জার্মানিতে গণতন্ত্রকে কী প্রশ্নবিদ্ধ করছে সমাজের একাকিত্ব?

Looks like you've blocked notifications!

জার্মান তরুণদের মধ্যে বাড়ছে একাকিত্ব৷ এর প্রভাব পড়ছে তাদের স্বাস্থ্যের সাথে সাথে দেশের গণতান্ত্রিক মনোভাবেও। জার্মানিতে একাকিত্বকে ডাকা হয় ‘নিরব অতিমারি’ নামে৷ সাম্প্রতিক সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, প্রতি ১০ জনের মধ্যে ছয়জন, অর্থাৎ দেশের প্রায় এক কোটি ২০ লাখ মানুষ একাকিত্বে ভোগেন৷

সামাজিক দূরত্ব বা সোশ্যাল আইসোলেশন থেকে এই একাকিত্বকে অনেকটা আলাদাভাবে দেখেন মনোবিদরা৷ তাদের মতে, একাকিত্ব আসলে বাস্তবিক সামাজিক সম্পর্কের সাথে আকাঙ্খিত সম্পর্কের মাঝের ফারাককে বোঝায়৷ পরিসংখ্যান বলছে, এতে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত তরুণরা৷ ১৮ থেকে ২৯ বছর বয়সি জার্মানদের প্রায় এক চতুর্থাংশই এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত৷

পরিবার বিষয়ক মন্ত্রী গ্রিন পার্টির লিজা পাউজ একাকিত্বকে দেখেন বর্তমান সময়ের অন্যতম গুরুতর সমস্যা হিসেবে৷ এর কারণ, একাকিত্ব থেকে বাড়তে পারে হৃদরোগ, স্ট্রোক, ডিমেনশিয়া বা অবসাদের মতো রোগের ঝুঁকি৷ জার্মান পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় ‘এক্সট্রেম আইনজাম’ বা ‘চরম একাকিত্ব’ শিরোনামের একটি গবেষণায় অর্থায়ন করে৷ এই গবেষণা বলছে যে একাকিত্ব গণতন্ত্রকেও ভঙ্গুর করে তোলে৷ গবেষকদের মতে, জনতোষ আখ্যান, ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ও স্বৈরাচারী মনোভাবের প্রতি বাড়তে থাকা ঝোঁক ও অন্যদিকে, সহিংসতা ও আইনবিরোধী কার্যকলাপের বাড়বাড়ন্ত মানুষকে একা করে তুলছে৷

এই গবেষণার লেখকদের মধ্যে একজন সমাজবিজ্ঞানী ক্লাউদিয়া নয়৷ তিনি বলেন, ‘এগুলো নিছক মিল নয়, এর মধ্যে সংযোগ রয়েছে৷’ ক্লাউদিয়ার মতে, যেসব মানুষ দীর্ঘ দিন ধরে একাকিত্বে ভোগেন, তারা দুনিয়াটাকে নেতিবাচকভাবে দেখতে শুরু করেন৷ তারা ভাবেন চারপাশ আরও অন্ধকার, আরও ভয়ানক৷ ফলে, তারা মানুষকে কম বিশ্বাস করেন, আশেপাশের পরিবেশ বা প্রতিষ্ঠানকেও তাই, মনে করেন তিনি৷

গণতন্ত্রের জন্য এটা সমস্যা, কারণ এই ব্যবস্থাটি অংশগ্রহণের ওপর নির্ভরশীল৷ সেক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তিকেও নিজেকে সমাজের অংশ হিসেবে ভাবতে শিখতে হয়, বলেন ক্লাউদিয়া নয়৷

কিন্তু পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে যান সবাই, এমনটা নয়৷ ক্লাউদিয়া বোঝান, ‘‘সমাজ বা কোনো গোষ্ঠীর অংশ হতে মানুষ এখনও চায়, কারণ এটা আমাদের গভীরে প্রোথিত যে একে অপরকে ছাড়া বাঁচতে পারব না৷ দক্ষিণপন্থি জনতোষ গোষ্ঠীরাও এমন মনোভাব চর্চা করে, আবার একই সাথে ভয়ের আখ্যানও ছড়ায়৷ বলে, আমাদের সাথে আসে, তাহলেই এই গোষ্ঠীর অংশ হতে পারবে৷”

একাকিত্ব একমাত্র কারণ নয়

২৫ বছর বয়সি গাব্রিয়েলা গ্রোবারচিকোভা ১৫ বছর বয়স থেকেই একা বোধ করতে শুরু করে৷ তার মতে, তার বাবা-মায়ের বামঘেঁষা রাজনীতির ফলে পুরোপুরি গণতন্ত্রবিরোধী বা চরমপন্থি ধারণায় সে বিশ্বাস করে না৷ কিন্তু তবুও সে বলে, ‘‘আমি অন্যদের থেকে দূরত্ব বোধ করতাম, একটা সত্যিকারের সম্পর্ক খুঁজে পেতাম না৷”

গবেষণা থেকে জানা যায়, গণতন্ত্রের প্রতি সন্দেহপূর্ণ মনোভাব তরুণদের মধ্যে স্বাভাবিক হয়ে পড়েছে৷ সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারী ১৬ থেকে ২৩ বছর বয়সি এক হাজার আটজন জার্মানদের মধ্যে ৪৮ শতাংশের মতে জার্মান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ভালোভাবে কাজ করছে৷ ৪০ শতাংশের মতে ভবিষ্যতদের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত রাজনীতিকরা৷

কিন্তু তার মানে এই নয় যে বর্তমান তরুণ প্রজন্মের তুলনায় আগের প্রজন্মে গণতন্ত্র-প্রেম বেশি ছিল, মনে করেন জার্মান ইউথ ইন্সটিটিউটের সমাজবিজ্ঞানী বিয়র্ন মিলব্রান্ডট৷

কেন একজন তরুণ চরমপন্থার প্রতি আকৃষ্ট হবেন, তার পেছনে রয়েছে আরও নানা দিক৷ আর্থসামাজিক অবস্থা, পরিবারে অশান্তি, চারপাশকে যুক্তি দিয়ে না বুঝতে পারা ও বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাবের মধ্যে থাকাও এর কারণ৷

রাজনীতিতে তরুণ প্রজন্মের ক্ষমতায়ন যেভাবে

মিলব্রান্ডটের মতে, তরুণদের মধ্যে ডানপন্থার দিকে ঝোঁকার হার বিষয়ে সচেতন থাকা গুরুত্বপূর্ণ৷ সাথে, তরুণদের মধ্যে ঊর্ধ্বগামী একাকিত্ব মোকাবিলায় নানামুখী সমাধানের পথ বেছে নিতে হবে৷ স্কুলে রাজনৈতিক ও সামাজিক শিক্ষার পাশাপাশি জার্মানির নাৎসি অতীত, রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের গুরুত্ব, সবকিছুই পড়ানো, শেখানো উচিত, বলে মনে করেন মিলব্রান্ডট৷

রাজনীতিক ও সুশীল সমাজের দায়িত্ব তরুণ প্রজন্মের জন্য এমন শিক্ষার সুযোগ উন্মুক্ত করে তোলা ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তাদের আরও আকৃষ্ট করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা৷