তারকাদের উত্তম স্মৃতি
বাংলার মানুষের কাছে আজও তিনি মহানায়ক, উত্তম কুমার। ১৯৮০ সালের ২৪ জুলাই অগণিত ভক্তদের কাঁদিয়ে ইহলোকের মায়া ত্যাগ করেন মাত্র ৫৯ বছর বয়সী এই প্রবাদপ্রতিম অভিনেতা। তাঁর প্রয়াণের পর কেটে গেছে ৩৪টি শ্রাবণ। তবু বাঙালির কাছে ফুরায়নি উত্তম-ম্যাজিক। আজও উত্তম আবেদনে হিন্দোলিত হয় দুই বাংলা। আজ মৃত্যু দিবস তাঁর। মহানায়কের এই মৃত্যুদিনে বাংলার সংস্কৃতিজগৎ আজও বিনম্রচিত্তে স্মরণ করে তাঁকে। উত্তম কুমার নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মন্তব্য করেছেন পশ্চিমবঙ্গের সিনেজগতের রথী-মহারথীরা। যাঁদের মধ্যে আজ কেউ বেঁচে রয়েছেন, কেউ বা প্রয়াত হয়েছেন। সবই আজ স্মৃতির গর্ভে হারিয়ে যাওয়ার পথে। উত্তম নিয়ে সেই শিল্পী, কুশলীবদের অতীতের নানা মন্তব্য নিয়ে এই প্রতিবেদন। তথ্য সহায়তা নেওয়া হয়েছে খবর ৯ ও স্বভূমি ডেইলি ম্যাগ থেকে।
উত্তম নিয়ে অভিনেত্রী ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত
উত্তমকুমার হলেন রিয়েলি স্টার। তাঁর পাশে নিজেকে দেখতে পাওয়ার স্বপ্ন প্রত্যেক হিরোইনের। আমার তো মনে হয়, ওনার সঙ্গে কাজ করতে না পারাটা জীবনের বিগ মিস। বারবার মনে হয়, যদি একটিবার তাঁর সঙ্গে অভিনয় করা যেত। ‘সপ্তবদী, শিল্পী, হারানো সুর-এর মতো সিনেমায় উত্তম কুমারের পাশে নিজেকে দেখার ভীষণ শখ হয়। এ ছাড়া আরো কত ছবি আছে। কোনটা ছেড়ে কোনটা বলি। সুচিত্রা-সুপ্রিয়ার সঙ্গে উত্তম কুমারের সব ছবিই আমার ভীষণ ফেবারিট। একমাত্র উত্তম কুমারই সময়ের চেয়ে অনেক বেশি এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন বাংলা ছবির মানকে। ওনার মধ্যে অদ্ভুত একটা জীবনীশক্তি ছিল। একজন স্টারকে মানুষ কতটা ভালোবাসতে পারে তা দেখেছিলাম উত্তম কুমারের অন্তিমযাত্রা, যখন আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে যাচ্ছিল। মানুষের উপচে পড়া ভিড় দেখে বুঝেছিলাম তারকা কাকে বলে।
পাওলি দাম
আমি যদি কোনো ছবিতে উত্তম কুমারের নায়িকা হওয়ার সুযোগ পেতাম, তাহলে তো ধেই ধেই করে নাচতাম। সত্যি উত্তমের নায়িকা পাওলি জাস্ট ভাবা যায় না! ওনার সব ছবিতেই আমার নায়িকা হতে ইচ্ছে করে। তবে হ্যাঁ, উত্তমের সঙ্গে রীনা ব্রাউনের চরিত্রে অভিনয় করতে পারলে জীবন সফল হয়ে যেত। উত্তম কুমারের মধ্যে অদ্ভুত একটা চার্ম ছিল। সেই কারণেই সেকাল-একাল সব প্রজন্মের অভিনেত্রীরাই তাঁর নায়িকা হতে চায়। উত্ত-সুচিত্রার ম্যাজিক তো নতুন করে বলার কিছু নয়। তবে সুপ্রিয়া দেবী ও সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর ছবিগুলোও অসাধারণ। উত্তম কুমারের মধ্যে একটা ভালো লাগানোর ক্যারিশমা ছিল। ওনার সঙ্গে কোনোদিন অভিনয় করা হবে না। তবে স্বপ্নেও তাঁকে আমার হিরো ভাবতে ভালো লাগে। আসলে মনে মনে হারিয়ে যেতে তো কোনো মানা নেই।
রচনা বন্দ্যোপাধ্যায়
উত্তম কুমারের নায়িকা হওয়ার চিন্তা আমার কাছে বড় ধৃষ্টতা। ওনার পাশে নিজেকে কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবতে পারি না। আমার মনে হয়, আমার সেই যোগ্যতাও নেই। উনি মহীরূহ হলে আমি তৃণসম। তবে হ্যাঁ, তাঁর ছবি দেখে আজও মুগ্ধ হই। ‘দেয়া-নেয়া’, ‘ওগো বধূ সুন্দরী’ আরো কত মনে রাখার মতো ছবি। এককথায় উত্তম কুমারের সব, সব ছবিই আমার ফেবারিট। উত্তমবাবুই ইন্ডাস্ট্রিকে শিখিয়েছিলেন, যে একজন প্রকৃত নায়ক কেমন হবে। তিনি বলতেন, একজন নায়ক যদি রাস্তা দিয়ে হেঁটে বেড়ান, তাহলে লোকে টাকা খরচা করে তাঁকে হলে দেখতে যাবেন কেন? সুচিত্রা-সুপ্রিয়া-সাবিত্রী তিনজন নায়িকার সঙ্গে কী অদ্ভুত তাঁর কেমিস্ট্রি! আজকের বাংলা ইন্ডাস্ট্রি ভাবতেই পারে না। আজও আমি টিভিতে উত্তম কুমারকে দেখলে চ্যানেল বদলাই না।
গার্গী রায়চৌধুরী
উত্তম কুমারের সঙ্গে যদি অভিনয় করার সুযোগ পেতাম, তাহলে মুহূর্তটা অবিস্মরণীয় হয়ে থাকত। উত্তম কুমারের থেকে শিক্ষণীয় প্রচুর। তিনি ছিলেন পরশ পাথর। তাঁর সংস্পর্শে এসে সব কিছুই সোনা হয়ে যেত। যেমন তাঁর ব্যক্তিত্ব, বাচনভঙ্গি, স্টাইল-সত্যিই দুর্লভ। তিনি চিরকাল মনের মণিকোঠায় মহানায়ক হয়ে থাকবেন।
তনুশ্রী চক্রবর্তী
স্বপ্নপূরণ হতো যদি উত্তম কুমারের পাশে তাঁর নায়িকা হতে পারতাম। অভিনেত্রী জীবন ধন্য হয়ে যেত। তাঁর ছবি দেখলে আজও মন্ত্রমুগ্ধ হতে হয়। কোনটা ছেড়ে কোনটার নাম বলি! উত্তম কুমার চিরকালই মহানায়ক। তাঁর তুলনা নেই।
অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়
উত্তম হলো এক বর্ণময় ছবি। যাতে জিজ্ঞাসা আর সমাধান দুটোই আছে।
তরুণ মজুমদার
উত্তমবাবু নিজেকে ঘষেমেজে এমন একটা জায়গায় নিয়ে গিয়েছিলেন, যা থেকে কোনোদিন বিচ্যুতি হননি। ওঁর আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তার একটা বড় কারণ ওঁর অভিনয়ের সহজবোধ্যতা এবং স্বতঃস্ফূর্ততা।
তরুণ কুমার
অভিনয় ছাড়া দাদা যে আর কিছুতে বিশ্বাস করত না তা বুঝেছিলাম থিয়েটারে নাটক ‘শ্যামলী’তে অভিনয় করার সময়।
দিলীপ রায়
উত্তম কুমার আমার কাছে এক বিস্ময়! এই কারণেই যে, যাকে একদিন টালিগঞ্জের চিত্রনির্মাতারা আর দর্শকরা অপদার্থ, অযোগ্য, রদ্দি, ভুসি, অচল এবং ফ্লপ মাস্টার জেনারেল বলে ছুড়ে ফেলে দেয়, পরে তাদের সবার কাছে তিনি অরুণ থেকে উত্তম কুমার হয়ে গেলেন।
সত্যজিৎ রায়
আজ অনেকে আছেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই ভালো অভিনয় করেন। কিন্তু উত্তমের মতো কেউ নন, কেউ হবে না।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়
উত্তম কুমার যদি তাঁর অভিনেতা আর স্টারের দ্বন্দ্ব কাটিয়ে উঠতে পারতেন বা সরিয়ে ফেলতে পারতেন অভিনয়ের প্রথম ও দ্বিতীয় সত্তার মাঝের দেয়ালটা, তাহলে ওঁর কাছ থেকে আমরা আরো অনেক কিছু পেতে পারতাম।
গৌরি প্রসন্ন মজুমদার
উত্তমের গলার গান ভাবলেই আপনা থেকেই আমার গান লেখা হয়ে যেত।
সুচিত্রা সেন
উত্তম আমার থেকে কয়েক ধাপ এগিয়ে আছে। বাড়িতে অভিনয়ের পরিবেশে যাত্রা-থিয়েটার করে ধাপে ধাপে যেভাবে উত্তম নিজেকে তৈরি করেছে আমার সে সুযোগ একেবারেই ছিল না। উত্তম আমার বন্ধু। এককথায় গ্রেট। তবুও মনে হয় ওকে ঠিকমতো এক্সপ্লয়েট করা হয়নি।
কানন দেবী
ঈশ্বর উত্তমকে সব দিয়েছিলেন, শুধু সত্যিকারের বন্ধু দেননি।
অরুন্ধতি দেবী
সব সময় মনে হয়েছে সুযোগ হলে আবার ওঁর সঙ্গে অভিনয় করব।
মাধবী মুখোপাধ্যায়
রূপকথার রোমান্টিক নায়কটির ব্যক্তিসত্তা নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে কোনো দিনই ভাবিনি আমি। ভাবতে চাইনি। কী জানি যদি স্বপ্নভঙ্গ হয়!
সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়
যখন তিনি যা করেন, সেটাই রিমার্কেবল হয়ে দাঁড়ায়। এটাই বোধহয় উত্তম বৈশিষ্ট্য।
আর যাকে নিয়ে এত মন্তব্য, তিনি (উত্তম কুমার) বলতেন, ‘আমি ভালোবেসেছি আপনাদের। আপনাদের আনন্দ ফিয়ে সেবা করতে চেয়েছিলেম আমার মনপ্রাণ ঢেলে। চিত্রনির্মাতারা আমার অধিকাংশ সময়ই কিনে নিয়েছেন। আমাকেও তাই পাল্লা দিয়ে ছুটতে হয় ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে। নানা ধরনের রোমান্টিক চরিত্রে অভিনয় করতে গিয়ে দেখেছি বাংলা ছবির নায়ককে যেন সব সময় বোকা বোকা থাকতে হয়। তাঁর সাজগোজটা হবে কেয়ারফুল অথচ কেয়ারলেস, অর্থাৎ সব ব্যাপারটাই সে বোঝে অথচ উদাসীন। প্রথম দিকে দর্শক আমাকে নেননি। তাই অভিনয়ে নিষ্ঠার দাম আমি বুঝেছিলাম। আমি শুধু ব্যস্ততার ঘূর্ণিপাকে ঘুরপাক খাচ্ছি। আমার পাশপাশে ঘুরপাক খাচ্ছেন অনেকেই। আমরা প্রত্যেকে প্রত্যেকের জন্য ব্যস্ত। এত ব্যস্ততার মধ্যেও আমি কিন্তু আমার গানকে ভুলে যাইনি কখনো। যখনই একটু অবসর পেয়েছি, তখনই বসেছি গানের চর্চা নিয়ে।’