রক্তাক্ত দিন বাংলাদেশে নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে
বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান হুমকির মুখে পড়া মুক্তমত ও সহিংসতার ওপর এবার যুক্তরাষ্ট্রে আয়োজিত এক ব্রিফিংয়ে কথা বলেছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন ব্লগার রাফিদা আহমেদ বন্যা। স্থানীয় সময় মঙ্গলবার দেশটির কংগ্রেসের ভবন ক্যাপিটল হিলে এ ব্রিফিংয়ের আয়োজন করে টম ল্যানটস হিউম্যান রাইটস কমিশন।
টম ল্যানটস কমিশন মার্কিন কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি সভায় (হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভস) ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিক দল থেকে নির্বাচিত সদস্যদের নিয়ে গঠিত। এ কমিশন বিশ্বজুড়ে মানবাধিকার উন্নয়ন ও রক্ষার লক্ষ্যে কাজ করে।
এর আগে বন্যা জাতিসংঘসহ বিভিন্ন জায়গা ও সংগঠনে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেন।
গত ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকার বইমেলা থেকে বের হওয়ার পথে ইসলামপন্থী জঙ্গিদের হাতে বন্যার স্বামী লেখক-ব্লগার অভিজিৎ রায় খুন হন।
ব্রিফিংয়ে বন্যা জানান, বাংলাদেশে গত নয় মাসে ধর্মনিরপক্ষে লেখালেখির কারণে পাঁচজন ব্লগার, লেখক এবং প্রকাশককে হত্যা করা হয়েছে। এ ছাড়া আহত হয়েছেন আরো কয়েকজন। এর মধ্যে প্রথম ঘটনার শিকার হন বন্যা ও তাঁর স্বামী, যিনি ছিলেন ধর্মীয় মৌলবাদের একজন সমালোচক।
টম ল্যানটস কমিশনের ব্রিফিংয়ে বন্যা আরো বলেন, ‘পরিস্থিতি ভয়াবহ। ওই রক্তাক্ত দিনটি এখন সাধারণ নিয়মে পরিণত হয়েছে এবং হত্যাকারীরা ইসলামপন্থী জঙ্গিদের কণ্ঠস্বরে পরিণত হচ্ছে। যেহেতু এই হত্যাকারীদের কোনোদিন বিচার হবে না, তাই তারা এখন বিদেশিদের ওপর হামলা চালাচ্ছে। এমনকি অন্য মতাদর্শের মুসলমানরাও এখন তাদের আক্রমণের শিকার হচ্ছেন।’
রাফিদা আহমেদ বন্যা বলেন, সুন্নি মুসলমান অধ্যুষিত বাংলাদেশে এই মুহূর্তে লেখকদের ওপর হামলা হচ্ছে, শিয়া মুসলমানদের ওপর সহিংসতা হচ্ছে এবং খ্রিস্টান ধর্ম যাজকদের হত্যার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। অথচ ধর্মনিরপেক্ষতা এবং ধর্মীয় সহিষ্ণুতার ঐতিহ্য ছিল দেশটির। সমালোচকরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার এসব হুমকি প্রতিহত করতে ব্যর্থ হয়েছে।
গত ফেব্রুয়ারি মাসে হামলায় বাঁ হাতের বুড়ো আঙুল হারানো বন্যা বলেন, ‘এই হামলার বিষয় প্রথমে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো কথা বলা হয়নি। পরে বলা হয় যে, ব্লগারদের ধর্ম নিয়ে লেখালেখির বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্লগারদের দেশত্যাগেও উৎসাহ দেওয়া হয়েছে।’ বন্যা জানান, এই হামলার পর থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে তাঁর সঙ্গে কেউ যোগাযোগ করেনি। তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশ সরকার এটা স্বীকার করতে চায় না যে, বাংলাদেশে ইসলামী জঙ্গিবাদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে।’ বাংলাদেশ সরকার ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে ঘাঁটাতে চায় না বলেও মন্তব্য করেন বন্যা।
নিউইয়র্কভিত্তিক লেখকদের সংগঠন পেন আমেরিকান স্টোরের কারিন ডাচেস বলেন, গত বছর বাংলাদেশের চরমপন্থী দলগুলো ৮৪ জন ব্লগারের তালিকা তৈরি করেছিল। সেই সঙ্গে দেশটির অনেক সাংবাদিক ও সুশীলসমাজের প্রতিনিধিদেরও লক্ষ্য করে। কিন্তু পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তালিকায় থাকা এসব ব্যক্তিদের নিরাপত্তার জন্য তেমন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। তাই বেঁচে থাকার তাগিদে বাংলাদেশের অনেক ব্লগারকে দেশ ছেড়ে পালাতে হচ্ছে বলে জানান কারিন।
বার্তা সংস্থা এপি জানায়, বাংলাদেশ সরকার এসব হামলার জন্য দেশের অভ্যন্তরীণ জঙ্গি দল এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলকে দায়ী করছে। বিশেষত প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপি ও তাদের মিত্র জামায়াতে ইসলামীকে এসব হামলার ও সহিংসতার জন্য দায়ী করা হচ্ছে।
ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাস মিশনের উপপ্রধান মাহবুব হাসান সালেহ অভিযোগ করে বলেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিরোধী দলগুলো সড়কে পেট্রলবোমা মেরে বহু মানুষকে হত্যা করেছে। যেটিকে তিনি সন্ত্রাসবাদ হিসেবে চিহ্ণিত করেছেন। তবে সরকার যে লেখকদের সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছে সে বিষয়ে সরাসরি কোনো উত্তর দেননি হাসান সালেহ।
ল্যানটস কমিশনের সহসভাপতি এবং ডেমোক্রেটিক দলের কংগ্রেস সদস্য জিম ম্যাকগভার্ন বলেন, বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রতিবেদন আসছে যে ইসলামিক স্টেট এবং আল-কায়েদা বর্তমানে বাংলাদেশে তাদের সন্ত্রাসী কার্যক্রমের বিস্তার ঘটাচ্ছে, যা বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা এবং গণতন্ত্রের জন্য চাপ তৈরি করছে, তিনি দেশটির জনগণের অধিকার রক্ষা করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।