কমলা হ্যারিস : আইনজীবী থেকে যেভাবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী
যুক্তরাষ্ট্রের আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের লড়াইয়ে ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী হয়েছেন বর্তমান ভাইস প্রসিডেন্ট কমলা হ্যারিস। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেওয়ার এক ঘণ্টার মধ্যে ডেমোক্র্যাটরা নতুন মনোনীত প্রার্থী হিসেবে কমলা হ্যারিসের সমর্থনে সমাবেশ শুরু করে।
প্রথম নারী হিসেবে দেশের শীর্ষ পদে অধিষ্ঠিত হতে কমলা হ্যারিস তার প্রচারে উদারপন্থি ভোটারদের পুনরুজ্জীবিত করছেন। তিনি গত দুই মাসে রেকর্ড ৬৭ কোটি ১০ লাখ ডলার অনুদান সংগ্রহ করেছেন, যা তার রিপাবলিকান প্রতিদ্বন্দ্বী ডোনাল্ড ট্রাম্পের চেয়ে প্রায় তিনগুণ। তবে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারী হিসেবে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী কমলার উঠে আসার পথ মসৃণ ছিল না।
পারিবারিক জীবন
যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের ওকল্যান্ডে জন্ম নেওয়া কমলা হ্যারিসের বাবা-মা ছিলেন অভিবাসী। তার মা ভারতীয় বংশোদ্ভূত এবং বাবা জন্ম নিয়েছিলেন জ্যামাইকায়। কমলার বয়স যখন পাঁচ বছর তখন তার বাবা-মায়ের বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে। এরপর থেকে তিনি প্রধানত তার মা শ্যামলা গোপালন হ্যারিসের কাছে বেড়ে ওঠেন। শ্যামলা গোপালন একজন ক্যানসার গবেষক ও নাগরিক অধিকার কর্মী ছিলেন।
মা সম্পর্কে কমলা হ্যারিস ডিএনসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘তিনি ছিলেন কঠোর, সাহসী, নারী স্বাস্থ্যসেবা অধিকার লড়াইয়ের একজন অগ্রদূত। তিনি আমাদের শিখিয়েছেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে কখনও অভিযোগ করবে না, তবে এটি নিয়ে কাজ করবে।’
কমলা হ্যারিসের একজন বোন রয়েছে, যার নাম মায়া। কমলা তার আত্মজীবনী ‘দ্য ট্রুথস উই হোল্ড’ এ লেখেন, ‘আমার মা খুব ভালো করেই বুঝতে পেরেছিলেন, তিনি দুটি কৃষ্ণাঙ্গ মেয়েকে বড় করছেন। তিনি জানতেন, তার দেশটিতে মায়া ও আমাকে কৃষ্ণাঙ্গ মেয়ে হিসেবে দেখা হবে। তবে তিনি আমাদের আত্মবিশ্বাসী, গর্বিত কৃষ্ণাঙ্গ নারী হিসেবে গড়ে তুলতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন।’
কমলা হ্যারিস হাওয়ার্ড ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করেন, যা ঐতিহাসিকভাবে কৃষ্ণাঙ্গদের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে পরিচিত। তখন থেকেই তিনি রাজনীতি ও বর্ণবাদ নিয়ে সোচ্চার হতে শুরু করেন। কমলা হ্যারিস শ্বেতাঙ্গদের মধ্যেও স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে কাজ করেছেন। কিছুদিন তার কানাডায়ও থাকা হয়েছিল। মা গোপালন হ্যারিস ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিলে কমলা ও মায়া তার সঙ্গে যান। পাঁচ বছর তারা মন্ট্রিলের একটি স্কুলে পড়াশোনা করেন।
কমলা হ্যারিস বলেছেন, তিনি সবসময় তার পরিচয় নিয়ে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন এবং নিজেকে একজন ‘আমেরিকান’ হিসেবে বর্ণনা করেন।
২০১৯ সালে ওয়াশিংটন পোস্টকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কমলা হ্যারিস বলেছিলেন, রাজনীতিবিদদের তাদের রং বা ব্যাকগ্রাউন্ড দেখে নির্দিষ্ট কোনো বগিতে উঠিয়ে দেওয়া উচিত না।
কমলা বলেন, ‘আমার বক্তব্য হলো--আমি যে আমি সে-ই। আমি এ নিয়ে ভালো আছি। আপনার এটি খুঁজতে হতে পারে, তবে আমি এ নিয়ে ঠিক আছি।’
দাম্পত্য জীবন
২০১৪ সালে তৎকালীন সিনেটর কমলা হ্যারিস আইনজীবী ডগ এমহফকে বিয়ে করেন এবং তার দুই সন্তান কোল ও এলার সৎ মা হন। তিনি সৎ মা হওয়ার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ২০১৯ সালে এলে ম্যাগাজিনের জন্য একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন।
এতে কমলা লেখেন, “যখন ডগ (এমহফ) ও আমি বিয়ে করি, তখন কোল, এলা ও আমি সম্মত হয়েছিলাম যে আমরা "সৎ মা' শব্দটি পছন্দ করি না। সেটির পরিবর্তে তারা ‘মোমলা’ নামটি নিয়ে আসে।”
কমলার রাজনৈতিক জীবন
কমলা হ্যারিস কর্মজীবন শুরু করেছিলেন সান ফ্রান্সিসকো শহরের আলামেডা কাউন্টির জেলা অ্যাটর্নি হিসেবে। সেখানে তিনি ২০০৪ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন করেন।
কমলার পরবর্তীতে পদোন্নতি পেয়ে ক্যালিফোর্নিয়ার অ্যাটর্নি জেনারেল হন। তিনি ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে জনবহুল রাজ্যটির প্রথম কোনো নারী ও কৃষ্ণাঙ্গ শীর্ষ আইন কর্মকর্তা। এরপর তিনি ২০১৬ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার সিনেটর হন। এরপর ২০২০ সালে তিনি ডেমোক্রেট প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হওয়ার দৌড়ে অংশ নেন। তার প্রচারাভিযানে বিশাল জনসমাগম হলেও তিনি তার আদর্শ ও নীতির বিষয়গুলোকে স্পষ্ট করে উঠতে পারছিলেন না। তার প্রচারণা এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে শেষ হয়ে যায়। তবে বাইডেন তাকে আবার জাতীয় পর্যায়ে স্পটলাইটে নিয়ে আসেন। সেই নির্বাচনে বাইডেন তাকে রানিংমেট ঘোষণা করেন। নির্বাচনে জয়ের পর কমলা হন প্রথম মার্কিন নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট।
ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস
কমলা হ্যারিস হোয়াইট হাউসের দায়িত্ব পালনকালে সরকারের বেশ কয়েকটি মূল উদ্যোগের দিকে দৃষ্টি দিয়েছিলেন এবং তিনি বাইডেন প্রশাসনের অনেকগুলো কৃতিত্ব অর্জনে সহায়ক ভূমিকা পালন করেন।
কমলা সিনেটের ইতিহাসে একজন ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে সবচেয়ে বেশিবার টাই-ব্রেকিং ভোট দেওয়ার নতুন রেকর্ড করেছেন। তিনি মুদ্রাস্ফীতি হ্রাস আইন ও আমেরিকান রেসকিউ প্ল্যান পাস করতে সাহায্য করেন।
প্রেসিডেন্ট বাইডেন কমলা হ্যারিসকে মার্কিন-মেক্সিকো সীমান্ত দিয়ে অভিবাসী আগমন এবং অভিবাসনের মূল চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলার দায়িত্ব দেন। কিন্তু, তিনি এ বিষয়ে যথেষ্ট অগ্রগতি করতে পারেননি। দায়িত্ব নেওয়ার পর সীমান্ত এলাকায় যেতে ছয় মাস সময় নেওয়ায় তার কঠোর সমালোচনা করেন রিপাবলিকান ও কিছু ডেমোক্র্যাট নেতা।
অতি সম্প্রতি কমলা হ্যারিস গর্ভপাত নিষেধাজ্ঞার কারণে সৃষ্ট ক্ষতিগুলো তুলে ধরার ক্ষেত্রে প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিতে পরিণত হন। ডেমোক্র্যাটিক ন্যাশনাল কনভেনশনে দেওয়া ভাষণে কমলা হ্যারিস সারা দেশে গর্ভপাতের অধিকার নিষিদ্ধের প্রচেষ্টার জন্য ট্রাম্প ও রিপাবলিকানদের সমালোচনা করেন।
২০২০ সালের প্রচারাভিযানে কমলা হ্যারিস অভিবাসন, এলজিবিটি অধিকার এবং অন্যান্য ইস্যুগুলোতে বামপন্থি ঝোঁক থেকে কথা বলেছিলেন, কিন্তু তার অতীতের আইন পেশা নিয়ে বারবার প্রশ্নের মুখে পড়েন। চার বছর পরে কমলা হ্যারিস আবার নিজেকে একজন আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ব্যক্তি হিসেবে উপস্থাপন করছেন এবং ট্রাম্পের মতো দোষী সাব্যস্ত হওয়া অপরাধীকে দমনের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। তবে তিনি একটি প্রগতিশীল এজেন্ডা নিয়ে এগোচ্ছেন, যা তার নিজের মতো মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোকে সুবিধা দেবে।
‘আমার পুরো ক্যারিয়ার, আমার কেবল একটি ক্লায়েন্ট ছিল, আর তা হলো সাধারণ মানুষ’, বলেন কমলা হ্যারিস।