পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগের সমন্বয়ের সময়সীমা বাড়ানো যৌক্তিক
![](https://ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2016/04/26/photo-1461646752.jpg)
পুঁজিবাজারে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ সমন্বয়ের সময়সীমা বাড়ানো যৌক্তিক ও একান্ত আবশ্যক বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান।
রাজধানীর হোটেল পূর্বাণীতে গতকাল সোমবার রাতে বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএমবিএ) আয়োজিত ‘অর্থনীতি ও পুঁজিবাজারের উন্নয়নে মার্চেন্ট ব্যাংকের ভূমিকা’ শীর্ষক এ সেমিনারে এ কথা বলেন ড. মশিউর রহমান।
পুঁজিবাজারে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ সমন্বয়ের সময়সীমা বাড়ানোর বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত বলে মনে করেন ড. মশিউর রহমান। তিনি বলেন, ‘এখন এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন না কারার কোনো যুক্তি নেই। যদি কেউ এটাকে বাস্তবায়ন করতে না চায়, তাকে এর শক্ত যুক্তি দেখাতে হবে যে- এতে অর্থনীতির ক্ষতি হবে।’
মশিউর রহমান বলেন, ‘এক্সপোজার লিমিট বাড়ানোর জন্য সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তা বাস্তবায়ন করা দরকার। এটা পরিবর্তন করার যৌক্তিকতা নেই। যদি কেউ তা বাস্তবায়ন করতে না চায় তাহলে তাদের শক্ত যুক্তি দিতে হবে যে, এটা করলে মার্কেটে বাবল (অতিমূল্যায়ন) হবে। এ ব্যাপারে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করা হবে।’
মশিউর রহমান বলেন, ‘ব্যাংকে এখন অনেক টাকা অলস পড়ে আছে। এ টাকা বিনিয়োগ হচ্ছে না। আর আরো টাকা অলস হলে এক সময় ব্যাংকগুলো আমানত নিতে চাইবে না। এভাবে ব্যাংকে বেশি টাকা অলস ফেলে রাখার যুক্তি নেই। তাই প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী ব্যাংকের বিনিয়োগ সমন্বয়ের সীমা বাড়ানোর যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তা অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত।’
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির স্কুল অব-বিজনেস অ্যান্ড ইকোনমিকসের অধ্যাপক ও ডিন মোহাম্মদ মুসা।
মুসা বলেন, ‘শেয়ারবাজারে কিছু চ্যালেঞ্জ আছে। এর মধ্যে মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর মার্জিন ঋণের সুদের হার অনেক বেশি। তা কমাতে হবে। রেগুলেটর ও স্টেকহোল্ডারদের সমন্বয়ে বন্ড মার্কেট শক্তিশালী করতে হবে। মার্কেটে শর্ট সেল চালু করতে হবে। তাহলে বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরবে।’
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান ড. খায়রুল হোসেন বলেন, ‘গত পাঁচ বছরে অনেক আইনের সংস্কার হয়েছে। এর মাধ্যমে নতুন কোম্পানি আনার ক্ষেত্রে বুকবিল্ডিং পদ্ধতিতে অনিয়ম, প্লেসমেন্ট শেয়ারের কারসাজি, ইনসাইডার ট্রেডিংসহ সব ধরনের কারসাজি বন্ধ হয়েছে। ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং অ্যাক্ট বাস্তবায়ন হয়েছে। ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিলের মাধ্যমে কোম্পানিগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন পুরোপুরি বাস্তবায়ন সম্ভব হবে। ২০১৭ সালে ডেরিভেটিভ মার্কেট চালু করা হবে। তার আগে মার্কেটে শর্ট সেল চালু হবে।’
খায়রুল হোসেন বলেন, ‘মাত্র ছয় শতাংশ বিনিয়োগকারীর কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন-সংক্রান্ত জ্ঞান আছে। তা বাড়ানোর জন্য আগামী জুলাই মাস থেকে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালু করা হবে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বাড়ানোর লক্ষ্যে স্টক এক্সচেঞ্জ ডিমিউচ্যুয়ালাইজড করা হয়েছে। তবে অনেক বিজ্ঞরা এ বিষয়ে ভুল তথ্য দিয়ে থাকেন। ডিমিউচ্যুয়ালাইজড হয়েছে কিন্তু শেয়ারবাজারে ইতিবাচক না হওয়ায় তারা সমালোচনা করেন। সামাজিক, রাজনৈতিক কারণে ২০১০ সালের পরবর্তী সময়ে ফোর্সড সেল করা সম্ভব হয়নি। এর কারণে শেয়ারবাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।’
খায়রুল হোসেন আরো বলেন, ‘ভালো কোম্পানি বাজারে না এলে বাজার গতিশীল হবে না। সরকারি কোম্পানিগুলো তালিকাভুক্তির পর আমাদের রেগুলেট করার ক্ষমতা দিতে হবে। একটা তালিকাভুক্ত কোম্পানি নিজেদের মতো সিদ্ধান্ত নেবে, এটা হবে না। আবার বহুজাতিক কোম্পানি বাজারে আনার ক্ষেত্রে আমাদের কোনো হাত নেই। সরকারই এদের ছাড় দিয়েছে। তাদের বাজারে আনার দায়িত্ব সরকারের।’
বিএসইসির সাবেক কমিশনার আরিফ খান বলেন, ‘ভালো কোম্পানি বাজারে আনা মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর বড় চ্যালেঞ্জ। শুধু ইস্যু এনে দায় এড়ানো যাবে না। কোম্পানি বাজারে আনার পরে পাঁচ বছর তাদের কার্যক্রমের খোঁজখবর রাখতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসনে দিকনির্দেশনা শক্তিশালী করতে হবে। কোম্পানি তথ্যগত কোনো আইন লঙ্ঘন করলে কঠোর শাস্তি দিতে হবে। কারণ এখানে বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি বেশি হয়।’
আরিফ খান বলেন, ‘মানুষ কেন ৯০ শতাংশ টাকা ব্যাংকে রাখে। ১০ শতাংশ টাকা পুঁজিবাজারে আনে- তা খতিয়ে দেখতে হবে। এ ক্ষেত্রে মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোকে দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে হবে। বিশ্ব ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশের ৬০ শতাংশ মানুষ কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্বাস করে না। এই তথ্য বিশ্বাসযোগ্য করে প্রকাশ করতে হবে।’
ডিএসইর পরিচালক রকিবুর রহমান বলেন, ‘অর্থমন্ত্রী-বাণিজ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নরের কাছে আবেদন দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে তারা হ্যাঁ অথবা না কিছুই বলছেন না। এখন আমরা কার কাছে যাব। যেখানে একটি কোম্পানিকে ব্যাংক ঋণ দিয়ে ১৮ থেকে ২০ বছরের জন্য রিসিডিউল করে দেওয়া হয়। অথচ লাখ লাখ বিনিয়োগকারীদের জন্য সামান্য পলিসি সাপোর্ট পাচ্ছি না।’
রকিবুর রহমান বলেন, ‘অর্থমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছিলেন ব্যাংকের বিনিয়োগ সমন্বয়ের সীমা বাড়িয়ে ২০১৮ সাল পর্যন্ত করা হবে। এখন শুনছি অর্থমন্ত্রীকে বোঝানো হচ্ছে এ সুযোগ দেওয়া হলে বাজার মেনুপুলেট ও বাবল হবে। এটাতে কীভাবে বাজার বাবল হবে, আমরা তার কোনো অর্থ খুঁজে পাচ্ছি না।’
অর্থ উপদেষ্টাকে উদ্দেশ করে রকিবুর রহমান বলেন, ‘জিডিপির প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হলে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ আনতেই হবে। আমরা টাকা চাচ্ছি না, সহায়তা চাচ্ছি না, কোনো ফান্ড চাচ্ছি না। আমরা শুধু নীতিগত সহায়তা চাচ্ছি।’
ডিএসইর সাবেক জৈষ্ঠ সহ-সভাপতি আহমেদ রশিদ লালী বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক বিনিয়োগ সমন্বয় করা নিয়ে কেন এই খেলা খেলছে? আইনে বিনিয়োগ সমন্বয়ের বিষয়ে কোনো তারিখ নির্ধারণ নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের কারণে ধিরে ধিরে পুঁজিবাজার ধ্বংসের দিকে চলে যাচ্ছে। এ ধরনের কার্যকালাপ বন্ধ করতে হবে।’
লালী বলেন, ‘তিতাস গ্যাস মুনাফার বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল। আবার বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) তালিকাভুক্ত স্ট্যান্ডার্ড ইন্স্যুরেন্সের নিবন্ধন সনদ বাতিল করে দিল। পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির সঙ্গে একবারও পরামর্শের প্রয়োজন মনে করল না। এখন এসব কোম্পানির বিনিয়োগকারীদের কী হবে? এভাবে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীন এমন সিদ্ধান্তের কারণে পুঁজিবাজার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আর বিনিয়োগকারীরা এর মাশুল গুনছেন।’
সেমিনারে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির কমিশনার, ডিএসইর পরিচালক ও বিএমবিএ সদস্য প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।