মাকে কবর দেওয়ায় পরিবার গ্রামছাড়া

Looks like you've blocked notifications!
হিন্দু সনাতন সমাজ থেকে বিদেশ সরকার ও যুক্তিবাদী নকুল চন্দ্র সানাকে বহিষ্কারের পোস্টার। ছবি : এনটিভি অনলাইন

মায়ের শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী মৃত্যুর পর তাঁকে কবর দেওয়ার ‘অপরাধে’ গ্রাম ছাড়তে হলো এক হিন্দু পরিবারকে। গ্রামের মোড়লদের অভিযোগ, হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী পুরোহিত ডেকে পারলৌকিক ক্রিয়াকর্মের প্রচলিত নিয়ম না মানায় ওই পরিবারকে বয়কট করা হয়েছে। আর ভুক্তভোগী পরিবারের অভিযোগ, তাঁদেরকে নানা হয়রানি ছাড়াও সামাজিকভাবে বয়কটের জন্য পোস্টার টাঙানো হয়েছে এলাকায়।

ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার বসিরহাট মহকুমায় চাঞ্চল্যকর এই ঘটনা ঘটেছে। সরেজমিনে জানা যায়, বসিরহাটের স্বরূপনগর থানার হরিশপুর গ্রামে বসবাস করেন বিদেশ সরকার। গত ২৫ ডিসেম্বর বিদেশ সরকারের মায়ের মৃত্যু হয়। মায়ের মৃত্যুর পর  মায়ের শেষ ইচ্ছা পূরণ করতে  নিজের বাড়িতেই মায়ের কবর দেন বিদেশ। এতে সায় ছিল বিদেশের বাবারও।

এদিকে প্রচলিত পারলৌকিক কর্ম না করায় ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন গ্রামের মোড়ল এবং এক শ্রেণির গ্রামবাসী। বিদেশ সরকারের অভিযোগ, মায়ের মৃত্যুর পর হিন্দুধর্মের চিরাচরিত পুরোহিত প্রথা না মেনে মায়ের মৃতদেহ কবর দেওয়ার সময়ও বাধা দিতে এসেছিল একদল গ্রামবাসী। সে সময় তাঁরা হিন্দু শাস্ত্র মতে মায়ের পারলৌকিক কাজ করতে হুমকি দেন তাঁকে। কিন্তু মায়ের ইচ্ছে অনুযায়ী বাড়িতেই মায়ের কবর দেবেন বলে তাঁদের সাফ জানিয়ে দেন বিদেশ।

এরপরেই সামাজিকভাবে বিদেশ সরকারকে বয়কট করার হুমকি দেন তাঁরা। এমনকি ফোনে তাঁকে জীবন্ত কবর দেওয়ারও হুমকি দেওয়া হয়। এরপর ওই দিন রাতেই শুরু হয় তাঁর বাড়ি লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোঁড়া। এনটিভি অনলাইনের কাছে বিদেশ বলেন, ‘আমি সেই ইট-পাটকেলগুলো জমিয়ে বাড়ির সামনে রেখে দিয়েছি। ভয়ে এখন আমার ছেলেমেয়েরা কান্নাকাটি করছে। বাড়ির বাইরে বের হতে পারছে না তাঁরা। আর আমিও প্রাণভয়ে বাড়িছাড়া।’

এমনকি এই ঘটনায় গত ৮ জানুয়ারি বিকেলে স্বরূপনগর থানায় লিখিত অভিযোগ করতে গেলে পুলিশ কয়েক ঘণ্টা বসিয়ে রেখে তারপর লিখিত অভিযোগ জমা নেয় বলে অভিযোগ করেন বিদেশ সরকার। এ ছাড়া পুলিশ কয়েকবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করলেও কোনো কড়া পদক্ষেপ নেয়নি বলে জানান তিনি।

বিদেশ সরকার জানান, ‘হরিশপুর গ্রামের যুক্তিবাদী লেখক নকুল চন্দ্র সানার সহায়তায় পুরোহিত রীতি না মেনে আমরা মায়ের কবর দেই।’ ফলে বিদেশ সরকারের পাশাপাশি মোড়ল-মাতব্বরদের রোষানলের মুখে পড়েছেন নকুল চন্দ্র সানাও।

এই ঘটনায় প্রভাবশালী কিছু গ্রামবাসী মৌখিকভাবে বিদেশ সরকার ও যুক্তিবাদী নকুল চন্দ্র সানাকে হিন্দু সনাতন সমাজ থেকে বহিষ্কার করেছে। শুধু হুমকিই নয়, এ ব্যাপারে এলাকায় পোস্টারও টাঙানো দেওয়া হয়েছে। পোস্টারে লেখা আছে, বিদেশ সরকার ও যুক্তিবাদী নকুল চন্দ্র সানা এখন থেকে  সকল প্রকার প্রশাসনিক সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে। অন্যের সম্পত্তিতে যেতে পারবে না। গ্রামের কোনো বাসিন্দার সঙ্গে কোনো প্রকার সম্পর্ক রাখতে এবং করতে পারবে না। এমনকি বিদেশ সরকারের জমিতে গ্রামের কেউ চাষাবাদ করতে পারবে না।

বিদেশ সরকারের মেয়ে প্রতিমা সরকার বলেন, ‘ঠাকুরমার দেহ সমাধিস্থ করার পর থেকে বাড়িতে ইটপাটকেল ছোড়া হচ্ছে। এমনকি আমার বাবা বিদেশ সরকারকে জীবন্ত কবর দেওয়ার হুমকিও দেওয়া হয়েছে।’ এই অবস্থার মধ্যে দাঁড়িয়ে বিদেশ সরকার তাঁর মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী ছেলে এবং উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী মেয়েকে নিয়ে এক নিকট আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন।

এই অমানবিক ঘটনার বিষয়ে বসিরহাট মহকুমার প্রশাসক নীতেশ ঢালিকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি জানান, ‘সভ্য সমাজে এই ধরনের ঘটনাকে মোটেই মেনে নেওয়া যায় না। আমি অনতিবিলম্বে স্থানীয় প্রশাসনকে ওই সমস্ত হুমকি প্রদানকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেছি।’