৯/১১ হামলা

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশোধে নিহত ১২ লাখ, আইনি প্রক্রিয়ার অগ্রগতি কতটুকু?

Looks like you've blocked notifications!
২০০১ সালের আজকের দিনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে বিমান হামলা চালানো হয়। ছবি : সংগৃহীত

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমস্ত গোয়েন্দা নজরদারি ফাঁকি দিয়ে কীভাবে ৯/১১-এর বিমান হামলার ঘটনা ঘটেছিল, এমন প্রশ্নের উত্তর আজও খোঁজেন অনেকে। বিশ্বের মহাশক্তিধর দেশ যুক্তরাষ্ট্রের অহংকার চ্যালেঞ্জ করা এ সন্ত্রাসী হামলায় দুই হাজার ৯৮৩ জনের মৃত্যুর ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশিও রয়েছেন।

হামলার প্রতিশোধে যুক্তরাষ্ট্রের শুরু করা যুদ্ধে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে ১২ লাখ মানুষ নিহত হয়। সে তুলনায় এ হামলার ঘটনায় আইনি প্রক্রিয়ায় অগ্রগতি সামান্যই। বিভিন্ন সময়ে প্রশ্ন উঠেছে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কার্যক্রম নিয়েও।

হামলার হুঁশিয়ারি ছিল

এ ধরনের হামলা হতে পারে, সে ব্যাপারে আগে থেকেই হুঁশিয়ারি ছিল। যে মানুষগুলো সেই হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন তাঁদের একজন ছিলেন তৎকালীন ডেমোক্র্যাট সিনেটর গ্যারি হার্ট।

নাইন-ইলেভেন হামলার মাত্র আট মাস আগে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা ঝুঁকির ওপর একটি তদন্ত প্রতিবেদন চূড়ান্ত করা হয়। দীর্ঘ আড়াই বছর ধরে ব্যাপক তদন্তের পর প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়।

যে সরকারি কমিশন ওই তদন্ত করেছিল, তার যৌথ নেতৃত্বে ছিলেন সিনেটর গ্যারি হার্ট ও রিপাবলিকান দলের ওয়ারেন রাডম্যান।

ওই কমিশন ২০টি দেশের প্রায় ১০০ মানুষের কাছ থেকে সাক্ষ্য-প্রমাণ জোগাড় করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্রে জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে এত বড় তদন্ত-পর্যালোচনা কখনো হয়নি।

ওই কমিশনে যুক্ত ছিলেন পররাষ্ট্রনীতি ও প্রতিরক্ষা বিষয় যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে খ্যাতিমান বিশেষজ্ঞরা। যে উপসংহার তাঁরা টেনেছিলেন তা ছিল খুবই ভীতিকর।

গ্যারি হার্ট বলেন, ‘কমিশনের ১১ জন সদস্য তাঁদের তদন্তের বিশ্লেষণ করে মতামত দিয়েছিলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র বিপদের মুখে রয়েছে। আমরা ওই প্রতিবেদনে বলেছিলাম— এমন ঝুঁকি রয়েছে যার পরিণতিতে বিপুল সংখ্যক মার্কিন নাগরিক মারা যেতে পারেন।’

হুঁশিয়ারিকে মার্কিন সরকার কতটা গুরুত্ব দিয়েছিল?

গ্যারি হার্ট বলেন, ‘এমনকি সংবাদ মাধ্যমও ওই তদন্ত প্রতিবেদনকে গুরুত্ব দেয়নি। প্রতিবেদনটি চূড়ান্ত করার পর আমরা সংবাদ সম্মেলন করেছিলাম। আমাদের সংক্ষিপ্ত বক্তব্যের মাঝেই একজন সাংবাদিক চলে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ান। তাঁকে প্রশ্ন করি, কেন তিনি আগেভাগে চলে যাচ্ছেন। নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার ওই জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক উত্তর দেন, ‘এসব কিছুই ঘটবে না’।’

‘সুতরাং বলতে পারেন, গণমাধ্যম আমাদের ওই প্রতিবেদনকে তখন পাত্তাই দেয়নি,’ যোগ করেন গ্যারি হার্ট।

ওই কমিশন গঠন করেছিলেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন। কিন্তু ২০০১ সালের জানুয়ারিতে যখন ওই কমিশন তাদের চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে তখন হোয়াইট হাউজে নতুন সরকার। মাত্র ১১দিন আগে রিপাবলিকান জর্জ ডব্লিউ বুশ যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন। কমিশন সিদ্ধান্তই নিয়েছিল যে, নতুন প্রেসিডেন্ট যিনি হবেন, তাঁর হাতে তাঁরা তাঁদের প্রতিবেদন ও সুপারিশ তুলে দেবেন। কিন্তু তা আর হয়নি।

২০০৩ সালের ১ মার্চ পাকিস্তান থেকে আটক করা হয় খালিদ মুহাম্মদ শেখকে। পরে গুয়ান্তানামো বে কারাগারে বন্দি থাকা অবস্থায়  নিজেকে ৯/১১ হামলার ‘মাস্টারমাইন্ড’ হিসেবে স্বীকার করেন তিনি। ছবি : সংগৃহীত

সিনেটর গ্যারি হার্ট বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট বুশ আমাদের সঙ্গে দেখা করতেই রাজি হলেন না। আমরা ভাইস-প্রেসিডেন্ট রিচার্ড চেনির সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করলাম। তাতেও ব্যর্থ হই।’

তবে কমিশেঁর সদস্যরা নতুন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ডোনাল্ড রামসফেল্ড এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী কলিন পাওয়েলের সঙ্গে দেখা করেন। একইসঙ্গে তাঁরা প্রেসিডেন্ট বুশের জাতীঁ নিরাপত্তা উপদেষ্টা কনডোলিৎসা রাইসের সঙ্গেও দেখা করেন।

হামলার নেপথ্যে কারা?

ভয়াবহ এ হামলার দায় যাদের ওপর বর্তায়, তাদের ধর্মীয় পরিচয় বড় হয়ে ওঠে তদন্ত শেষে। আল-কায়েদার মতো জঙ্গি সংগঠনকে এ হামলার জন্য প্রধান দোষী করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের সন্দেহ, আফগানিস্তানের তোরা বোরা পাহাড় থেকে আল কায়েদা প্রধান ওসামা বিন লাদেনের নির্দেশে এ হামলা পরিচালিত হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশোধ যুদ্ধ!

পাল্টা জবাব দিতে যুক্তরাষ্ট্র তার সামরিকশক্তি নিয়ে মাঠে নামে। আফগানিস্তান থেকে তালেবান সরকারকে উৎখাত করা হয়। ইরাক-আফগানিস্তানের সরকার উৎখাত করার পর দেশ দুটির কর্তৃত্ব পরোক্ষভাবে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে চলে যায়।

পর্যায়ক্রমে ইরাকি নেতা সাদ্দাম হোসেন, আল-কায়েদার প্রধান ওসামা বিন লাদেন, লিবিয়ার নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফিসহ আরো কয়েকজন শীর্ষ নেতাকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয় ৯/১১-এর জেরে শুরু হওয়া মার্কিন প্রতিশোধমূলক অভিযানে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশোধ যুদ্ধে আফগানিস্তানে প্রায় ৮ লাখ ৭৫ হাজার এবং পাকিস্তানে প্রায় ৩ লাখ ২৫ হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন। লিবিয়ায় বেসামরিক নাগরিক ও সৈন্যসহ ৭৭ হাজার মানুষের প্রাণ গেছে। ‘ব্লাড অন আওয়ার হ্যান্ডস : দ্য আমেরিকান ইনভেশন অ্যান্ড ডেস্ট্রাকশন অব ইরাক’ এবং ‘ওবামা অ্যাট ওয়ার’ বইয়ের লেখক ও গবেষক নিকোলাস জে. এস. ডেভিস বিভিন্ন গবেষণার বরাত দিয়ে এসব তথ্য জানিয়েছেন।

অন্যদিকে হামলার মূল হোতা হিসেবে আল কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনকে সন্দেহ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ২০১১ সালে পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবোদের অ্যাবোটাবাদে মার্কিন সেনাদের অভিযানে নিহত হন ওসামা বিন লাদেন।

বিচারের কত দেরি?

টুইন টাওয়ারে হামলার প্রতিশোধে শুরু হওয়া যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে ১২ লাখ মানুষ নিহত হলেও এ হামলার ঘটনায় আইনি প্রক্রিয়ায় কাউকেই দণ্ড দিতে পারেনি মার্কিন কর্তৃপক্ষ। আরো দুই বছর পরে ২০২১ সালের শুরুতে হামলার ‘মাস্টারমাইন্ড’খ্যাত খালিদ মুহাম্মদ শেখের বিরুদ্ধের মামলার রায়ের দিন ধার্য করা হয়েছে। ৯/১১ কমিশনের প্রতিবেদনে তাঁকে এ হামলার বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকা শীর্ষ ব্যক্তি হিসেবে উল্লেখ করা হয়। দীর্ঘ ২০ বছর অপেক্ষার পর ২০২১ সালের ১১ জানুয়ারি কিউবার গুয়ানতানামো বের একটি সামরিক আদালত খালিদ শেখ মুহাম্মদ, রামজি বিন আল সিবাহ, মুস্তাফা আহমেদ আল হাওয়াওয়ী, আলী আবদ আল আজিজ আলী ও ওয়ালিদ বিন আত্তার নামে করা মামলার রায়ের দিন ধার্য করে।

এর আগে এ ঘটনায় জাকারিয়া মুসাভি নামের এক ফরাসি যুবকের বিরুদ্ধে বিমান ছিনতাইয়ের ষড়যন্ত্রসহ এমন ছয়টি মামলা দেওয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা বাহিনীগুলো তাঁর বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ জোগাড় করতে না পারলেও তিনি হামলায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন বলে তাঁকে যাবজ্জীবন দেওয়া হয়। বর্তমানে তিনি কলোরাডোর জেলে সাজা খাটছেন।

জাকারিয়া মুসাভির বিরুদ্ধে ছয় অভিযোগনামার পরিপ্রেক্ষিতে সিআইএসহ যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তথ্যপ্রমাণ হাজিরের ধরন নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন কলোরাডোর আদালত। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কোনো অডিও বা ভিডিও হাজির করতে না পারায় ক্ষুব্ধ হন আদালত।

জার্মানিতে আটক হওয়ার পর দোষী সাব্যস্ত হওয়া মুনির আল মোতাসাদ্দেককে ১৫ বছর কারাদণ্ড ভোগের পর ২০১৮ সালে মরক্কোয় পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

স্মরণ…

নিউইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের ধসে পড়া সে জায়গা— গ্রাউন্ড জিরোতে এখন গড়ে উঠেছে ওয়ান ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার (ওডব্লিউটিসি)। দালানের উচ্চতার দিক থেকে টুইন টাওয়ারকে ছাড়িয়ে যাওয়া ওডব্লিউটিসিতে নির্মিত হয়েছে সেপ্টেম্বর ১১ জাদুঘর। যার স্থপতি ডেভিড চিল্ডস। বেদনা ও বিস্ময়ের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিশ্বের মানুষ এ দিনটিকে স্মরণ করে প্রতিবছর। ঘটনার বছরই ডিসেম্বরে ১১ সেপ্টেম্বর দিনটিকে দেশপ্রেমিক দিবস হিসেবে ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্র সরকার। এরপর থেকে প্রতি বছর নানা আয়োজনে দিনটি পালিত হয়।