লিবিয়াতেও ‘সিরিয়ার খেলা’ খেলছেন পুতিন ও এরদোয়ান!

Looks like you've blocked notifications!

লিবিয়ায় সম্প্রতি বিদ্রোহী নেতা জেনারেল খলিফা হাফতারের বাহিনীকে যেভাবে হটিয়ে দিয়েছে ত্রিপোলির সরকারি বাহিনী, তাতে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও তুরস্কের রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান যে দেশটির ভবিষ্যৎ ঘটনাপ্রবাহের প্রচ্ছন্ন নিয়ন্তা হয়ে উঠতে চলেছেন, তা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। ঠিক যেমনটা ঘটেছে সিরিয়ায়।

লিবিয়ার শাসক কর্নেল গাদ্দাফি ২০১১ সালে ক্ষমতাচ্যুত ও নিহত হওয়ার পর দেশটির রাষ্ট্রকাঠামো ভেঙে পড়েছে, চলছে গৃহযুদ্ধ, যাতে জড়িয়ে পড়েছে বিদেশি শক্তিগুলোও। সংবাদমাধ্যম বিবিসি এ খবর জানিয়েছে।

ত্রিপোলিতে জাতিসংঘ সমর্থিত প্রধানমন্ত্রী ফায়েজ আল-সেরাজের সরকার বর্তমানে ক্ষমতাসীন হলেও লিবিয়ার নানা অংশ নিয়ন্ত্রণকারী বিভিন্ন বিদ্রোহী গোষ্ঠীর মোকাবিলা করতে হচ্ছে তাদের।

গত বছর থেকেই লিবিয়ার পূর্বাংশ নিয়ন্ত্রণকারী সামরিক নেতা জেনারেল খলিফা হাফতার ত্রিপোলি দখল করার চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তাঁর বাহিনী এখন ত্রিপোলির সরকারের আক্রমণের মুখে পিছু হটছে।

ত্রিপোলি সরকারের সমর্থনে এখন সেনা সহায়তা দিচ্ছে তুরস্ক। এ সৈন্যদের মধ্যে আছে সিরিয়ার তুরস্ক-সমর্থিত বাহিনীর যোদ্ধারা। অন্যদিকে জেনারেল হাফতারের বাহিনীতে আছে কয়েক হাজার রুশ ভাড়াটে সৈন্য।

অবশ্য এর অর্থ এই নয় যে দেশটির বেসামরিক জনগণ আগামীতে একটা শান্তিপূর্ণ সময় প্রত্যাশা করতে পারে।

অথচ কর্নেল গাদ্দাফির পতনের পরও একটা সময় পর্যন্ত মনে হচ্ছিল লিবিয়ার সামনে সুন্দর ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে।

তেল ও গ্যাস সম্পদে সমৃদ্ধ লিবিয়া। পর্যটকদের জন্যও দেশটি হতে পারতো আকর্ষণীয় গন্তব্য। লিবিয়ার আছে দুই হাজার কিলোমিটার ভূমধ্যসাগরতীরবর্তী সৈকত। সেখানে রোমান যুগের এমন সব পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন আছে, যা ইতালির সমকক্ষ বলে দাবি করা চলে।

জ্বালানি সমৃদ্ধ দেশটির পক্ষে তার নাগরিকদের জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও উন্নত জীবনযাত্রার মান নিশ্চিত করা অসম্ভব নয়।

কিন্তু এখন তাদের এগুলো কিছুই নেই, নেই জীবনের নিরাপত্তাও। নভেল করোনাভাইরাসজনিত কোভিড-১৯ সংক্রমণের মধ্যে দেশটির হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলোর বেশিরভাগই ধ্বংস হয়ে গেছে। পশ্চিম লিবিয়ার দুই লাখ লোক ইতোমধ্যেই তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়েছে।

লিবিয়ার শহরগুলো এখন এক একটি নগররাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। গাদ্দাফির শাসকচক্রকে মোকাবিলা করা বিদ্রোহী মিলিশিয়ারা তার পতনের পর ক্ষমতার মজা পেয়ে গেছে। তাদের প্রত্যেকের নিজস্ব এজেন্ডা আছে। তারা অস্ত্র সমর্পণ করবে না।

জাতিসংঘের উদ্যোগে কূটনীতিকরা চেষ্টা করেছেন তাদের মধ্যে সংলাপ ও মৈত্রী প্রতিষ্ঠার। কিন্তু তা সফল হয় নি।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের হানান সালেহ বলছেন, গৃহযুদ্ধরত সব পক্ষই বেসামরিক মানুষদের প্রতি একই রকম নির্মম আচরণ করেছে। তবে, বিশেষ করে খলিফা হাফতারের বাহিনী এমন সব অত্যাচার-নির্যাতন চালিয়েছে, যা যুদ্ধাপরাধ বলেও বিবেচিত হতে পারে।

লিবিয়ার দ্বিতীয় প্রধান শহর বেনগাজির ইসলামী উগ্রপন্থীদের তাড়িয়ে জেনারেল খলিফা হাফতারের উত্থান ঘটে ২০১৪ সালে।

জেনারেল হাফতার কর্নেল গাদ্দাফির সঙ্গে তাঁর বৈরিতার জন্য লিবিয়ায় সুপরিচিত। তিনি নির্বাসিত হিসেবে অনেক বছর যুক্তরাষ্ট্রে ভার্জিনিয়ার ল্যাংলিতে কাটিয়েছেন। এ শহরেই মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সিআইএর প্রধান দপ্তর। সেখানে বসেই গাদ্দাফির পতনের ছক কষতেন জেনারেল হাফতার। এখন তিনি বেনগাজির নিয়ন্ত্রক। এবং ত্রিপোলিতে অভিযান চালিয়ে তিনি চেয়েছিলেন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ফায়েজ আল সেরাজের সরকারকে উৎখাত করে লিবিয়াকে আবার এক রাষ্ট্রে পরিণত করতে। তখন থেকেই এটা স্পষ্ট ছিল যে এখানে বিদেশি শক্তি জড়িয়ে পড়বে।

নিয়ন্ত্রণকামীদের কাছে লিবিয়া এক আকর্ষণীয় দেশ। দেমটির জনসংখ্যা ৭০ লাখেরও কম, কিন্তু আফ্রিকার সবচেয়ে বড় তেল-গ্যাসের রিজার্ভ আছে এখানে। লিবিয়ার অবস্থান ইউরোপের ঠিক উল্টো দিকেই। এখানকার হাইড্রোকার্বন ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে সরাসরি রপ্তানি হতে পারে।

অন্যদিকে উপসাগরীয় এলাকার প্রতিদ্বন্দ্বী তেল-গ্যাস উৎপাদকদের জাহাজগুলোকে আসতে হয় বিপজ্জনক সমুদ্রপথ দিয়ে।

প্রধানমন্ত্রী ফায়েজ আল সেরাজকে সমর্থন করছে তুরস্ক, কাতার ও ইতালি। অন্যদিকে জেনারেল হাফতারকে সমর্থন করছে সংযুক্ত আরব আমিরাত, জর্ডন, মিসর, রাশিয়া ও ফ্রান্স।

ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য একেক সময় একেক রকম রাজনৈতিক সংকেত দিয়েছে। কখনো সেরাজ, কখনো জেনারেল হাফতারকে উৎসাহ দিয়েছে। আবার যখন নাগালে পেয়েছে, তখন ইসলামি উগ্রপন্থীদের ওপর বোমা হামলা চালিয়েছে।

এখন যুক্তরাষ্ট্র ভয় পাচ্ছে, রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন হয়তো লিবিয়ায় নিজের প্রভাব কায়েম করবেন, ঠিক যেভাবে তিনি সিরিয়ায় করেছেন।

লিবিয়ার যুদ্ধের সঙ্গে সিরিয়ার অনেক মিল দেখা যাচ্ছে। সিরিয়ার মতোই লিবিয়ারও ভবিষ্যৎ ভাগ্যের নিয়ন্তা হয়ে উঠছেন সে একই বিদেশি নেতারা। অনেক দিক থেকেই সিরিয়ার প্রক্সি যুদ্ধের ধারাবাহিকতাতেই যেন চলছে লিবিয়ার যুদ্ধ।

তুরস্ক ও রাশিয়া – দুপক্ষই লিবিয়ায় সিরিয়ান মিলিশিয়াদের নিয়ে গেছে, যারা নিজেদের দেশের এক দশকব্যাপি গৃহযুদ্ধের মধ্য দিয়ে দক্ষ যোদ্ধা হয়ে উঠেছে।

এটা হতেই পারে যে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান ও রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন সিরিয়ায় করা চুক্তিগুলোরই একটা সংস্করণ লিবিয়ার ওপর প্রয়োগ করছেন।

জেনারেল হাফতারের পক্ষে যে রাশিয়ান ভাড়াটে সৈন্যরা যুদ্ধ করছে, তারা এসেছে ওয়াগনার গোষ্ঠী নামে একটি সংগঠন থেকে। এটি চালান প্রেসিডেন্ট পুতিনের একজন ঘনিষ্ঠ সহযোগী ইয়েভগেনি প্রিগোঝিন। এই ওয়াগনার গ্রুপের যোদ্ধাদেরকে সিরিয়াতে ব্যবহার করা হয়েছে।

এটা লক্ষ্যণীয় বিষয় যে ত্রিপোলি থেকে রাশিয়ানদের প্রত্যাহার করে নেওয়ার সময় তুরস্ক তাদের সামরিক ড্রোনগুলো ব্যবহার করে তাদের হয়রানি করেনি। তা ছাড়া রাশিয়ানরা উন্নত প্রযুক্তির যুদ্ধবিমানও লিবিয়ায় নিয়ে গেছে।

প্রেসিডেন্ট পুতিন ও প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান হয়তো জেনারেল হাফতারের ত্রিপোলি অভিযান বন্ধ করতে রাজি হয়েছেন, যাতে তাঁরা যুদ্ধ থেকে পাওয়া সুবিধাগুলো নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিতে পারেন।

লিবিয়ার ভেঙে পড়া নিয়ে একটি বই লিখেছেন জার্মান শিক্ষাবিদ ওলফ্রাম লাশার। তিনি বলছেন, হয়তো দুটি বিদেশি শক্তি লিবিয়ায় নিজ নিজ প্রভাব বলয়ের সীমারেখা চিহ্নিত করে নিয়েছে। এমনও হতে পারে যে এ ব্যবস্থাটা হয়তো দীর্ঘদিন জারি থাকবে।

তবে লিবিয়ায় সক্রিয় অন্য বিদেশি শক্তিগুলো এবং লিবিয়ার জনগণ এটা মেনে নেবে কি না, তাতে সন্দেহ আছে।

হয়তো ত্রিপোলি থেকে ৫৫ মাইল দূরের তারহুনা শহরটি নিয়েই হতে পারে পরবর্তী বড় যুদ্ধ।

পশ্চিম দিকের এ শহরটি জেনারেল হাফতারের ঘাঁটি, এবং এটি নিয়ন্ত্রণ করে আল-কানিয়াত নামে একটি মিলিশিয়া গোষ্ঠী, যা প্রধানত গাদ্দাফি সরকারের অনুগতদের নিয়ে গড়া।

এ মুহূর্তে ত্রিপোলি সরকারের অনুগত বাহিনী তারহুনার দিকে এগোচ্ছে। এরা একসময় ছিল গাদ্দাফি সরকারের বিরোধী।

তাই বোঝা যাচ্ছে, লিবিয়ার বিরামহীন গৃহযুদ্ধে গাদ্দাফির সমর্থকদের বিরুদ্ধে লড়াই এখনো গুরুত্বপূর্ণ।