‘ভারতীয় রাজনীতিতে একটি অধ্যায়ের যবনিকা’
বৃহস্পতিবার বিকাল ৫টা ৫ মিনিট। ভারতীয় রাজনীতিতে একটি অধ্যায়ের যবনিকা ঘটলো। চিরদিনের মতো না ফেরার দেশে চলে গেলেন ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ি। তিনি চলে গেলেন কিন্তু গোটা ভারতের কাছে রেখে গেলেন পথ চলার বার্তা। একদিকে কবি, অন্যদিকে সুবক্তা সেই সঙ্গে রাজনীতিতে অসাধারন পার্লামেন্টারিয়ান ছিলেন তিনি। ভারতীয় রাজনৈতিক মহলের সর্বস্তরে তিনি হয়ে উঠেছিলেন জনপ্রিয়। তাঁর মৃত্যুতে আজ গোটা ভারতের রাজনৈতিক মহল শোকে আচ্ছন্ন।
অটল বিহারি বাজপেয়ি মনে করতেন, প্রত্যেকেরই আগে মানুষ হওয়া দরকার। তবে মানুষ হওয়া মানে, বিনয়ী হওয়া, কিন্তু দুর্বল হওয়া নয়। মানুষ হওয়া মানে শক্তিশালী হওয়া, কিন্ত হিংস্র হওয়া নয়। তবেই দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে। নিজের শাসনকালে সেই বার্তাই বারবার দিয়েছেন তিনি।
বাজপেয়ির মৃত্যুতে ভারতের রাজনৈতিক মহলে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ শোকপ্রকাশ করে বলেন, ‘ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী তথা ভারতের বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব অটল বিহারি বাজপেয়ির প্রয়াণে আমি মর্মাহত। আমরা সবাই তাঁর অভাব অনুভব করব।’
বাজপেয়ির মৃত্যুতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেন, ‘আমি ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। আমি আবেগপ্রবন হয়ে পড়েছি। আমাদের শ্রদ্ধেয় অটলজি আর নেই। উনার জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত ভারতের সেবার জন্য নিয়োজিত। অটলজির মৃত্যুতে একটা অধ্যায়ের শেষ হলো।’
অটলবিহারী বাজপেয়ির মৃত্যুতে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘অটল বিহারি বাজপেয়ির মৃত্যুতে ভারতের বড় ক্ষতি হলো। তাঁর মৃত্যু জাতির জন্য একটা বড় ক্ষতি।’
বাজপেয়ির প্রয়াণে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখ্যপাধ্যায় বলেন, ‘আমি গভীরভাবে শোকাহত। প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তিনি ছিলেন গণতন্ত্রের প্রতি অবিচল। বিরোধীতার ক্ষেত্রে ছিলেন গঠনমূলক, সমালোচক। তাঁর প্রয়াণে ভারত একজন মহান সন্তানকে হারালো। ভারতের একটা যুগের অবসান হলো।’
অটল বিহারি বাজপেয়ির মৃত্যুতে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী বলেন, ‘আজ ভারত তার এক মহান পুত্রকে হারালো।’
বাজপেয়ি ছিলেন চিরকুমার
১৯২৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর ভারতের মধ্যপ্রদেশ রাজ্যের গোয়ালিয়রে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন অটল বিহারি বাজপেয়ি। বাবা কৃষ্ণবিহারি বাজপেয়ি ছিলেন পেশায় একজন স্কুল শিক্ষক ও কবি। মা কৃষ্ণা দেবী ছিলেন গৃহবধু। ব্রাহ্মন পরিবারে জন্মেছেন কিন্তু শৈশব থেকেই তিনি ছিলেন উদার মনের। গোয়ালিয়রের স্বরস্বতী শিশু মন্দিরে জীবনের প্রথম পাঠ নেন তিনি। স্কুল জীবনে পড়াশুনা শেষ করে স্নাতক পর্যায়ে পড়াশোনা করেন ভিক্টোরিয়া কলেজে। এরপর কানপুরের অ্যাংলো-বৈদিক কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর পাশ করেন তিনি।
পড়াশোনার সময়ই বাজপেয়ি বুঝতে পেরেছিলেন দেশকে রক্ষা করতে গেলে রাজনীতিই হলো একমাত্র পথ। যে কারনে যুব বয়েসেই ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন তিনি। ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে যোগ দেন তিনি। জীবনে একটা সময় রাষ্ট্রধর্ম হিন্দি মাসিক পত্রিকা, ‘পঞ্চজন্য’ হিন্দি সাপ্তাহিক পত্রিকা এবং ‘স্বদেশ’ ও ‘বীর অর্জুন’ দৈনিক পত্রিকায় কাজ করেন তিনি।
অটল বিহারি বাজপেয়ি ছিলে চিরকুমার। দত্তক নিয়েছিলেন মেয়ে নমিতাকে।
এই অটল বিহারি বাজপেয়ি ১৯৯৮ সালে ভারতের রাজস্থান রাজ্যের পোখরানে পাঁচটি পারমানবিক বোমা পরীক্ষা করেন। আবার ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনায় আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘এই ঘটনা বিজেপির সবচেয়ে খারাপ ও ভুল কাজ।’ আজও বাজপেয়ির জন্মদিন ২৫ ডিসেম্বর ভারতের সুশাসন দিবস হিসাবে পালন করা হয়।
বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন
১৯৫৭ সালের লোকসভা নির্বাচনে ভারতের বলরামপুর আসন থেকে প্রথম সংসদ সদস্য হিসাবে ভারতের পার্লামেন্টে প্রবেশ করেন অটল বিহারি বাজপেয়ি। ভারতের ইন্দিরা গান্ধীর শাসনামলে জারি করা জরুরি অবস্থার প্রেক্ষিতে ১৯৭৫ সালে জয়প্রকাশ নারায়নের নেতৃত্বে আন্দোলনেও নেমেছিলেন বাজপেয়ি। ১৯৭৭ সালে মোরারজি দেশাইয়ের সঙ্গে জনতা পার্টি জোট করে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হয়েছিলেন অটলবিহারি বাজপেয়ি।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবে জাতিসংঘের সাধারণ সভায় তিনি প্রথম হিন্দি ভাষায় বক্তব্য দেন বাজপেয়ি। ১৯৮০ সালে লালকৃষ্ণ আদভানি, ভৈরব সিং শেখওয়াতসহ বিভিন্ন নেতাদের নিয়ে তৈরি করেন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। তিনি ১০ বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
১৯৯৬ সালে তিনি প্রথম ভারতের প্রধানমন্ত্রী হন। কিন্ত সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমান করতে না পারায় মাত্র ১৩ দিনের মাথায় পদত্যাগ করতে হয় তাঁকে। এরপর ১৯৯৮ সালে দ্বিতীয়বার ভারতের প্রধানমন্ত্রী হন তিনি। কিন্ত জোট সরকার থেকে এআইএডিএমকে সমর্থন তুলে নেওয়ায় ১৩ মাসের মাথায় তাঁর সরকার পড়ে যায়। এরপর তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হয়ে ১৯৯৯ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছর সরকারের মেয়াদকাল পূর্ণ করেন তিনি। অটল বিহারি বাজপেয়ির আমলেই ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে শান্তিস্থাপন করতে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট পারভেজ মুশারফের সঙ্গে চুক্তি হয়। কাশ্মীরে শান্তি প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে দিল্লি-লাহোর বাস সার্ভিস চালু করেছিলেন ১৯৯৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। তাঁর আমলে ভারতের কার্গিলে পাক সেনাদের আগ্রাসন দমনে তিনিই নির্দেশ দিয়েছিলেন যুদ্ধের। যে যুদ্ধে জয় হয় ভারতের।
২০০৪ সালে ভারতে এনডিএ সরকারের পতনের সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতি থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন বাজপেয়ি। জীবনে তিনি পেয়েছেন লিবারেশন ওয়্যার অ্যাওয়ার্ড, পদ্মবিভূষন, ডি লিট, লোকমান্য তিলক পুরস্কার, সেরা সাংসদ পুরস্কার, ভারতরত্ন পন্ডিত গোবিন্দ বল্লভ পান্থ পুরস্কার এবং ভারতরত্ন পুরস্কার।