তিউনিসিয়া-লিবিয়া সীমান্তের মরুভূমিতে অভিবাসনপ্রত্যাশীরা
লিবিয়া ও তিউনিসিয়ার সীমান্তের মরুভূমি। তীব্র গরমে এই মরুভূমিতে পড়ে গেল এক আফ্রিকান অভিবাসনপ্রত্যাশী। ঠিক সে সময়ে লিবিয়ার একটি টহল দল সেখানে পৌঁছায়। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল ওই আফ্রিকানের। টহল দলের লোকেরা ওই লোককে বাঁচাতে তার মুখে কয়েক ফোঁটা পানি ছিটিয়ে দেয়।
মরুভূমিতে অসুস্থ হওয়া এই আফ্রিকান হলো সেই শত শত লোকের মধ্যে একজন অভিবাসনপ্রত্যাশী যাদের কিনা জোর করে লিবিয়ায় পাঠাচ্ছে তিউনিসিয়ার নিরাপত্তা বাহিনী। এসব তথ্য জানিয়েছে লিবিয়ার সীমান্তরক্ষী বাহিনী ও অভিবাসনপ্রত্যাশীরা।
যখন এসব অভিবাসনপ্রত্যাশীরা লিবিয়ার সীমান্তে পৌঁছায় তখন সাব-সাহারান অঞ্চলটির তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়েছে। গতকাল রোববার লিবিয়া-তিউনিসিয়া সীমান্তে অবস্থিত আবাসযোগ্য নয় এলাকা সেবখাত আল-মাগতা থেকে প্রায় ১০০ অভিবাসনপ্রত্যাশীকে লিবিয়ার সীমান্তরক্ষী বাহিনী উদ্ধার করে যা সামনাসামনি দেখে এএফপি।
তীব্র গরমে লিবিয়ার সীমান্তে দিকে আসতে দেখা যায় ছয়জনকে। তারা কথা বলছিল আরব ভাষায় এবং তারা তিউনিসিয়া থেকে এসেছে বলে জানায়।
লিবিয়ার সীমান্তরক্ষী বাহিনী এএফপিকে জানিয়েছে, সর্বশেষ দুই সপ্তাহে শতাধিক অভিবাসনপ্রত্যাশীকে উদ্ধার করেছে তারা। তিউনিসিয়া কর্তৃপক্ষ ত্রিপলি থেকে ১৫০ কিলোমিটার পশ্চিমের সীমান্ত এলাকা আল-আসহার পার্শ্ববর্তী এলাকাতে এসব অভিবাসনপ্রত্যাশীকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
চলতি মাসের শুরুতে সাব-সাহারান অঞ্চলের দেশগুলোর কয়েকশ অভিবাসনপ্রত্যাশী তিউনিসিয়ার বন্দর শহর স্ফ্যাক্সে জড়ো হয়। তাদের উদ্দেশে ছিল ইউরোপে পাড়ি দেওয়া। তবে, স্থানীয় ও অভিবাসনপ্রত্যাশীদের মধ্যে সংঘর্ষে একজন তিউনিসিয়ার নাগরিকের মৃত্যুর পর ওই এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পরে। এরপরেই অভিবাসনপ্রত্যাশীদের লিবিয়া সীমান্তের দিকে পাঠাচ্ছে তিউনিসিয়া কর্তৃপক্ষ।
নাইজার ও আলজেরিয়া পাড়ি দিয়ে তিউনিসিয়া পৌঁছেছিল সুদানের নাগরিক হাইথাম ইয়াহিয়া। বছর খানেক সময় ধরে তিউনিসিয়ায় নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন তিনি। আল-আসাহ এলাকায় থাকা এই সুদানি বলেন, ‘আমি সেখানে কাজ করতাম। তারা আমাকে ধরে এখানে নিয়ে আসে। প্রথমে একটি পুলিশ কারে ও পরে একটি ট্রাকে করে তারা আমাকে এখানে এনেছে এবং আমাকে লিবিয়ায় চলে যেতে বলেছে।’
স্ফ্যাক্স শহরটি ইউরোপের খুবই কাছেই অবস্থিত। এই বন্দর শহরটি ইতালির দ্বীপ ল্যাম্পেদুসা থেকে মাত্র ১৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ভালো জীবনের আশায় ইউরোপের অতি কাছের এই শহর থেকে অনেক অভিবাসনপ্রত্যাশী ইউরোপে পাড়ি জমায়। স্ফ্যাক্স থেকে সমুদ্র পথে অভিবাসনপ্রত্যাশীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় তা কমাতে উত্তর আফ্রিকার দেশটিকে আর্থিক সহায়তা করার কথাও জানিয়েছে ইউরোপ।
হিউম্যান রাউটস ওয়াচ জানিয়েছে, চলতি মাসে জোর করে এক হাজার ২০০ কৃষ্ণাঙ্গকে লিবিয়া ও আলজেরিয়ার সীমান্তবর্তী মরুভূমি এলাকায় পাঠিয়েছে তিউনিসিয়ার নিরাপত্তা বাহিনী। জুলাইয়ের মাঝামাঝিতে তিউনিসিয়ার রেড ক্রিসেন্ট জানিয়েছিল, আল-আসাহ থেকে ৪০ কিলোমিটার উত্তরে রাস জেডির এলাকা ৬৩০ অভিবাসনপ্রত্যাশীকে উদ্ধার করে আশ্রয় দিয়েছে তারা।
বেশ কয়েকদিন আগে রাস জেডির এলাকার বাফার জোনে শতাধিক অভিবাসনপ্রত্যাশীর সঙ্গে কথা হয় এএফপির। ওই সময় তারা ফরাসি সংবাদ সংস্থাকে বলেছিল, তাদের জোর করে পাঠিয়েছে তিউনিসিয়ার নিরাপত্তা বাহিনী। এখনও রাস জেডির এলাকায় ৩৫০ অভিবাসনপ্রত্যাশী রয়েছে, যার মধ্যে ১২ গর্ভবতী নারী ও ৬৫ শিশু রয়েছে। নিজেরা তাঁবু করে সেখানে রয়েছে তারা।
রাস জেডির এলাকায় অবস্থান করা একজন মানবাধিকার কর্মী এএফপিকে বলেন, ‘তাদের জীবনযাপন খুবই সমস্যার মধ্যে রয়েছে। দীর্ঘ সময় এখানে থাকা সম্ভব নয়। এখনে কোনো শৌচাগার বা পানির ট্যাংক নেই। স্থায়ী কোনো কাঠামো নেই যেখানে থাকা যাবে।’
এ দিকে, আল-আসাহ এলাকায় থাকা অভিবাসনপ্রত্যাশীদের কোনো কিছুই নেই। কিছু লোকের পায়ে শুধুমাত্র স্যান্ডেল রয়েছে। দুজন, তিনজন বা কয়েকডজন একত্র হয়ে তারা এই এলাকায় আসছে। অনেকে আসতে আসতে দুর্বলতায় পরে যাচ্ছে। তাদের মুখে পানি তুলে দিচ্ছে লিবিয়া সীমান্তরক্ষীরা।
অভিবাসনপ্রত্যাশীদের আসা নিয়ে প্রত্যেক দিন ওই এলাকায় টহল দিচ্ছে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর ১৯ নম্বর ব্যাটালিয়ন। ওই ব্যাটালিয়নের মুখপাত্র আলি ওয়ালি বলেন, ‘আমরা লিবিয়া ও তিউনিসিয়ার সীমান্ত রেখায় রয়েছি। আমরা প্রতিদিন আরও বেশি সংখ্যক অভিবাসনপ্রত্যাশীকে আসতে দেখছি।’
এই মুখপাত্র বলেন, ‘আল-আসাহ এলাকার ১৫ কিলোমিটার সীমান্তে আমরা টহল দিচ্ছি। কোনো দিন আমরা দেড়শ অভিবাসনপ্রত্যাশী পাচ্ছি। আবার কোনো কোনো দিন এই সংখ্যা ৫০০-তেও পৌঁছাচ্ছে। মূলত, বিষয়টি ভাগ্যের ওপর নির্ভর করছে।’
বিষয়টি নিয়ে গত বৃহস্পতিবার একটি যৌথ বিবৃতি দিয়েছে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা। তিউনিসিয়ার সীমান্তে অভিবাসনপ্রত্যাশী, অভিবাসী ও উদ্বাস্তুদের সঙ্গে হওয়া ঘটনা নিয়ে উদ্বেগ জানানো হয়। যৌথ বিবৃতিতে সংস্থাগুলো বলেছিল, অভিবাসনপ্রত্যাশীরা মরুভূমিতে আটকে আছে। তীব্র গরমের মুখোমুখি হওয়া এসব মানুষ খাদ্য, পানি এমনকি, মাথা গোজার ঠাঁইও পাচ্ছে না। তাদের জরুরি ভিত্তিতে সহায়তা করা দরকার ও খুব দ্রুত এই সমস্যার সমাধান হওয়া উচিত।