জাতিসংঘের প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান মিয়ানমারের
রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা নিধনের বিষয়ে জাতিসংঘের তদন্ত প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে মিয়ানমার। মিয়ানমারের উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ‘রোহিঙ্গা গণহত্যার’ অভিযোগ এনে গত সোমবার জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন এই তদন্ত প্রতিবেদন দেয়। প্রতিবেদনে, শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাদের বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানোর সুপারিশ করা হয়। এরপর মঙ্গলবার মিয়ানমার সরকারের মুখপাত্র প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যানের কথা জানান।
মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সরকারের মুখপাত্র জ হতয়ে বলেন, ‘আমাদের অবস্থান পরিষ্কার, আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই যে, মানবাধিকার কাউন্সিল পরিচালিত কোনো সিদ্ধান্ত আমরা মেনে নেব না।’
মিয়ানমারে জাতিসংঘের কোনো তদন্তকারীকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি উল্লেখ করে জ হতয়ে বলেন, ‘এ জন্যই আমরা মানবাধিকার কাউন্সিলের কোনো সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত নই।’
সরকারি ওই মুখপাত্র আরো জানান, মিয়ানমার মানবাধিকার লংঘনের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি প্রদর্শন করে। এরই মধ্যে জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক মহলের ‘ভুল অভিযোগের’ পরিপ্রেক্ষিতে দেশটিতে একটি তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
জাতিসংঘের প্রতিবেদনের বেশিরভাগ অভিযোগ অস্বীকার করে মিয়ানমার জানায়, রাখাইন রাজ্যের পশ্চিমাংশে পুলিশ চৌকিতে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের হামলার প্রতিক্রিয়ায় দেশটির সেনাবাহিনী আইনত বৈধ অভিযান পরিচালনা করে।
‘যদি মানবাধিকার লংঘনের কোনো ঘটনা ঘটে, আমাদের সেই তারিখ, ঘটনা আর প্রমাণ বলুন যাতে করে আমরা আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারি’ বলেন জ হতয়ে।
জাতিসংঘের তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশের পর ওই দিনই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক মিয়ানমারের সেনা প্রধান মিং অং হ্লেইংসহ আরো কয়েকজন জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তার অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেয়। যাতে তারা ফেসবুককে ‘ঘৃণা ও ভুল তথ্য’ পরিবেশনের ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করতে না পারে।
ফেসবুকের এ ভূমিকা প্রসঙ্গে জ হতয়ে বলেন, সরকার এ ব্যাপারে ফেসবুকের কাছে প্রশ্ন রেখেছে। ফেসবুকের ওই ঘটনা মিয়ানমারের জনগণের মধ্যে সমালোচনা ও আতংকের সৃষ্টি করেছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘নির্বিচার হত্যা, গণধর্ষণ, শিশু নির্যাতন ও গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া—এসব ঘটনাকে সামরিক অভিযান পরিচালনার কথা বলে কোনোভাবেই ন্যায্যতা দেওয়া যাবে না।’
গত বছরের মার্চে মিয়ানমারে, বিশেষ করে রাখাইন রাজ্যে, মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগ তদন্তের জন্য জাতিসংঘ ইনডিপেনডেন্ট ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশন গঠন করে।
গত বছরের ২৪ আগস্টে কয়েকটি পুলিশ চেকপোস্টে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীরা হামলা চালায়। এর পরের দিন থেকে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমার সেনাবাহিনী অভিযান পরিচালনা করে। এ সহিংস অভিযানের পরিপ্রেক্ষিতে সাত লক্ষাধিক রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। বিভিন্ন সময় সহিংসতার শিকার আরো চার লাখ রোহিঙ্গা তার আগে থেকেই বাংলাদেশের কক্সবাজারে অবস্থান করছে।
প্রতিবেদনে জাতিসংঘ উল্লেখ করে, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী মিয়ানমারে দশকের পর দশক বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে আছে। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই ভয়াবহ নিপীড়নের শিকার তারা।
তদন্ত পরিচালনার জন্য মিয়ানমার সরকার দেশটিতে জাতিসংঘের প্রতিনিধিদের প্রবেশ করতে না দিলেও প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষাৎকার, স্যাটেলাইট চিত্র, অন্যান্য ছবি ও ভিডিওর ওপর ভিত্তি করে প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়।
আন্তর্জাতিক বেসরকারি চিকিৎসা সংস্থা ‘এমএসএফ’-এর মতে, গত বছরের আগস্টে রাখাইনে সেনাবাহিনীর চালানো সহিংসতার প্রথম মাসেই অন্তত ছয় হাজার ৭০০ রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়। এদের মধ্যে পাঁচ বছরের কম বয়সী ৭৩০ শিশুও ছিল।