সাক্ষাৎকারে রোহিঙ্গা বিষয়ে সু চি যা বললেন

Looks like you've blocked notifications!

প্রথমবারের মতো মুখোমুখি সাক্ষাৎকারে কথা বললেন মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করে জাপানের গণমাধ্যম এনএইচকে। দীর্ঘ এই সাক্ষাৎকারের বেশিরভাগ সময়টাতেই এনএইচকের সাংবাদিক সুগিমতো রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে প্রশ্ন করেন। এ সময় সু চি জানান, রোহিঙ্গা সমস্যার মতো এত প্রকট সমস্যা এত দ্রুত সমাধান সম্ভব না। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে এর দায় বাংলাদেশের ওপরেও বর্তানোর চেষ্টা করেন এই নেত্রী।

সাক্ষাৎকারটি এনটিভি অনলাইনের পাঠকদের জন্যে সংক্ষেপ করে প্রকাশ করা হলো:

সুগিমতো : সম্প্রতি মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের রাখাইনে প্রত্যাবাসনের জন্যে জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর সহায়তা চেয়েছে। একই সঙ্গে রাখাইনে মানবাধিকার লঙ্ঘন করে গণহত্যার বিষয়ে একটি নিরপেক্ষ তদন্ত করতে কমিটি গঠনের কথা বলছে।

এই পদক্ষেপগুলো শরণার্থীসহ আন্তর্জাতিক মহলের বহু দিনের চাওয়া। কিন্তু মিয়ানমার সরকার কেন এই সময়ে এসে এই পদক্ষেপগুলো নিচ্ছে।

সু চি : এটা আমরা এখনই ভাবছি না। এটা একটা প্রক্রিয়া। সম্ভবত মানুষ জানে না, যে আমরা কিন্তু জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে আসছি এবং এটা এবার জাতিসংঘের দূতদের দল পরিদর্শনে আসার আগেই। এই তদন্ত কমিটি মিয়ানমারে আসার পরে আমাদের উপদেষ্টা বোর্ড তাদের এই পরামর্শ দেয়। আমরা এই পরামর্শকে খুব গুরুত্বের সঙ্গে দেখেছি এবং তাদেরকে নিয়োজিত করেছি। কেননা, আমরা মনে করি, তারা আমাদের বর্তমান পরিস্থিতির খুব ভালো সমাধান দিতে পারবে।

সুগিমতো : আমরা কি জানতে পারি,এ পদক্ষেপগুলো নিতে এত দেরি হলো কেন? এমন কি বাধার কারণে এতদিন এসব পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হয়নি?

সু চি : না, দেরি হয়েছে আপনি এটা বলতে পারেন না। কারণ আপনি মনে করে দেখবেন, উপদেষ্টা বোর্ড মাত্র কয়েক মাস আগেই তাদের সুপারিশগুলো জানিয়েছে। সুতরাং জাতীয় কমিটি করতে গিয়ে আমরা খুব বেশি সময় নিয়েছি,এটা আপনি বলতে পারেন না।

আমরা ইউএনডিপি এবং ইউএনএইচসিআরের সঙ্গে আলোচনা করছি এবং আলোচনা করব। কিন্তু সমঝোতা স্মারকে সাক্ষরের আগে আমাদের দুই দিকই ভালো করে পর্যালোচনা করা উচিত।

কিছু বিষয় আছে যেগুলোর সঙ্গে আমরা তাৎক্ষণিকভাবেই সম্মত হতে পারছি। আবার কিছু বিষয় আছে, যেগুলো কিছু বাধার কারণে বাদ দিতে হচ্ছে। তাই, সমঝোতা স্মারক যদি আমরা চাই, তাহলে তা অবশ্যই অর্থবহ এবং প্রয়োগ যোগ্য হতে হবে। আমার মনে হয়, এ ব্যাপারে কিছু সময় নেওয়াই ভালো।

সুগিমতো : কোন বিষয়টি মেনে নেওয়া মিয়ানমারের জন্যে কঠিন ছিল?

সু চি : আমার মনে হয়, এমন একটা বিষয় ছিল, যেটা আমাদের এবং জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর জন্যেও কঠিন ছিল।এটা অনেকগুলো বিষয় নিয়ে একটা প্রশ্ন ছিল। কিন্তু তার কোনো বিষয়ই আলাদা না বরং পারস্পরিক। প্রশ্নটা হলো, আমরা এখন কেন একটা চুক্তিতে আসছি।

সুগিমতো : রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর গণহত্যা চালানোর অভিযোগে সারা বিশ্বব্যাপী মিয়ানমারের সমালোচনা হয়েছে। আমি নিজেও মিয়ানমার সরকারকে বলতে শুনেছি, এটা খুবই জটিল বিষয়। কখনো কখনো আন্তর্জাতিক মহলের এই বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা উচিত না। এটা কেন, বলবেন?

সু চি : প্রথমেই বলতে চাই, এটা বহুদিনের একটা সমস্যা। মানুষ ভুলেই গেছে, এই সমস্যার দুই শতক হয়ে গেছে। এটা গতকালের ঘটনা না। এতদিনের একটা সমস্যা কয়েক মাসে সমাধান সম্ভব না। আর আমাদের সরকার মাত্র দুই বছর হলো দায়িত্ব নিয়েছে। তাই এটা হঠাৎ করে সমাধান সম্ভব না।

আর মিয়ানমারের বাইরে এবং ভেতরে খুব কম মানুষই এই সমস্যার সঙ্গে জড়িত অনেক ঐতিহাসিক বিষয়ে জানেন না। সুতরাং শুধু বহির্বিশ্বের মানুষের জন্যে নয়, আমাদের লোকেদের জন্যেও জানা প্রয়োজন যে, কী ঘটছে। আমরা যে পদক্ষেপগুলো নিলাম, তা কেন নিয়েছি। কেননা, আমাদের দেশের স্থিতিশীলতা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

সুগিমতো : এটা কতটা জটিল, এ বিষয়ে ব্যাখ্যা করা কি মিয়ানমারের জন্যে কি খুব বেশি বিপজ্জনক হয়ে পড়বে?

সু চি : আমার মনে হয়, সব বিষয়ে না বিবেচনা করে, এত গভীর একটা সমস্যা নিয়ে সামনে এগোনো যে কারো জন্যেই বিপজ্জনক।

সুগিমতো : এই পদক্ষেপগুলো আরো দ্রুত নিতে মিয়ানমারের সামনে কি ধরনের ঝুকি রয়েছে?

সু চি : আপনি সবকিছু নিয়েই তাড়াহুড়ো করতে পারেন না। যেটার জন্যে সময় প্রয়োজন সেটাতে সম্পয় দিতে হয়।আপনি জোর করতে পারবেন না। আপনি হঠাৎ করে মানুষকে বলতে পারেন না, যে ‘এখন আগের সবকিছু ভুলে যাও এবং নতুন করে শুরু করো। শুধু আদেশ দিলেই হবে না। আপনাকে এমন পরিবেশ তৈরি করতে হবে, যাতে তারা বুঝতে পারে, যে কেন তাদের সমস্যা সমাধানের ভিন্ন রাস্তা খুঁজতে হবে।

সুগিমতো : আপনার কি মনে হয় যে, তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন নির্ভরযোগ্য, নিরপেক্ষ হবে? তারা আন্তর্জাতিক মহলের কাছে জানাবে যে, মিয়ানমার সরকার আইন অনুযায়ীই কাজ করছে?

সু চি : কমিশনে এখন আসলে কি হচ্ছে, আমরা এখন বলতে পারছি না। কিন্তু আমরা কেবল বিশ্বস্ত মানুষদেরই এই কাজে নিয়োজিত করেছি।

সুগিমতো : এই তদন্তের ফলে অবস্থার কোনো উন্নতি হবে বলে আপনি মনে করছেন?

সু চি : আমাদের উপদেষ্টা কমিটি এটা করাই ভালো মনে করেছে এবং আমাদের আত্মবিশ্বাস রয়েছে যে, এই তদন্ত অবস্থার উন্নতি করবে।

সুগিমতো : একটা আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিটির না হয়ে জাতীয় আন্তর্জাতিক কমিটি কেন পছন্দ করলেন? এটা তো জাতিসংঘের তদন্ত কমিটিও হতে পারতো।

সু চি : আমরা বারবার ব্যাখ্যা করেছি যে, এই বিষয়ে আমরা জাতিসংঘের তদন্ত অভিযান মেনে নিতে পারি না। আমাদের উপদেষ্টা পরিষদ এটার পরামর্শ দিয়েছে এবং আমরাও এটা খুব গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছি।

সুগিমতো : কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরে অনেক রোহিঙ্গা মিয়ানমারে ফিরতে চাইছে না। তাদের ভয়, ফিরলে আবারো তাদের উপরে নির্যাতন হতে পারে। এটাও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে একটা সমস্যা। তাহলে মিয়ানমার এই রোহিঙ্গাদের এবং আন্তর্জাতিক মহলের বিশ্বাস অর্জন কিভাবে করবে?

সু চি : আস্থা একটা দ্বি-পক্ষীয় বিষয়। আমার মনে হয় না, আস্থা তৈরি করা কেবল মিয়ানমারের দায়িত্ব। অপরপক্ষের লোকদেরও আস্থা তৈরিতে কাজ করতে হবে।

উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের সমঝোতা স্মারকে যে ফরম পূরণের কথা বলা হয়েছিল, সেসব ফরম রোহিঙ্গাদের মধ্যে বণ্টন করা হয়নি। এখন রোহিঙ্গারা যদি না জানে যে, রাখাইনে ফিরে যেতে তাদের একটা বৈধ এবং নিরাপদ উপায় আছে, তাহলে আমরা খুব দ্রুত কোনো ব্যবস্থা নিতে পারব না। সমঝোতা স্মারক দুই বা তার বেশি গোষ্ঠীর মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়। আর তাই, শর্তগুলো পূরণে দায়িত্ব সবারই সমান।

সুগিমতো : আমি জানি আপনার জন্য হয়তো এটা পরিষ্কারভাবে বলা সম্ভব না। কিন্তু, শরণার্থীদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ঠিক কবে থেকে শুরু হতে পারে?

সু চি : এটা আমাদের ওপর যেমন নির্ভর করে, ঠিক তেমনি বাংলাদেশের ওপরও নির্ভর করে। এটা একটা দ্বিপক্ষীয় বিষয়। যতদিন পর্যন্ত শরণার্থীরা এ সব ফরমগুলো না পূরণ করবে। যতদিন রাখাইনে ফিরে যেতে করণীয়গুলো রোহিঙ্গারা না জানবে, আমরা এ বিষয়ে দ্রুত কোনো পদক্ষেপ নিতে পারব না। আপনি হয়তো বা জানেন, কেউ কেউ ফিরে এসেছে। কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে না এবং ফিরে এসে তারা বলেন, যে তারা ফরম সম্পর্কে এবং করণীয়গুলো সম্পর্কে জানতেন না।

সুগিমতো : এই সমস্যা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আপনি কি কখনো সত্যিকার পরিস্থিতি, জাতীয় ঐক্য ও সামরিক শক্তি নিয়ে উভয়সংকটে পড়েন?

সু চি : আমি জানি না, আপনি কি বলতে চাইছেন। কারণ আমি মনে করি না, রাখাইনে যা ঘটেছে তাতে সেনাবাহিনীর সরাসরি কোনো প্রভাব রয়েছে। আমি জানি, আমার মনে হয় আপনিও জানেন, আমাদের সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচিত সরকার সেনাবাহিনীর কোনো কাজের নির্দেশনা দিতে পারবে না। তাই, অবশ্যই পুরোপুরি গণতান্ত্রিক দেশ হতে যা লাগে আমরা তা করতে পারছি না।

সুগিমতো : সাম্প্রতিক সময়ে রাখাইনে প্রতিবেদন করার সময় রয়টার্সের দুইজন সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হয়। এ ঘটনায় অগণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে এবং কথা বলার স্বাধীনতা নেই বলে মিয়ানমারের সমালোচনা করা হয়েছে। এই বিষয়ে আপনি কি বলতে চাইবেন? আন্তর্জাতিক মহল যেমন মনে করে, মিয়ানমারের গণতন্ত্র কি তার চাইতে আলাদা?

সু চি : তারা রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে প্রতিবেদন করার জন্যে গ্রেপ্তার হননি। তারা সরকারি গোপনীয়তা ভঙ্গের দায়ে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন।

সুগিমতো : তারা হয়তো প্রতিবেদন করার জন্যে গ্রেপ্তার হননি। কিন্তু প্রতিবেদন করার সময়…

সু চি: আর অন্যান্য বিষয় আছে। আমার মনে হয়, আপনি যদি আদালতের তৎপরতা খেয়াল করেন, দেখবেন, সরকারি গোপনীয়তা ভঙ্গের অন্যান্য বিষয় ছিল।

অনুবাদ : জান্নাতুল মাওয়া অনন্যা