প্রমাণ পেয়েছে মার্কিন গোয়েন্দা বিভাগ

চীনের সহায়তায় পরমাণু অস্ত্র বানাচ্ছে সৌদি আরব!

Looks like you've blocked notifications!

সৌদি আরবের ক্ষেপণাস্ত্র মজুদ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। আর এর পেছনে চীনের হাত আছে, এমন প্রমাণ পেয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন গণমাধ্যম সিএনএনে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সৌদি আরবের ক্ষেপণাস্ত্র প্রকল্পে (ব্যালিস্টিক মিসাইল প্রোগ্রাম) সরাসরি সাহায্য করছে চীন, এমন প্রমাণ পাওয়ার দাবি মার্কিন গোয়েন্দা বিভাগের। বিষয়টি সত্যি হলে মধ্যপ্রাচ্যে মিসাইল নিয়ন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্রের তিন দশকের কৌশল হুমকির মুখে পড়বে।

মার্কিন গোয়েন্দা প্রতিবেদন অনুযায়ী ক্ষেপণাস্ত্র মজুদ বাড়াতে সম্প্রতি চীনের কাছ থেকে ক্ষেপণাস্ত্র নির্মাণকেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও প্রযুক্তি কিনেছে সৌদি আরব। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ এই খররটি মার্কিন কংগ্রেসের শীর্ষ সদস্যদের কাছে চেপে যাওয়ায় ট্রাম্প প্রশাসনের ওপর ক্ষুব্ধ ডেমোক্র্যাট সিনেটররা।

কংগ্রেসের কাছে বিষয়টি গোপন রাখায়, মধ্যপ্রাচ্যে পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ বিষয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের কতটা সদিচ্ছা আছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে কংগ্রেস সিনেটরদের মধ্যে। অনেক সিনেটর মনে করছেন সৌদি আরবের এমন পদক্ষেপের পেছনে ট্রাম্প প্রশাসনের নীরব অনুমোদনও আছে। কারণ ইরানকে ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র এ কৌশল নিয়ে থাকতে পারে। এ জন্য মার্কিন কংগ্রেসের বিরোধিতা সত্ত্বেও সম্প্রতি ট্রাম্প প্রশাসন সৌদি আরবের কাছে শত শত কোটি ডলার মূল্যের অস্ত্র বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নেয়।

এদিকে চিরশত্রু  ইরানকে রুখতে মরিয়া সৌদি আরবও। গত বছর মার্কিন টিভি চ্যানেল সিবিএসের এক অনুষ্ঠানে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান বলেছিলেন, ‘ইরান যদি পরমাণু বোমা বানায়, আমরাও বানাব।’

যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি অস্ত্র কেনে সৌদি আরব। তবে, ১৯৮৭ সালে স্বাক্ষরিত একটি অনানুষ্ঠানিক বহুজাতিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রণ চুক্তির কারণে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র কিনতে পারে না সৌদি আরব। কিন্তু সৌদি আরব বরাবরই বলে আসছে, শত্রু দেশ ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতার সমকক্ষ হতে তাদেরও পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রয়োজন। তাই ১৯৮৭ সালের চুক্তিতে যেসব দেশ স্বাক্ষর করেনি, চীনসহ সেসব দেশ থেকে নানা সময়ে সহায়তা নিয়েছে সৌদি আরব।

সৌদি আরবকে জঙ্গি বিমান সরবরাহ করে মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি আধিপত্য বজায় রাখতে সাহায্য করে আসছিল যুক্তরাষ্ট্র। যে কারণে মার্কিন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করতেন আমেরিকার কাছ থেকে যুদ্ধ বিমান পেয়েই নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে সন্তুষ্ট আছে সৌদি আরব। তাই পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র কেনার বিষয়ে মাথা ঘামাবে না তারা। কিন্তু, গত কয়েক মাসের কিছু ঘটনায় বিশ্লেষকদের এই যুক্তি আর খাটছে না। যেমন, ইরানের সঙ্গে ট্রাম্প প্রশাসন পারমাণবিক চুক্তি বাতিল করা এবং ইয়েমেন থেকে সৌদি আরবের ওপর ক্ষেপণাস্ত্র হামলা। 

গত জানুয়ারি মাসে দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট জানিয়েছিল, নিজের দেশে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র বানাতে যাচ্ছে সৌদি আরব। প্রতিবেদনে বলা হয়, স্যাটেলাইট থেকে তোলা ছবি বিশ্লেষণ করে সামরিক বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ক্ষেপণাস্ত্র নির্মাণকেন্দ্র তৈরি করে ফেলেছে দেশটি। আর এই নির্মাণকেন্দ্রে ব্যবহৃত হয়েছে চীনা প্রযুক্তি। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদ থেকে ১৪৫ মাইল দূরের আল-ওয়াতাহতে তৈরি করা হয়েছে ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি। সৌদি আরব কিংবা মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করেনি। তবে, চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছিল, সৌদি আরবের সঙ্গে চীনের অস্ত্র বাণিজ্য আছে।

সিএনএনে আজ বৃহস্পতিবার প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সৌদি আরবের পারমাণবিক অস্ত্র মজুদ ও সক্ষমতা বিষয়ে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর দেওয়া তথ্য হাতে পেয়েও এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেয়নি ট্রাম্প প্রশাসন। দুজন সাবেক মার্কিন গোয়েন্দা কর্মকর্তার বরাত দিয়ে সিএনএন জানায়, সারা বিশ্বের ক্ষেপণাস্ত্রবিষয়ক হালনাগাদ তথ্য সবসময় পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা করে মার্কিন গোয়েন্দ সংস্থাগুলো। এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোনো পরিবর্তন দেখা গেলে প্রেসিডেন্টের প্রতিদিনের ব্রিফিংয়ে তা জানানো হয়। 

সৌদি আরব বিষয়ক গোয়েন্দা তথ্য জানার অনুমতি আছে সিনেট গোয়েন্দা কমিটি। তবে, ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে চীন ও সৌদি আরবের বাড়ন্ত সুসম্পর্ক বিষয়ে জানতো না ওই কমিটি।

এ বছর মধ্যপ্রাচ্যে এক সফরের সময় বিদেশি একজন কূটনীতিকের কাছ থেকে বিষয়টি সম্পর্কে জানতে পারেন মার্কিন কংগ্রেসের বৈদেশিক সম্পর্কবিষয়ক কমিটির এক ডেমোক্র্যাট সিনেটর। যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে ওই সিনেটর বিষয়টি কমিটির অন্যতম সদস্য ডেমোক্র্যাট সিনেটর রবার্ট মেনেনডেজকে জানান। মেনেনডেজ তৎক্ষণাৎ আনুষ্ঠানিক সভা ডেকে কমিটির অন্য সদস্যদের বিষয়টি অবহিত করেন।

গত ৯ এপ্রিল ওই সভার আলোচনায় উঠে আসে সৌদি আরব বিষয়ে আরো বিস্তারিত তথ্য। এতে জানা যায়, ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশিত স্যাটেলাইট চিত্রে যতটা দেখা গেছে তার চেয়ে আরো অনেক দূর এগিয়ে গেছে সৌদি আরব। বিষয়টি মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের নিরস্ত্রীকরণ কৌশলের সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক।

এরপর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র বিভাগের নিয়মিত বাজেট অধিবেশনে উপস্থিত থাকা মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাবেক সিআইএ প্রধান মাইক পম্পেওকে চেপে ধরেন সিনেটররা। নির্বিষ বাজেট অধিবেশন চলে উত্তপ্ত তর্কযুদ্ধ। মার্কিন সিনেটরদের যুক্তরাষ্ট্র-সংক্রান্ত সব গোয়েন্দা তথ্য না জানানোয় পম্পেওর তীব্র সমালোচনা করেন মেনেনডেজ।  

ট্রাম্প প্রশাসনকে কটাক্ষ করে মেনেনডেজ বলেন, ‘এটা মেনে নেওয়া যায় না। কংগ্রেসকে তার সাংবিধানিক দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে হলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে আমাদের সবকিছু জানাতে হবে এবং আমরা কোনো কিছু জানতে চাইলে সেটা বলতে হবে।’

তবে এই তর্কযুদ্ধে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে, তা হলো—ইরানকে ঠেকানোই মধ্যপ্রাচ্যে ট্রাম্প প্রশাসনের মূল লক্ষ্য, নিরস্ত্রীকরণ বিষয়টি নয়। সভায় এক প্রশ্নের উত্তরে পম্পেও বলেন, ‘মার্কিন প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তাই চান, সৌদি আরবের কাছে পারমাণবিক অস্ত্র বিক্রির বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র তার এত দিনের অবস্থান থেকে সরে আসুক।’

তিনি আরো বলেন, ‘আপনারা তো দেখতেই পাচ্ছেন সৌদি আরবের কাছে আমরা ক্ষেপণাস্ত্র বিক্রি না করায় কতটা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। চীনের কাছ থেকে সৌদি আরব যে সহায়তা নিচ্ছে, সেটা যদি আমরাই দিতে পারতাম তাহলে ভালো হতো।’

সৌদি আরবের কাছে অন্য দেশের ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির প্রযুক্তি বিক্রি বন্ধ করতে যুক্তরাষ্ট্র কী পদক্ষেপ নিয়েছে, এমন প্রশ্নের জবাবে পম্পেও বলেন, ‘ইরানের পারমাণবিক হুমকির জবাবেই সৌদি আরব নিজেদের পারমাণবিক সক্ষমতা বাড়াচ্ছে। তবে, বিষয়টি আমাদের নজরে রাখতে হবে।’

এদিকে ট্রাম্প প্রশাসন বনাম কংগ্রেসের এই দ্বন্দ্বে চাপের মুখে পড়েছেন বৈদেশিক সম্পর্কবিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান রিপাবলিকান সিনেটর জিম রিশ। তিনি কংগ্রেসকে ট্রাম্প প্রশাসনের গোয়েন্দা তথ্য না জানানোর বিষয়ে সরাসরি বিপক্ষ অবস্থানে না গিয়ে মাঝামাঝি অবস্থান নিয়েছেন। একদিকে তিনি মার্কিন পররাষ্ট্র বিভাগের গোয়েন্দা তথ্য জানানো নিয়ে লুকোচুরি করায় ক্ষিপ্ত কমিটির অন্য সদস্যদের বোঝানোর চেষ্টা করছেন। অন্যদিকে ট্রাম্প প্রশাসনের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক পররাষ্ট্র কৌশলের ব্যাপারেও নীরব থাকছেন। রিশ বলেন, ‘সিনেটরদের কাছে গোয়েন্দা সংস্থার সব তথ্য মাঝেমধ্যে আসে না, তার কারণ এত বিপুল তথ্য সবসময় জানানো সম্ভব হয় না।’ কমিটির কোনো রিপাবলিকান সদস্যের এ নিয়ে অভিযোগ নেই জানিয়ে রিশ আরো বলেন, ‘ব্যাপারটি মোটেও ইচ্ছেকৃত নয়। এত তথ্য সবসময় জানানো সম্ভব হয় না বলেই বলা হয় না।’  

তবে কমিটি চেয়ারম্যানের ভাষ্য মানতে নারাজ মেনেনডেজ। তিনি বলেন, ‘এটা এমন একটা বিষয়, যেটা নিয়ে কী হচ্ছে তার খোঁজখবর সবসময়ই রাখতে হবে।’ সৌদি আরবের বিষয়টি নিয়ে ১০০ জন সিনেটরকেই অবহিত করার জন্য মার্কিন প্রশাসনকে চাপ দিয়ে যাচ্ছেন মেনেনডেজ।

মার্কিন প্রশাসনের পররাষ্ট্র বিষয়ক গোপন তথ্য সিনেটের বৈদেশিক সম্পর্কবিষয়ক কমিটিকে না জানানো নিয়ে মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে এই দ্বন্দ্ব নতুন নয়। তবে এবারের বিষয়টিতে কোনো ছাড় দিচ্ছে না কমিটি। ডেমোক্র্যাট সিনেটর টিম কাইন বলেন, ‘আমি তো মনে করি আমাদের গোয়েন্দা বিভাগ অনেক কিছুই জানে। তারা আমাদের কিছু জানাতে চায় না।’ কোনো নির্দিষ্ট বিষয় উল্লেখ না করে কাইন জানান, এসব না জানানো তথ্যের মধ্যে সৌদি আরবের কাছে পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র-নির্মাণ প্রযুক্তি বিক্রি করার বিষয়ে মার্কিন প্রশাসনের অবস্থান অন্যতম।

সিএনএনে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত মঙ্গলবার কাইন বলেছিলেন, গত বছর তুরস্কের ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেটে সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যাকাণ্ডের পর সৌদি আরবের কাছে অন্তত দুটি পারমাণবিক প্রযুক্তি বিক্রির ঘটনা ঘটেছে।

কংগ্রেসকে সৌদি-বিষয়ক গোয়েন্দা তথ্য না জানানো নিয়ে সিনেটরদের সঙ্গে ট্রাম্প প্রশাসনের তুমুল দ্বন্দ্ব চলছে। মার্কিন জনগণও জানতে পারছেন না, মধ্যপ্রাচ্যের মিত্র দেশটির বিষয়ে আমেরিকার অবস্থান এখন কী।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ডেমোক্র্যাট সিনেটর বলেন, ‘প্রশাসনের অবস্থানটা এ রকম যে—আপনাদের কিছু জানার প্রয়োজন নেই। অথচ বিষয়টি সাংবিধানিকভাবে একদম ঠিক নয়।’