ধর্ষণ, নির্যাতন, যুদ্ধ ও মৃত্যু দেখেছেন নারী শরণার্থী

Looks like you've blocked notifications!

মাত্র ১৬ বছর বয়সে নিজ দেশ আফ্রিকার গাম্বিয়া ছেড়ে ইউরোপের পথে পা বাড়িয়েছিলেন মামাদু ইয়োলো। গাম্বিয়ায় ধর্ষণ, নির্যাতন, কারাভোগ করা মামাদু সাগর পাড়ি দিতে নৌকায় ওঠার আগেই কবর দিয়েছেন বন্ধুদের। মামাদু ইউরোপের পথে ঘটে যাওয়া লোমহর্ষক অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমকে।

গাম্বিয়ায় থাকা অবস্থায় কিশোরী মামাদু ইয়োলো একদিন স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে সেখানে সেনা ও পুলিশ দেখেন। জানতে পারেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া জামেহকে ক্ষমতাচ্যুত করার অভ্যুত্থানে যুক্ত থাকার অভিযোগে তাঁর বাবা ও ভাইকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মামাদুকে জানানো হয়, সেনারা তাঁকেও খুঁজছে। তাঁকে ধরতে পারলে হত্যা করা হবে।

বাড়ি ছেড়ে পালান মামাদু ইয়োলো। তবে নিরাপদ আশ্রয়ের পরিবর্তে মামাদুর জীবনে নেমে আসে দেড় বছরের দুঃস্বপ্ন। ধর্ষণ, নির্যাতন, কারাভোগ করতে হয় মামাদুকে। এ ছাড়া যুদ্ধ ও কাছের মানুষের মৃত্যুও দেখেছেন তিনি।

ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে ছোট ডিঙি নৌকায় ওঠার আগে কিশোরী মামাদু দেখেছেন পিটুনির শিকার হয়ে তিন বন্ধুর মৃত্যু। আরো দেখেছেন ধর্ষণ ও নির্যাতনের শিকার ক্ষুধার্ত নারী ও শিশুদের দাস হিসেবে বিক্রি হতে।

বর্তমানে ১৯ বছর বয়সী মামাদু ইয়োলো সম্প্রতি বেলজিয়ামের শহর ব্রাসেলসে দি ইনডিপেনডেন্টের সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় তিনি জানান, গাম্বিয়ায় ২২ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা একনায়কের বিরুদ্ধে ২০১৪ সালের অভ্যুত্থানে তাঁর বাবার ভূমিকার কথা।

মামাদু বলেন, ‘বাড়ির সবাইকে গ্রেপ্তার করতে গিয়েছিল সেনা ও পুলিশ। ওই সময় আমি স্কুলে ছিলাম। তখন কিছু করার উপায় না থাকায় বাধ্য হয়ে সেনেগালে চলে যাই। জানতাম ফিরে গেলে আমাকে হত্যা করা হবে ‌এবং বিষয়টি হবে সবার কাছে গুরুত্বহীন।’

কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে উত্তর আফ্রিকা থেকে মালি হয়ে ইউরোপের পথে পাড়ি জমান মামাদু। কল্পনাতেও ছিল না এই পথে কতটা বিপদের মুখে তাঁকে পড়তে হবে। পাচারকারীরা তাঁদের এমন অঞ্চল পাড়ি দেয়, যেখানে মালি সরকার এবং সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আল-কায়েদার সঙ্গে সম্পৃক্ত গোষ্ঠীগুলো নিয়ন্ত্রণ নিতে যুদ্ধ করছে।

মালির গাওতে জঙ্গিরা মামাদুদের বহনকারী লরি থামায়। লরিতে থাকা প্রায় ১০০ শরণার্থীকে ধরে নিয়ে যায় তারা।

মামাদু বলেন, জঙ্গিরা নারী ও শিশুসহ সব শরণার্থীকে তাদের সঙ্গে যোগ দিতে চাপ দেয়। অস্বীকৃতি জানালেই পিটুনির শিকার হতে হতো। শরণার্থীদের সঙ্গে থাকা অর্থ, পানিসহ সব কিছুই ছিনিয়ে নেয় জঙ্গিরা। সবার সামনেই নারীদের ধর্ষণ করত তারা।

কৌশলে জঙ্গিদের হাত থেকে পালান মামাদু ও তাঁর কয়েক বন্ধু। পরে লরিতে করে তাঁরা আলজেরিয়া পালিয়ে যান।

মামাদু ও তাঁর বন্ধুদের আশ্রয় হয় আলজেরিয়ার আশ্রয় শিবিরে। ইউরোপ পাড়ি দেওয়ার অর্থ জোগাড় করতে কঠোর পরিশ্রমে নামেন তাঁরা। তবে ২০১৫ সালের ২৩ নভেম্বর আশ্রয়শিবিরে আগুন লাগে। ওই ঘটনায় ১৮ জন নিহত হয়। আলজেরিয়া সরকার মামাদুর মতো কোনো বৈধ কাগজ না থাকা শরণার্থীদের দেশ থেকে বের করে দেয়।

এবার মামাদু ইয়োলো পাড়ি দেন গৃহযুদ্ধকবলিত লিবিয়া। সেনাদের পোশাকে এক আরব ব্যক্তি মামাদু ও তাঁর বন্ধুদের সহায়তা করার কথা বলেন। তিনি ও অপর ছয় শরণার্থীকে নিয়ে একটি কমপাউন্ডে হাজির হন ওই আরব। মামাদুসহ ছয় শরণার্থীকে দাস হিসেবে বিক্রি করে দেন তিনি।

খামারের প্রচণ্ড শ্রমে মামাদু ও তাঁর তিন বন্ধু অসুস্থ হয়ে পড়েন। এ সময় কমপাউন্ডের ওই ব্যক্তি তাঁদের বলেন, যেহেতু সে তাঁদের অর্থ দিয়ে কিনেছে তাই হত্যাও করতে পারে। পরে মামাদুর তিন বন্ধুকে মাথায় আঘাত করে হত্যা করা হয়। খামারেই বন্ধুদের কবর দেন মামাদু।

অপর তিন শরণার্থীর সঙ্গে নিয়ে একদিন কমপাউন্ড ছেড়ে পালান মামাদু। আফ্রিকা ছেড়ে পালিয়ে লিবিয়া আসা অন্য শরণার্থীদের কাছে খাবার মিললেও পরে আসমা বয়েজ নামক সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রে খপ্পরে পড়েন মামাদুরা। এই সংঘবদ্ধ অপরাধীচক্র মুক্তিপণের জন্য তাঁদের বন্দি করে। তবে মুক্তিপণ দেওয়ার কেউ না থাকায় প্রতিনিয়ত নির্যাতনের শিকার হতো মামাদুর মতো শরণার্থীরা। এমন বন্দিদের কঠোর পরিশ্রমে বাধ্য করে আসমা বয়েজ। পরে অপর একটি সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রের হাতে মামাদুদের হস্তান্তর করে তারা।

দুঃস্বপ্নের মতো কয়েক মাস কাটে মামাদুদের। পরে এক পাচারকারীর সহায়তায় ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার এক নৌকায় ওঠেন মামাদু।

ভূমধ্যসাগরে স্পেনের একটি জাহাজ মামাদুদের নৌকা থেকে উদ্ধার করে। পরে ইতালির একটি মানবাধিকার সংগঠনের কাছে শারীরিক ও মানসিক চিকিৎসা পান মামাদু ইয়োলো।