পাকিস্তানে তরুণ-তরুণীদের দোটানা
নানান অঙ্গভঙ্গি করে নিজের মোবাইল ফোনে সেলফি তুলছে ১৫ বছরের এক কিশোরী। দেখে মনে হতে পারে, কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো তার এই পাউট করা ছবি নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে আপলোড করবে সে। কিন্তু পাকিস্তানের নাগরিক হওয়ায় সেই দেশের সামাজিক নিয়ম অনুযায়ী এই সেলফি তার পক্ষে ফেসবুকে আপলোড করা সম্ভব নয়!
২০১৪ সালেই পাকিস্তানে পৌঁছে গেছে থ্রিজি ও ফোরজি প্রযুক্তি। নতুন প্রজন্মের হাতে হাতে ঘুরছে স্মার্টফোন। সেসব ফোনে বিভিন্ন রকমের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করা হচ্ছে। এর ফলে প্রেম, ভালোবাসা, সম্পর্ক, যৌনতা এসব নিয়ে আগের চেয়ে অনেক বেশি খোলামেলা আলোচনা করছে পাকিস্তানের তরুণ প্রজন্ম।
কিন্তু এত সবের পরও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছবি পোস্ট করা নিয়ে পাকিস্তানের এক ধরনের সামাজিক নিষেধাজ্ঞার কারণে দোটানায় পড়ছে তরুণরা। ইন্টারনেট ব্যবহার, ছবি পোস্ট করা, সেলফি তোলা- এসব নিয়ে তাদের মধ্যে তৈরি হয়েছে এক ধরনের টানাপড়েন।
গভীর রক্ষণশীল মুসলিম দেশ হিসেবে পরিচিত পাকিস্তানে সন্তানদের আচার ব্যবহারের ওপর পরিবারের নিয়ন্ত্রণ অনেক বেশি। ডাক ফেস বা পাউট করে ছবি তোলা এখন বিশ্বজুড়ে সমাদৃত হলেও পাকিস্তানের সমাজ ব্যবস্থায় মা-বাবারা এই ধরনের আচরণকে সমর্থন করেন না।
এ বিষয়ে ইসলামাবাদের একটি স্কুলের শিক্ষার্থী এক কিশোরী বলে, ‘ছবি তোলার সময় আমার পক্ষে পাউট করা সম্ভব নয়। আমাকে এটা করতে নিষেধ করা হয়েছে। কারণ তা না হলে অন্যরা আমাকে খারাপ ভাববে। আপনি বাইরে কোথাও বন্ধুদের সাথে বেড়াতে গেলে সেই ছবিও ফেসবুকে পোস্ট করতে পারবেন না। কারণ তাহলে আপনার অন্য বন্ধু, আত্মীয়স্বজন বা শিক্ষকরা সমালোচনা করবে। এসব ছবি দেখে তারা বলবে যে, তোমাকে বেশ্যার মতো লাগছে, তুমি এভাবে হাসছ কেন?’
ওই কিশোরী আরো বলে, ‘এ জন্য আমি খুব কমই আমার প্রোফাইল ছবি বদল করি। আমি যখন প্রথম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করতে শুরু করি তখন ভেবেছিলাম, আমার অনেক অনলাইন বন্ধু হবে। কিন্তু এই মুহূর্তে আমার মাত্র পাঁচজন বন্ধু রয়েছে।’
এএফপিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে স্কুলটির বেশ কয়েকজন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ছাত্রছাত্রী ইন্টারনেট ব্যবহার বিষয়ে প্রায় একই রকম অভিজ্ঞতার কথা বলেছে।
১৪ বছর বয়সী এক ছাত্র বলে, ‘এ সবকিছুর পেছনের কারণ ধর্ম। আমরা একটি মুসলিম রাষ্ট্রে বাস করি। যেহেতু ইসলাম ধর্মে মেয়েদের পা বা হাত অন্য কাউকে দেখানোর নিয়ম নেই, তাই এখানে মানুষ আপনাকে এসব দেখালে অবশ্যই খারাপ বলবে। এ ছাড়া ইসলামে ছেলেমেয়েদের মধ্যে কথা বলাতেও নিষেধাজ্ঞা আছে।’ একবার এক মেয়েবন্ধুর সাথে তোলা একটি ছবি ফেসবুকে পোস্ট করার পর কেমন বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছিল তাও এএফপিকে জানায় সে।
বিশ্বজুড়েই নারীদের অনলাইনে নানা বিড়ম্বনার মুখোমুখি হতে হয়, কিন্তু পাকিস্তানের মেয়েদের তাদের চেয়ে অন্যরকম সমস্যা মোকাবিলা করতে হয়। তারা ফেসবুক বা অন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোনো ছবি পোস্ট করলে ধরে নেওয়া হয় যে এতে তার পরিবারের সম্মানহানি ঘটছে। এ ছাড়া ফেসবুকে নারী বিদ্বেষি মন্তব্য এবং নানা হয়রানি তো আছেই।
১৫ বছর বয়সী আরো এক কিশোরী জানায়, যখনই সে ফেসবুকে কোনো ছবি পোস্ট করে তখনই কোনো কোনো বখাটে ছেলে তাকে বিভিন্ন রকমের বাজে ছবি পাঠায়। যা দেখে অনেকটা অসহায় বোধ করতে থাকে সে।
কিশোরীর এক সহপাঠী কিশোর সহমত প্রকাশ করে বলে, ‘আমি সেলফি পছন্দ করি না। কারণ এতে বখাটে ছেলেরা আকৃষ্ট হয়।’
একই স্কুলের ১৩ বছর বয়সী আরেক কিশোর মনে করে, সাইবারজগৎ সমাজের সব নিয়ম ভেঙে ফেলতে বা ওলটপালট করে দিতে পারে। সেই সময় এক কিশোরী বলে, সে মনে করে অনলাইনের মাধ্যমে নিজের মতামত প্রকাশের একেবারে ভিন্ন বা অনন্য একটি প্ল্যাটফর্ম পাওয়া যায়। তার মতে, ‘এটা আমাদের জন্য উপকারী। স্কুলে সবসময় নিজের মনে কথা বলা যায় না। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মনে যা আসে তাই প্রকাশ করা যায়। আমি নিজে আসলে কী সেটাও বোঝা যায়।’