ইরানে অভ্যুত্থানের পেছনের গল্প জানাল সিআইএ
১৯৫৩ সালে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ইরানের রাজনীতিতে সরাসরি হস্তক্ষেপ করে যুক্তরাষ্ট্র। এর মধ্য দিয়ে পরিকল্পিতভাবে ক্ষমতাচ্যুত করা হয় দেশটির তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মুহাম্মদ মোসাদ্দেককে। গদিতে বসে পশ্চিমাদের নিয়ন্ত্রিত সরকার। আর এর মধ্য দিয়ে পশ্চিমের নিয়ন্ত্রণে আসে ইরানের তেলের বিশাল ভাণ্ডার।
বহু বছর আগের সেই অভ্যুত্থানের পেছনের গল্প প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা (সিআইএ)।
গত সপ্তাহে প্রায় এক হাজার পাতার একটি নথিতে ওই অভ্যুত্থানের বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া হয়। সেখানে বলা হয়, গত শতাব্দীর ৬০-এর দশকে ইরানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মোসাদ্দেক। দেশটিতে তখন তেল ব্যবসা করছিল ‘অ্যাংলো ইরানিয়ান অয়েল কোম্পানি’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। ব্রিটিশ ওই প্রতিষ্ঠানের বাড়-বাড়ন্তে অতিষ্ঠ হয়ে মোসাদ্দেক তাদের কাগজপত্র খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত নেন। এ ছাড়া ইরানের তেল সম্পদের ওপর প্রতিষ্ঠানটির খবরদারি কমানোরও পদক্ষেপ নেন তিনি। কিন্তু ইরানের ওই সিদ্ধান্ত মানতে নারাজ ছিল অ্যাংলো ইরানিয়ান অয়েল কোম্পানি।
এ নিয়ে দেশটির পার্লামেন্টে অনুষ্ঠিত হয় ভোটাভুটি। ভোট শেষে জানানো হয় ইরানের তেল শিল্পসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে জাতীয়করণ করা হবে। এ ছাড়া দেশটি থেকে বিদেশি সব প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের তাড়িয়ে দেওয়া হবে। এর একপর্যায়ে নিজেদের পিঠ বাঁচাতে তেল শোধনাগারের নিয়ন্ত্রণ নিতে ইরানে সেনা পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয় ব্রিটিশরা। কিন্তু ব্রিটেনের শীর্ষস্থানীয় কিছু এমন সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেন। এর পর চাল বদলিয়ে কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার বুদ্ধি আঁটে তারা। অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মোসাদ্দেককে ইরানের ক্ষমতা থেকে হটানোর পরিকল্পনা করা হয়। আর সেই পরিকল্পনায় ব্রিটিশরা পাশে পায় সিআইএকে।
ইরানে অভ্যুত্থানের পেছনে ব্রিটেন ও সিআইয়ের উদ্দেশ্য ছিল অভিন্ন। দুই পক্ষই একই লক্ষ্যে তীর ছুঁড়ে দখল করতে চেয়েছিল দেশটির তেল সম্পদ।
অভ্যুত্থানের আগে থেকেই বিভিন্ন সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের তেল সম্পদ ব্যবস্থাপনায় একচেটিয়া প্রভাব ছিল যুক্তরাষ্ট্রের। কিন্তু দিন গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে চোখ ফোটে সৌদি আরবের। যুক্তরাষ্ট্রের উত্তোলন করা তেল বিক্রির লাভের ভাগ চেয়ে বসে তারা। এতে গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে যুক্তরাষ্ট্র।
মধ্যপ্রাচ্যে ‘দাদাগিরি’ বজায় রাখতে গেলে আরব দেশগুলোতে ‘পুতুল সরকার’ বসানোর সিদ্ধান্ত নেয় মার্কিনিরা। তাই ‘অপারেশন অ্যাজাক্স’ নামে ইরানে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তেলসমৃদ্ধ দেশগুলোতে নিজেদের সমর্থিত সরকার বসানোর পরিকল্পনা করে সিআইএ।
সম্প্রতি প্রকাশিত সিআইএর নথিতে বলা হয়, ১৯৫৩ সালে পরিকল্পিত ওই অভ্যুত্থানটি বিফল হতে যাচ্ছিল। সেই বছরের ১৫ আগস্ট অভ্যুত্থানচেষ্টার পর পরই প্রধানমন্ত্রী মোসাদ্দেক ব্যাপক ধরপাকড় শুরু করেন। এতে থমকে যায় সিআইয়ের সব চেষ্টা। সংস্থাটির অনেক কর্তা-ব্যক্তিই সিদ্ধান্ত নেন হাত গুটিয়ে সটকে পড়ার। কিন্তু বেঁকে বসেন সে সময়ে ইরানে কর্মরত সিআইএর এক কর্মকর্তা। ক্রেমিট রুজভেল্ট নামের ওই কর্মকর্তা জানান, সব কিছু শেষ হয়ে যায়নি। তিনি এখনো চেষ্টা চালিয়ে যেতে চান।
ইরানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মুহাম্মদ মোসাদ্দেক
রুজভেল্টের পরিকল্পনায় ভাড়া করা হয় ইরানের বিভিন্ন কুখ্যাত সন্ত্রাসীদের। গাড়ি ভর্তি করে তাদের নিয়ে আসা হয় রাজধানী তেহরানে। তেহরানের রাস্তা চলে যায় বিদ্রোহীদের দখলে। বাঁধে ব্যাপক সংঘর্ষ। এতে নিহত হন কমপক্ষে ২০০ জন। এর জের ধরে গ্রেপ্তার করা হয় প্রধানমন্ত্রী মোসাদ্দেককে। দেশদ্রোহিতার অভিযোগ এনে তাঁকে তিন বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। আর বাকি জীবন করে রাখা হয় গৃহবন্দি। মোসাদ্দেকের অন্য সমর্থকদের মৃত্যুদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এভাবেই শেষ পর্যন্ত সফল হয় সিআইএ।
সফল অভ্যুত্থানের পর ইরানের ক্ষমতায় বসানো হয় দেশটির রেজা শাহ পাহলভীকে। নিজেদের সমর্থিত সরকারের অধীনে অ্যাংলো ইরানিয়ান অয়েল কোম্পানি ফিরে যায় ইরানে। তাদের নতুন নাম হয় ব্রিটিশ পেট্রোলিয়াম (বিপি), যা এই মুহূর্তে বিশ্বের অন্যতম বড় জ্বালানি তেল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান।
যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে ক্ষমতায় বসা শাহ সরকার খুব বেশি সুবিধা করতে পারেনি। অপারেশন অ্যাজাক্সের ফলে রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়া ব্যক্তিরা একপর্যায়ে ইরানের রক্ষণশীল ও উদারপন্থী—উভয় শিবিরেই গ্রহণযোগ্যতা হারায়।
২৬ বছর ক্ষমতায় থাকার সময় রেজা শাহ পাহলভীর বিরুদ্ধে ক্ষোভ দানা বাঁধতে থাকে ইরানে। এরই বিস্ফোরণ ঘটে ১৯৭৯ সালে। আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বে ইরানে ইসলামী বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত হন পাহলভী। ইরানে প্রতিষ্ঠিত হয় ইসলামী প্রজাতন্ত্র।
ব্রিটেন ও সিআইএর পরিকল্পনায় সংঘটিত ওই অভ্যুত্থান ইরানে বড় ধরনের পরিবর্তন আনে। প্রধানমন্ত্রী মোসাদ্দেক গণতন্ত্রমনা ছিলেন। জনগণের প্রতিনিধিদের সমর্থনেই ক্ষমতায় এসেছিলেন তিনি। সে সময় ইউরোপের আদলে একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ গড়ে উঠছিল ইরানে। তবে অভ্যুত্থান ইরানে গণতন্ত্রের ওই ধারাকে ব্যহত করে। ক্ষমতা প্রথমে যায় পুতুল সরকার ও পরবর্তী সময়ে ইসলামপন্থীদের হাতে।
সিআইএ প্রকাশিত ওই নথিতে পাওয়া যায়, অভ্যুত্থানের সময় বেশ জনপ্রিয় ছিলেন ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আবল-ঘাসেম কাশানি। তাঁকে সে সময় জাতীয়করণের নায়ক হিসেবে বিবেচনা করা হতো।
২০১৭ সালের জানুয়ারিতে ইরানের তেল সম্পদ জাতীয়করণের জন্য কাশানির ভূমিকার প্রশংসা করেন বর্তমান আয়াতুল্লাহ খামেনি। তবে অবাক করার মতো তথ্য হলো, সেই কাশানিই নাকি অভ্যুত্থানের সময় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছিলেন। এমনকি অভ্যুত্থান সফল করার পেছনেও নাকি হাত ছিল তাঁর। এর বিনিময়ে তিনি আর্থিক সহায়তা চেয়েছিলেন মার্কিনিদের কাছে। তবে সেই অর্থ আদৌ তিনি পেয়েছিলেন কি না, তা জানা যায়নি।
শুরুতে ইরানে অভ্যুত্থানের কথা অস্বীকার করে যুক্তরাষ্ট্র। তবে তারা ধরা পড়ে ১৯৮৯ সালে। সে সময় প্রকাশিত কিছু নথিতে পাওয়া যায়, ১৯৫৩ সালের ওই ঘটনা সিআইয়ের পরিকল্পনায় হয়।
২০১৩ সালে প্রকাশিত হয় আরো কিছু তথ্য। আর সবশেষে এবার সে সময়ের পুরো ঘটনাটি প্রকাশ করা হয় যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে।
নিজেদের স্বার্থে ও যুক্তরাজ্যের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মান রাখতেই এ ঘটনা এতদিন চেপে রাখা হয়েছিল বলে জানিয়েছেন সিআইয়ের এক কর্মকর্তা।