তালেবানের ধ্বংস করা বুদ্ধমূর্তি ফিরল আফগানিস্তানে
তালেবানের ধ্বংস করা ঐতিহাসিক বামিয়ান প্রদেশের জোড়া বুদ্ধমূর্তি ফিরেছে আফগানিস্তানে। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর দেশটির তৎকালীন ক্ষমতাসীন তালেবানরা ধর্মের দোহাই দিয়ে সেদেশের শিল্পকর্মের অনেক কিছুই ধ্বংস করে ফেলে। এমনই ধ্বংস করে ফেলা শিল্পকর্মের একটি হলো বামিয়ান প্রদেশের ১৫০০ বছরের পুরনো জোড়া বুদ্ধমূর্তি। ২০০১ সালে ধর্মের নামে ধূলিসাৎ হয়েছিল ইতিহাস। সেই ঘটনার ১৪ বছর পরে জোড়া এক রাতের জন্য ফিরে এল ইতিহাসের স্মৃতি হয়ে। তবে পাথরের সত্যিকারের মূর্তি নয়- থ্রিডি আলোর মূর্তি হয়ে।
গত ৭ জুন চিনা দম্পতি জ্যানসন এবং লিয়ান ইউ থ্রিডি আলোর মাধ্যমে বামিয়ানের উপত্যকায় ভেঙে যাওয়া মূর্তির শূন্যস্থানে ওই মূর্তির প্রতিচ্ছবি তৈরি করেন। এএফপির কাছে ওই দম্পতি জানিয়েছেন, বহু বছর ধরেই ওই বুদ্ধমূর্তিকে আলোর মাধ্যমে ফিরিয়ে আনার ইচ্ছা ছিল তাঁদের। আলোর মূর্তি তৈরিতে আফগান সরকার ও ইউনেস্কোর অনুমতি নিয়েছেন তাঁরা।
ধ্বংস করে ফেলা মূর্তি দুটো আক্ষরিক এবং আলঙ্করিক অর্থেই ছিল অতুলনীয়। বামিয়ান উপত্যকার পাহাড়ের গায়ে খোদাই করা ছিল ওই ভাস্কর্য দুটো। এর একটির উচ্চতা ছিল ১৮০ ফুটের কাছাকাছি এবং অন্যটির উচ্চতা ছিল ১২০ ফুট। এরপরও সমস্ত সৌন্দর্যকে উপেক্ষা করে তালেবানদের গোঁড়ামির শিকার হয় ওই দুই বুদ্ধমূর্তি।
ধারণা করা হয়, ষষ্ঠ শতাব্দীর সময় বামিয়ান উপত্যকায় এই দুই বুদ্ধমূর্তি স্থাপিত হয়েছিল। আন্তর্জাতিক বিরোধিতা সত্ত্বেও তালেবানরা মূর্তি দুটো ধ্বংস করে ফেলে। আর এই মূর্তি দুটোকে ধ্বংস করতে তালেবানরা সেসময় গোলা, স্থল মাইন এবং বিস্ফোরক ব্যবহার করে। এরপর থেকেই মনে করা হতো যে চিরদিনের মতো হারিয়ে গেলো অনন্য সুন্দর ওই জোড়া বুদ্ধ।
এএফপির খবরে বলা হয়েছে, ওই রাতে বামিয়ানের পর্যটকরা যেন ফিরে গিয়েছিলেন সেই অতীতে। এক মুহূর্তের জন্য সত্যিই মনে হয়েছিল সময় পিছিয়ে গিয়েছে। উপস্থিত এক সাংবাদিক জানিয়েছেন, বিশাল বিশাল প্রোজেক্টরের মাধ্যমে ঐতিহাসিক ওই মূর্তির অবিকল প্রতিচ্ছবি তৈরি করেছিলেন চিনা দম্পতি। এমনকী, ওই আলোকমূর্তির উচ্চতাও রাখা হয়েছিল ১১৫ থেকে ১৭৪ ফুটের মধ্যেই। যা আসল মূর্তির প্রায় সমান।
এদিকে টাইমস অব ইন্ডিয়ার খবরের সূত্রে জানা গেছে, চিরদিনের মতো হয়তো হারিয়ে যাবে না বামিয়ানের জোড়া বুদ্ধ। পাহাড়ের গায়ে আবারও সেই আগের মতোই দাঁড়াচ্ছে জোড়া বুদ্ধ। জার্মান শিল্প ইতিহাসবিদ এবং স্থাপত্যবিদ বার্ট প্রাক্সেন্থলার আশা প্রকাশ করেছেন, বুদ্ধের শরীরের অর্ধেক অংশ পুনরুদ্ধার করা সম্ভব। বার্ট বিগত আট বছর ধরে এই জোড়া বুদ্ধ মূর্তি নিয়ে কাজ করে আসছেন। তিনি এবং তার কর্মীরা এ পর্যন্ত ধ্বংসস্তুপ থেকে ৪০০ টন ইট পাথরের টুকরো এবং ভাস্কর্য দুটোর শরীরের বিভিন্ন অংশ উদ্ধার করেছে। ভাস্কর্যের মূল অংশের সঙ্গে আধুনিক উপাদানের সংমিশ্রণে তৈরি হবে নতুন জোড়া বুদ্ধমূর্তি।
পত্রিকাটি জানায়, প্রাক্সেন্থলার এবং তার দল মূর্তিদুটো ঠিক যে স্থানে দাড়িয়ে ছিল তার পেছনে একটি সুরঙ্গ(টানেল) তৈরি করেছেন। আর এবিষয়ে প্রাক্সেন্থলার ব্যাখ্যা করে বললেন, ‘বর্তমানে আমরা বুদ্ধের একেবারে উপরের অংশে। এখানে শুধুমাত্র একটি দেয়াল এবং একটি ছোট বসবার জায়গা আছে। কিন্তু এখন এখানে কোনো মাথা নেই। খুব দ্রুতই এখানে বুদ্ধের মাথা সংযোজন করা হবে।’
বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে আফগানিস্তানের বামিয়ান চূড়ান্ত অর্থেই একটি গরীব প্রত্যন্ত অঞ্চল। জোড়া বুদ্ধ মূর্তির জন্য এই অঞ্চলে একসময় পর্যটকরা ভিড় করতো। বিগত তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে আফগানিস্তানে যুদ্ধ-বিগ্রহ আর সহিংসতা লেগেই আছে। তালেবানরা মূর্তিদুটো ভেঙে ফেলার কয়েক বছর আগে থেকেই যুদ্ধ বিগ্রহের কারণে পর্যটকরা এখান থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিল। আর সেই মুখ ফিরিয়ে নেওয়া পর্যটকদের ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যেই জোড়া বুদ্ধমূর্তি পুনর্নির্মাণ করার এই প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।
আফগানিস্তানের জনপ্রিয় প্রদেশিক গভর্নর হাবিবা সারাবির সহায়তায় এই প্রকল্পটি চলছে। এই প্রকল্পটি সম্পন্ন হবার ক্ষেত্রে হাবিবা আশাবাদী। কারণ বামিয়ান এখন আফগানিস্তানের সবচেয়ে কম ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলগুলোর একটি।
মানবাধিকারকর্মী আবদুল্লাহ হামাদি বলেন, ‘এই ফাঁকা জায়গাটা, যেখানে বুদ্ধমূর্তি দুটো এক সময় দাঁড়িয়ে ছিল, এটা তালেবানদের গোঁড়া মতাদর্শের কথা মনে করিয়ে দেয়। বুদ্ধ ধ্বংস হয়ে গেছে। এটা পুনরায় তৈরি করা যাবে কিন্তু এটা ইতিহাস হবে না। ভাঙা বুদ্ধই হলো ইতিহাস।’