বাংলাদেশের মানবাধিকার নিয়ে অ্যামনেস্টির উদ্বেগ

Looks like you've blocked notifications!

বাংলাদেশের সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে লন্ডনভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। ২০১৪-১৫ বছরের বার্ষিক প্রতিবেদনে অ্যামনেস্টি এ উদ্বেগ প্রকাশ করে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে বহু লোককে জোরপূর্বক ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মীরা অব্যাহত হামলা ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন। নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা অন্যতম উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এতে আরো বলা হয়, পুলিশ ও অপরাপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা নির্যাতন করলেও তাদের বিচার হচ্ছে না। কারখানার শ্রমিকরা ঝুঁকিপূর্ণ কর্মস্থলে কাজ করে যাচ্ছেন। কমপক্ষে একজন ব্যক্তি কোনো আপিলের সুযোগ না পেয়েই মৃত্যুদণ্ড ভোগ করেছেন।

পটভূমি
জানুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয় ঘোষণা হওয়ার পর থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় বসে। বিরোধী দল বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট ওই নির্বাচন বর্জন করে। ওই নির্বাচনবিরোধী প্রতিবাদে শতাধিক লোক নিহত হয়েছে। এদের মধ্যে কয়েকজন পুলিশের প্রকাশ্য গুলিতে নিহত হয়। এসব হত্যা নিয়ে তদন্তের আলামত দেখা যাচ্ছে না। 

বিরোধী দলের সমর্থকরা বাসে পেট্রলবোমা হামলা চালিয়ে কমপক্ষে নয়জনকে আহত করেছে। এসব হামলায় আহত হয়েছে আরো বহু লোক।

১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় সংঘটিত অপরাধের বিচারে ২০০৯ সালে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায় অত্যন্ত একপেশে রাজনৈতিক পরিবেশে হচ্ছে। এই বিচারের পক্ষের লোকজন মজবুত প্রমাণ ছাড়াই আসামিদের মৃত্যুদণ্ডের দাবি করছে।

জোরপূর্বক গুম
মানবাধিকারবিষয়ক ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, কতজনকে জোর করে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তা নিশ্চিত নয়। তবে ধারণা করা হচ্ছে, ৮০ জনের বেশি লোককে গুম করা হয়েছে। অ্যামনেস্টি ২০১২ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে ২০ জন নিখোঁজের তথ্য পায়। এঁদের মধ্যে নয়জনকে গুমের পর হত্যা করা হয়। কয়েক সপ্তাহ বা মাস আটক রেখে ছয়জনকে তাঁদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। বাকি পাঁচজনের বিষয়ে কোনো কিছু জানা যায়নি।

নারায়ণগঞ্জে ২০১৪ সালের এপ্রিলে গুমের পর সাতজনকে খুন করা হয়। অপহরণ ও খুনের এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‍্যাব) তিন কর্মকর্তাকে আটক করে তদন্ত শুরু হয়। বছর শেষে এ ঘটনায় ১৭ র‍্যাব সদস্যের জড়িত থাকার খোঁজ পাওয়া যায়। ২০০৪ সালে বাহিনী গঠনের পর র‍্যাবে এমন ঘটনা এটাই প্রথম।

প্রতিবেদনে বলা হয়, মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ থাকা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে চলা তদন্তকে স্বাগত জানায় অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। এরপরও জনগণের চাপ কমে গেলে  সরকার মামলাটিকে আড়াল করে ফেলতে পারে। এ মামলা ছাড়া ফেব্রুয়ারিতে আব্রাহাম লিংকন নামে এক ব্যক্তি হত্যার মতো অন্য কোনো ঘটনায় তদন্তের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

মত প্রকাশের স্বাধীনতা
সরকার তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আইনের ৫৭ ধারা ব্যবহার করে মত প্রকাশের স্বাধীনতা মারাত্মকভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছে। এই ধারায় শান্তিপূর্ণ কর্মকাণ্ডকে অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। সংবাদপত্রে নিবন্ধে ইসলাম ধর্মীয় মূল্যবোধের সমালোচনা কিংবা মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে লেখাকেও এ ধারা অনুযায়ী অপরাধ বিবেচনা করা হয়েছে। ৫৭ ধারা অনুযায়ী, ২০১৩-১৪ সময়ে কমপক্ষে চারজন ব্লগার, দুজন ফেসবুক ব্যবহারকারী ও মানবাধিকার সংগঠনের দুজন কর্তাব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়। এঁদের মধ্যে আছেন ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিন, সুব্রত অধিকারী শুভ, মশিউর রহমান বিপ্লব ও রাসেল পারভেজ। দুই মানবাধিকারকর্মী হলেন আদিলুর রহমান খান ও নাসিরুদ্দিন এলান।

প্রতিবেদনে বলা হয়, সাংবাদিকসহ গণমাধ্যম-সংশ্লিষ্ট বেশ কয়েকজন দাবি করেছেন, তাঁরা নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের হুমকির মুখে আছেন। এ হুমকি মুঠোফোনে কিংবা সম্পাদকদের কাছে বার্তা পাঠিয়েও হচ্ছে। ফলে অনেক সাংবাদিক ও টকশোর আলোচক মত প্রকাশে স্বেচ্ছা নিয়ন্ত্রণ শুরু করেছেন বলে দাবি করেছেন।  

কিছু ধর্মীয় গোষ্ঠীও মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে হুমকির মুখে ফেলছে। কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে কিংবা কর্মস্থল থেকে ইসলামের অবমাননা করেছেন বলে কিছু গোষ্ঠী দাবি করেছেন। এ ধরনের অন্তত ১০টি ঘটনা ঘটেছে। ধর্মীয় উসকানির অভিযোগে কমপক্ষে পাঁচজনের ওপর হামলা চালানো হয়। এঁদের দুজন নিহত হন। বাকিরা গুরুতর আহত হয়েছেন। 

নিহত দুজন হলেন ব্লগার আহমেদ রাজীব ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এ কে এম শফিউল ইসলাম। এঁদের মধ্যে শফিউল ২০১৪ সালের নভেম্বরে ছুরিকাঘাতে নিহত হন।

নারী ও মেয়েদের প্রতি সহিংসতা
নারীর প্রতি সহিংসতা বাংলাদেশে মানবাধিকারবিষয়ক অন্যতম উদ্বেগ। বাংলাদেশের নারী অধিকার সংগঠন মহিলা পরিষদের গণমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে করা বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ২০১৪ সালের অক্টোবরেই ৪২৩ জন নারী ও মেয়ে বিভিন্ন ধরনের সহিংসতার শিকার হয়েছে। সংগঠনটি বলেছে, ৪২৩ জনের মধ্যে এক শরও বেশি নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এঁদের ১১ জন নিহত হয়েছেন। যৌতুক দিতে না পারায় ৪০ জনের বেশি শারীরিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন। এঁদের ১৬ জন আঘাতে মারা গেছেন।

নারী ও মেয়েরা ঘরে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। তাঁদের এসিড ছোঁড়া হচ্ছে, পাচার করা হচ্ছে।

নির্যাতন ও অন্যান্য লাঞ্ছনা
নির্যাতন ও অন্যান্য লাঞ্ছনার ঘটনা ছিল ব্যাপক মাত্রায়। এসবের বেশির ভাগেরই কোনো বিচার হয়নি। 

হেফাজতে বন্দীদের নিয়মিত নির্যাতন করেছে পুলিশ। নির্যাতনের মধ্যে ছিল পেটানো, সিলিংয়ের সঙ্গে ঝুলিয়ে নির্যাতন, যৌনাঙ্গে বৈদ্যুতিক শক দেওয়া এবং কিছু ক্ষেত্রে আটক ব্যক্তিদের পায়ে গুলি করা। নির্যাতনের কারণে ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত পুলিশি হেফাজতে কমপক্ষে নয়জন নিহত হয়েছে। 

কর্মীদের অধিকার
কারখানা ও অন্যান্য কর্মস্থলে নিরাপত্তার মান ছিল খুবই খারাপ। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারে রানা প্লাজা ধসে কমপক্ষে এক হাজার ১৩০ জন পোশাককর্মী নিহত হন। আহত হন দুই হাজারের বেশি লোক। পরবর্তী সময়ে জানা যায়, ওই ভবনটিতে ফাটল দেখা দেওয়ার পরও ব্যবস্থাপক শ্রমিকদের কাজ করতে বলেছিলেন। একই ধরনের ঘটনা ঘটেছিল ২০১২ সালে। ওই সময় তাজরীন ফ্যাশনস নামে একটি কারখানায় আগুনে ১১২ জন শ্রমিক নিহত হয়েছিলেন। সে সময়ও আগুনের অ্যালার্ম শুনে শ্রমিকরা বের হতে চেয়েছিল। কিন্তু তখনো কারখানার ব্যবস্থাপকরা বলেছিলেন, আগুনের সতর্কবার্তা ভুয়া।

কর্মস্থলে দুর্ঘটনার শিকার ব্যক্তিদের সহায়তায় সরকার, বিশ্বের বিভিন্ন ব্র্যান্ড ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) প্রদেয় অর্থ খুব কম। দুর্ঘটনার শিকার হওয়ার পর জীবিত ব্যক্তিরা নিজ জীবন ও সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন।

মৃত্যুদণ্ড
আদালত ক্রমাগত মৃত্যুদণ্ড দিচ্ছেন। এ পর্যন্ত ১১ জনকে দণ্ড দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ট্রাইব্যুনালে দণ্ডপ্রাপ্ত একজনের সাজার বিরুদ্ধে সরকারের আপিলের পর মৃত্যুদণ্ডের নির্দেশ দেন সুপ্রিম কোর্ট। দণ্ডপ্রাপ্ত ওই ব্যক্তিকে ২০১৩ সালের ডিসেম্বর ফাঁসি দেওয়া হয়। মৃত্যুদণ্ড পাওয়ার পর আপিল করা কারাবন্দীরাও ফাঁসিতে ঝোলার হুমকিতে আছেন।