‘সাশ্রয়ী’ বাতিতেও হচ্ছে না বিদ্যুৎ সাশ্রয়
দেশের বাজারে গত কয়েক বছরে ‘সাশ্রয়ী’ বৈদ্যুতিক বাতিতে (এনার্জি ইফিশিয়েন্ট বাল্ব) সয়লাব হয়ে গেছে। অনুমোদন নিয়ে মাত্র ১০টি প্রতিষ্ঠান দেশে উৎপাদন ও বিপণন করছে। কিন্তু নামে-বেনামে অর্ধশতাধিক কোম্পানির বাল্ব বাজারে বিক্রি হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাজারের বেশির ভাগ বাতিই বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী নয়। যে পরিমাণ আলো দেওয়ার কথা, তা-ও দেয় না। আর মানহীন এসব বাতিতে পারদসহ কিছু ক্ষতিকর ভারী ধাতু থাকে, যা স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশের বাজারে বর্তমানে তিন ধরনের বাল্ব পাওয়া যায়। এগুলো হলো ইনক্যানডেসেন্ট বাল্ব (লাল আলোর বাতি), কমপ্যাক্ট ফ্লোরেসেন্ট বা সিএফএল বাল্ব ও লাইট এমিটিং ডিওড বা এলইডি বাল্ব। দেশি ও বিদেশি বিভিন্ন কোম্পানি এসব বাল্ব বাজারজাত করছে। এসব কোম্পানি মান ও শক্তি (ওয়াট) ভেদে ভিন্ন দামে বাল্ব বিক্রি করে। কিন্তু দেশের বাজারে সরবরাহ করা বেশির ভাগ বাল্বে যে শক্তি উল্লেখ করা হয়, সে পরিমাণ আলো পাওয়া যায় না বলে গবেষকরা মনে করেন। তাঁদের মতে, নির্দেশনা অনুযায়ী বিদ্যুৎ ব্যয়ের পরিমাণ নির্ভর করে ব্যবহৃত উপাদান ও প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের নীতির ওপর। দেশের বাজারের বাল্বে ঠিকমতো আলো পাওয়া যায় না। তবে সরকারিভাবে মান নিয়ন্ত্রণ ও সনদপ্রাপ্ত হলে পণ্যের মানে গ্রাহকের আস্থা বাড়ত।
বাল্ব নিয়ে গবেষণা
বাংলাদেশ কাউন্সিল অব সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চের (বিসিএসআইআর) জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শাহরিয়ার বশির বলেন, ‘লাল আলোর ইনক্যানডেসেন্ট বাল্বের মাধ্যমে গড়ে ৫ শতাংশ বিদ্যুৎকে আলো ও বাকি ৯৫ শতাংশ তাপ উৎপাদনে নষ্ট হতো। সিএফএল বাল্ব ২০ শতাংশ বিদ্যুৎ শক্তিকে আলোতে রূপান্তর করতে পারে। আর এলইডি ৫০-৬০ শতাংশ শক্তিকে আলোতে রূপান্তরে সক্ষম। ফলে একই পরিমাণ আলো উৎপাদনে প্রযুক্তির কারণে বিদ্যুৎ সাশ্রয় হয়েছে কয়েকগুণ।’
এলইডি বাতির দাম বেশি হলেও ব্যয়বহুল নয় উল্লেখ করে শাহরিয়ার বশির বলেন, ‘আয়ুষ্কাল (লাইফটাইম) হিসাব করলে লাল আলোর বাল্ব (১০০ ওয়াট) এক হাজার ঘণ্টা জ্বলে। এ ক্ষেত্রে সিএফএল সাত-আট হাজার ঘণ্টা জ্বলে। আর এলইডির আয়ুষ্কাল ৪০-৫০ হাজার ঘণ্টা। নষ্ট হলে এলইডি মেরামতযোগ্য। অর্থাৎ একবার কিনলে কয়েক বছর আর কিনতে হচ্ছে না। এ ছাড়া এলইডি অধিক বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী হওয়ায় বিলও কম আসে।’
বিশ্বের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ
পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর বলে উন্নত দেশগুলোতে ২০১৫ সালের পর সিএফএল ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ হয়। আর এলইডির ব্যবহার বাড়াতে প্রচার চালানো হয়েছে। তবে ২০১১ সাল থেকে সিএফএলের বাল্ব ব্যবহারে প্রচার শুরু হয়। আর এখন দেশের মানহীন বৈদ্যুতিক বাতির বাজার নিয়ন্ত্রণহীন।
বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে সাশ্রয়ী বাল্বের ব্যবহার, ব্যবহার শেষে ধ্বংসে বিধান রয়েছে। বাংলাদেশে তার কোনো তোয়াক্কা নেই।
‘সাশ্রয়ী’ হলেও ক্ষতিকর
বুয়েটের গবেষকদের ভাষ্য, একটি বাল্বের পারদ (মারকারি) ২৩ হাজার লিটার পানি দূষিত করতে যথেষ্ট। পারদ মানবদেহের মস্তিষ্ক, স্নায়ুতন্ত্র, লিভার, কিডনি ইত্যাদি অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ক্ষতি করে। গর্ভের সন্তানের বিকলাঙ্গতা, মস্তিষ্কের ত্রুটিপূর্ণ গঠন, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া, হৃদরোগসহ নানা জটিল রোগের উপসর্গ সৃষ্টি করে।
ব্যবহার নীতিমালা জরুরি
বাল্বের ক্ষতিকর দিক তুলে ধরে বুয়েটের সেন্টার ফর এনার্জি স্টাডিজের পরিচালক ও তড়িৎ কৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জিয়াউর রহমান খান বলেন, ‘সিএফএল বাল্বে পারদসহ কিছু ক্ষতিকর ভারী ধাতু থাকে। বাল্ব ভেঙে গেলে এর পারদ ও ফসফরাস দ্রুত বাতাসে ছড়ায়। গর্ভাবস্থায় শিশুর ক্ষতি ও বৃদ্ধিতে বাধাসহ বেশ কিছু সমস্যা সৃষ্টি করে।’
ড. মোহাম্মদ জিয়াউর রহমান খান বলেন, ‘বাংলাদেশে নষ্ট বাল্বের বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সচেতনতা নেই। আমেরিকা, কানাডাসহ উন্নত বিশ্বে সিএফএল বাল্ব ব্যবহারে ১৫টি শর্তের নীতিমালা রয়েছে। বাংলাদেশে তার কোনো তোয়াক্কা নেই। নষ্ট বাল্ব মেরামতকারীদেরও ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে ধারণা নেই।’
বর্তমানে এলইডি বাল্ব ব্যবহারে দুটি প্রধান সমস্যা রয়েছে বলে মনে করেন জিয়াউর রহমান খান। তাঁর মতে, এলইডির দাম বেশি ও সহজে পাওয়া যায় না। ক্রমান্বয়ে প্রযুক্তি সহজলভ্য হলে উৎপাদন বাড়বে।
সাশ্রয়ী বলে বিক্রি করা বাল্বে বিদ্যুৎ সাশ্রয় ও পরিবেশ রক্ষা হচ্ছে কি না, সেদিকে সরকারকে নজর দেওয়ার পরামর্শ দেন এ বিশেষজ্ঞ।
মানহীন বাল্ব নিয়ে বিএসটিআইর বক্তব্য
বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্স অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউটের (বিএসটিআই) সহকারী পরিচালক আরাফাত হোসেন সরকার বলেন, ‘সাধারণত আমরা বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী বাল্বের অনুমোদন বা লাইসেন্স প্রদানে দুটি মানকে স্ট্যান্ডার্ড ধরি। বিডিএস-১৭৩৪ ও বিডিএস-১৭৩৫। অধিক সাশ্রয়ের ক্ষেত্রে বিডিএস-১৭৬১ অনুসরণ করা হয়। বুয়েট কর্তৃক নির্ধারিত এ তিনটি মান অনুসরণ করে ১০টি প্রতিষ্ঠানকে বাল্ব উৎপাদন ও বিপণনের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাজারে নামে-বেনামে প্রায় ৪০-৫০টি প্রতিষ্ঠানের পণ্য বিক্রি হচ্ছে। এর মধ্যে বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানের পণ্যের সঠিক মান নেই।’
আরাফাত আরো বলেন, ‘এসব মানহীন বাল্ব বিক্রি আইনসম্মত নয়। গ্রাহককে প্রতারণা থেকে রক্ষায় বিএসটিআই নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে। সম্প্রতি গুলিস্তান, কাপ্তানবাজার, ফার্মগেটসহ বেশ কিছু পয়েন্টে অভিযানে দুই হাজার বাল্ব জব্দ ও পাঁচটি কারখানাকে ছয় লাখ ৩২ হাজার টাকা জড়িমানা করা হয়েছে। কিন্তু তার পরও বাজারজাতকরণ বন্ধ করা যাচ্ছে না। তবে আগের চেয়ে কমেছে।’
নিয়ন্ত্রণহীন বৈদ্যুতিক বাতির বাজার
নিম্নমানের পণ্য বিপণন বন্ধে উদ্যোগের কমতি নেই বলে দাবি করেছে বিএসটিআই কর্তৃপক্ষ। তাদের ভাষ্য, নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা, মাল জব্দ ও জরিমানার পরও তেমন সুফল আসছে না। এ পর্যায়ে উৎপাদন ও আমদানি করা পার্টস সংযোজনকারী প্রতিষ্ঠানেও অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। বৈদ্যুতিক বাতির বাজার নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে। ভ্রাম্যমাণভাবেও বাল্ব বিক্রি হচ্ছে। ফলে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে শতভাগ সমাধান সম্ভব নয়। ক্রেতাদের কাছে পণ্যের মান ও ক্ষতিকর দিক তুলে ধরা জরুরি।
সচেতনতার অভাবই মূল বাধা
এলইডির ব্যবহার বাড়াতে সচেতনতা ও প্রচারের অভাব আছে বলে মনে করছেন উৎপাদন ও বিপণন-সংশ্লিষ্টরা।
এনার্জিপ্যাক গ্রিন সলিউশনের প্রকৌশলী আহমেদ আশিকুজ্জামান বলেন, ‘বাংলাদেশের জন্য এলইডি প্রযুক্তি নতুন। বিশ্বের তুলনায় দেশে সিএফএলের ব্যবহার ও চাহিদা দেরিতে বেড়েছে। স্বল্প সময়ের ব্যবধানে আরেকটি প্রযুক্তি আসায় কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। সিএফএলকেই মানুষ সাশ্রয়ী মনে করে। আর সিএফএলের চেয়ে এলইডির দাম খানিকটা বেশি হওয়ায় ব্যবহার আশানুরূপ বাড়ছে না।’
দেশে বিভিন্ন বাল্বের দাম
রাজধানীর বিভিন্ন দোকান ঘুরে দেখা যায়, লাল আলোর বাল্বের মধ্যে ৪০ থেকে ২০০ ওয়াটের বাল্ব পাওয়া যায়। এর মধ্যে ফিলিপস ব্র্যান্ডের ৬০ ওয়াটের দাম ২৮ টাকা। ১০০ ওয়াটের দাম ২৯ টাকা ও ২০০ ওয়াটের দাম ৪৫ টাকা।
সিএফএল বাল্বের ক্ষেত্রে ৫ ওয়াট থেকে শুরু করে ৩৩ ওয়াটের বাল্ব রয়েছে। ফিলিপসের গ্যারান্টিযুক্ত ৫ ওয়াটের দাম ২২০ টাকা। একই শক্তির গ্যারান্টিবিহীন আমদানি করা চীনের বাল্বের দাম ৯০ টাকা। ৩৩ ওয়াটের গ্যারান্টিযুক্ত বাল্বের দাম ৭৫০ টাকা এবং গ্যারান্টিবিহীন ১৮ ওয়াটের চীনের বাল্বের দাম ৩৫০ টাকা।
২৪ থেকে ১০০ ওয়াটের বিভিন্ন আকারের এলইডির বাল্ব বাজারে রয়েছে। ফিলিপস ব্র্যান্ডের ২৪ ওয়াটের এলইডির দাম ২৪০ টাকা ও ৮৫ ওয়াটের দাম ৯৮০ টাকা।
এ ছাড়া নামে-বেনামে বিভিন্ন ব্র্যান্ড ও কোম্পানির বাল্ব বাজারে রয়েছে। সেগুলোর দাম ও মান নির্দিষ্ট নয়।