাশ্যে খুব কমই দেখা যায়। তিনি বেশিরভাগ সময় কাটান জার্মানিতে। থাইল্যান্ডে করোনাভাইরাস মহামারি শুরু হওয়ার পর তিনি এখন জার্মানিতে আরো বেশি থাকছেন।

ব্যাংককে থাই সামরিক বাহিনীর যত ইউনিট আছে, তিনি তাঁর সবকটি নিয়ন্ত্রণে নিয়েছেন। এটি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। থাইল্যান্ডের সাম্প্রতিক ইতিহাসে একজন রাজা এভাবে সামরিক শক্তি কুক্ষিগত করছেন, এমন নজির নেই। তাঁর ব্যক্তিগত জীবন নিয়েও অনেক কথা হচ্ছে। তিনি তিনবার বিয়েবিচ্ছেদের পর গত বছর আবার চতুর্থবারের মতো বিয়ে করেছেন। তাঁর ব্যক্তিগত দেহরক্ষী ছিলেন, এমন এক নারীকে তিনি তাঁর সঙ্গী হিসেবে মর্যাদা দিয়েছেন।

রাজা মহা ভজিরালংকর্নের তুলনায় প্রয়াত রাজা নবম রামাকে অনেকে প্রায় দেবতাতুল্য মনে করতেন। তিনি যেখানেই যেতেন, লোকজন তাঁর জন্য মাটিতে শুয়ে পড়ে বলত, ‘আমরা রাজার পায়ের নিচের ধুলা।’ প্রয়াত রাজাকে দুবার সামনাসামনি দেখার সুযোগ হয়েছিল পাকর্নের।

পাকর্ন বলেন, ‘একবার আমি যখন আমার গাড়িতে, তখন দেখলাম রাজা নিজে গাড়ি চালিয়ে আসছেন আমার উল্টো দিক থেকে। তার আগে-পিছে কোনো গাড়িবহর নেই, কোনো সাইরেনের আওয়াজ নেই। আমাদের মধ্যে চোখাচোখি হলো। আমি তো রীতিমতো অবাক। তিনি আসলে অন্য সবার মতো সাধারণ কিছু করতে চেয়েছিলেন, খুব সহজ এবং অনানুষ্ঠানিক কিছু। আমার মনে হয়েছিল তাঁকে ঘিরে যেন একটা আভা আছে, তাঁর উপস্থিতির একটা বিশেষ মূল্য ছিল।’

কিন্তু রাজা নবম রামা তাঁর জীবনের শেষ ১০ বছর ছিলেন অসুস্থ। বেশিরভাগ সময় তাঁকে হাসপাতালে কাটাতে হয়েছে।

ডানাইর মতো তরুণরা তাঁকে খুব কমই দেখেছেন। কিন্তু তারপরও যখন রাজা মারা গেলেন, ডানাই ফেসবুকে তাঁর মৃত্যুতে দুঃখ প্রকাশ করে পোস্ট দিয়েছিলেন। রাজার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলেন। তবে ডানাই বিবিসিকে এখন বলছেন, ফেসবুকে এ রকম পোস্ট দেওয়ার জন্য এখন তিনি অনুতাপ করেন। তিনি বলছেন, ‘এখন আমি আসলে বুঝতে পারি, তখন বা তার আগে আমাদের যা বলা হয়েছিল, তা ছিল একেবারে প্রপাগান্ডা।’

রাজতন্ত্র নিয়ে পরস্পরবিরোধী মতের জন্য বাবা-ছেলের সম্পর্কে যে এ রকম তিক্ততা তৈরি হয়েছে, তা আসলে থাই সমাজে দুটি প্রজন্মের মধ্যে বিরাট ব্যবধানেরই প্রতিফলন।

ছাত্রছাত্রীদের বিক্ষোভ শুরু হওয়ার পর থাইল্যান্ডের সর্বত্র এভাবেই পরিবারগুলো ক্রমে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। পিতামাতা এবং সন্তান, ভাই এবং বোন, খালা এবং ভাগ্নে—সবাই যেন পরস্পরের কাছে অচেনা লোকে পরিণত হচ্ছেন।

তরুণ প্রজন্ম রাজতন্ত্র এবং এর প্রতিনিধিত্বকারী সবকিছুকেই প্রশ্ন করতে শুরু করেছে। এবং এটি এক দীর্ঘ অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের শুরু বলেই মনে হচ্ছে।