পাহাড়ে আটকা ৩০ হাজার রোহিঙ্গা, খাদ্য-পানি নেই
সেনাবাহিনীর চরম নির্যাতন-হামলা আর ধর্ষণের মুখে রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আসা প্রায় ৩০ হাজার রোহিঙ্গা মুসলিম কোথাও জায়গা না পেয়ে মিয়ানমারের দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে আটকা পড়েছে। খাদ্য, পানি, বাসস্থান ও চিকিৎসার অভাবে এসব মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
মার্কিন গণমাধ্যম সিএনএনের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে। রেবেকা রাইট ও ব্যান ওয়েস্টকটের তৈরি করা এই প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা মূলত নাফ নদী পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সীমান্তরক্ষী বাহিনীর বাধায় তারা প্রবেশ করতে না পেরে ফিরে যায়। আবার তারা মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ভয়ে নিজেদের গ্রামে বা বাড়িতে ফিরতে পারছে না। তাদেরই একটি অংশ রাখাইন রাজ্যের মংডু ও রাথেডং শহরের কাছাকাছি পাহাড়ি এলাকায় অবস্থান নিয়েছে।
বার্মা হিউম্যান রাইট নেটওয়ার্কের নির্বাহী পরিচালক কিউ উইন বলেন, ‘এখানে যারা আটকে আছে, তারা ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে রয়েছে। মানবিক কারণেই যত দ্রুত সম্ভব তাদের উদ্ধার করা উচিত।’
প্রতিবেদনে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের স্যাটেলাইটে তোলা একটি ছবি ব্যবহার করা হয়েছে। দাবি করা হয়েছে, এই ছবিটি গত ৩১ আগস্ট রাখাইন রাজ্যের চেন খাঁর লি গ্রাম থেকে তোলা। গ্রামটি মুসলিম অধ্যুষিত।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া চ্যাপ্টারের উপপরিচালক ফিল রবার্টসন সিএনএনকে বলেন, ‘এই ছবি থেকে মুসলিম অধ্যুষিত গ্রামটির ধ্বংসের আকার বোঝা যাচ্ছে। ছবিটি এই গ্রামটির একটি অংশের মাত্র। আমরা যা আশঙ্কা করছি, প্রকৃত অবস্থা তার চেয়ে অনেক বেশি খারাপ।’
ওই গ্রামের ৯৯ ভাগ বাড়িই আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সংখ্যায় এটি ৭০০ বেশি হবে।
মিয়ানমারে জাতিগত সহিংসতার শিকার হয়ে ২৫ আগস্ট থেকে এখন পর্যন্ত সর্বশেষ ৯০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। সীমান্তে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোরভাবে তৎপর রয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের পক্ষ থেকে। প্রতিদিনই নৌকায় বা সীমান্ত পথে আসা রোহিঙ্গা আটক করে পরে তাদের ফের নিজ দেশে পাঠাচ্ছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। ঝুঁকি নিয়ে বাংলাদেশ প্রবেশ করার সময় নৌকা ডুবে এখন পর্যন্ত অর্ধশতাধিক রোহিঙ্গা মারা গেছেন।
যারা জীবন বাঁচিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে, তাদের অবস্থাও করুণ। অনেককে শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় পেলেও খাবারের তীব্র সংকটের মধ্যে রয়েছেন। অনেকে আশ্রয় নিয়েছেন স্থানীয় বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। অনেক রোহিঙ্গা পরিবার মাথা গোঁজার ঠাঁই করতে উপকূলের পাশে বন-জঙ্গল সাফ করে বাঁশ-প্লাস্টিক দিয়ে ছাউনি তৈরির চেষ্টা করছে।
গত ২৪ আগস্ট রাতে রাখাইন রাজ্যে একসঙ্গে ২৪টি পুলিশ ক্যাম্প ও একটি সেনা আবাসে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটে। ‘বিদ্রোহী রোহিঙ্গাদের’ সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (এআরএসএ) এই হামলার দায় স্বীকার করে। এ ঘটনার পর মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী নিরস্ত্র রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ-শিশুদের ওপর নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ চালাতে থাকে। সেখান থেকে পালিয়ে আসার রোহিঙ্গাদের দাবি, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী নির্বাচারে গ্রামের পর গ্রামে হামলা নির্যাতন চালাচ্ছে। নারীদের ধর্ষণ করছে। গ্রাম জ্বালিয়ে দিচ্ছে।
মিয়ানমার সরকারের বরাত দিয়ে জাতিসংঘ গত ১ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, মিয়ানমারে সহিংসতা শুরুর পর গত এক সপ্তাহে ৪০০ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ৩৭০ জন ‘রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী’, ১৩ জন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, দুজন সরকারি কর্মকর্তা এবং ১৪ জন সাধারণ নাগরিক।
মিয়ানমার সরকারের আরো দাবি, ‘বিদ্রোহী সন্ত্রাসীরা’ এখন পর্যন্ত রাখাইনের প্রায় দুই হাজার ছয়শ বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। তাদের ধরিয়ে দেওয়ার জন্য এখনো রাখাইন রাজ্যে থাকা মুসলিমদের মধ্যে মাইকে প্রচার চালাচ্ছে সরকারের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।