ষড়যন্ত্র করে আমাকে ফাঁসানো হয়েছে : সামিয়া রহমান
![](https://ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2021/03/01/samia-1.jpg)
‘আমাকে ষড়যন্ত্র করে অন্যায়ভাবে ফাঁসানো হয়েছে। বলির পাঁঠা বানানো হয়েছে।’ এমন দাবি করেছেন একাডেমিক গবেষণায় চৌর্যবৃত্তির দায়ে পদাবনতি হওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক সামিয়া রহমান।
আজ সোমবার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক সংবাদ সম্মেলনে সামিয়া রহমান এ দাবি করেন। সংবাদ সম্মেলন আরও উপস্থিত ছিলেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ ও আইনজীবী তুরিন আফরোজ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ন্যায়বিচার পাননি। এ বিষয়ে প্রকৃত সত্য উদঘাটন করতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে কঠোর নির্দেশ দিতে আচার্য রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদকে অনুরোধ করেছেন সামিয়া রহমান। বিষয়টি নিয়ে তিনি আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়ায় আছেন বলেও জানান।
সামিয়া রহমান দাবি করেন, গবেষণার যে লেখার জন্য তাঁকে অভিযুক্ত করা হয়েছে, সেটা তিনি লেখেননি, জমাও দেননি। এ সংক্রান্ত প্রমাণও তাঁর কাছে আছে। এই ‘ষড়যন্ত্রের’ পেছনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কেউ কেউ এবং কিছু শিক্ষক জড়িত রয়েছেন বলে ইঙ্গিত করেন তিনি। তবে তাঁদের নাম না বলে এ বিষয়ে অনুসন্ধান করে তা বের করতে সাংবাদিকদের অনুরোধ জানান তিনি।
সামিয়া রহমান আরো দাবি করেন, লেখাটি মূলত তাঁর সাবেক ছাত্র ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক সৈয়দ মাহফুজুল হক মারজানের। সবার মতো তিনি মারজানকেও বিভিন্ন পরামর্শ দিতেন। তিনি তাঁকে লেখার জন্য ১৩-১৪টি বিষয় বলেন।
মারজানের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের দূরত্ব বিষয়ে সামিয়া রহমান বলেন, মারজানকে প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পেতে সহযোগিতা করেন এমন দুজন শিক্ষকের সঙ্গে খারাপ আচরণ করায় বিষয়টি নিয়ে তিনি তাঁর সঙ্গে কথা বলেন। তখন মারজান তাঁর সঙ্গেও খারাপ আচরণ করেন।
![](https://ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2021/03/01/samia-2.jpg)
সংবাদ সম্মেলনে নিজের পক্ষে কিছু যুক্তি তুলে ধরে সামিয়া রহমান বলেন, “২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমার নামে অভিযোগ করা হয়। তাতে বলা হয়, ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে সোশ্যাল সায়েন্স জার্নালে আমার এবং সৈয়দ মাহফুজুল হক মারজানের নামে প্রকাশিত ‘আ নিউ ডাইমেনশন ইন কলোনিয়ালিজম অ্যান্ড পপ কালচার : আ কেস স্টাডি অব কালচারাল ইম্পেরিয়ালিজম’ প্রবন্ধটি শিকাগো জার্নালে প্রকাশিত মিশেল ফুকোর ‘দ্য সাবজেক্ট অ্যান্ড পাওয়ার’ প্রবন্ধটির অংশবিশেষ অনুকরণ করে রচিত। প্লেজারিজমের অভিযোগে জার্নালের অ্যাডমিনিস্ট্র্যাটিভ অ্যাসিসটেন্ট অ্যালেক্স মার্টিন আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন বলে জানানো হয়। তার পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট ২০১৭ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। শিকাগো জার্নালের যে চিঠির ভিত্তিতে আমার বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি গঠন করে দীর্ঘ চার বছর ধরে মিডিয়া ট্রায়াল করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে শাস্তির সুপারিশ করেছে, ডিমোশন দিয়েছে, সেই চিঠিটিই আদতে সম্পূর্ণ মিথ্যা, ভুয়া, বানোয়াট। শিকাগো জার্নাল থেকে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে এই ধরনের কোনো চিঠি, কখনও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে পাঠানো হয়নি। অ্যালেক্স মার্টিন বলে শিকাগো জার্নালে কেউ কখনও কাজ করেননি। এমনকি শিকাগো ইউনিভার্সিটি এবং শিকাগো প্রেসেও অ্যালেক্স মারটিন বলে কেউ নেই। শিকাগো জার্নালের এডিটর ক্রেইগ ওয়াকার নিজে জানিয়েছেন, অ্যালেক্স মার্টিন বলে কেউ কখনও শিকাগো জার্নালে ছিল না, কেউ নেই। চিঠিটি যে সম্পূর্ণ বানোয়াট, তৈরি করা বা মিথ্যা; তা চিঠিটির বিভিন্ন অংশ পড়লেই দেখতে পাবেন।” এ সময় তিনি শিকাগো জার্নালের কাছ থেকে পাওয়া ই-মেইলের ছবি তুলে ধরেন।
প্রাপ্ত চিঠি প্রসঙ্গে সামিয়া বলেন, “চিঠিটির (ই-মেইল) ‘বিসিসি’ অংশটি দেখুন। কোনো মেইলের বিসিসি, যিনি মেইল পাঠান একমাত্র তিনিই শুধু দেখতে পারেন। রিসিভার অর্থাৎ যিনি মেইল রিসিভ করেছেন, তিনি কখনও বিসিসি দেখতে পারেন না। এটা অসম্ভব। এই মেইলের রিসিভার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, অথচ বিসিসি অংশটি স্পষ্টভাবে প্রকাশিত। বিসিসিতে প্রো-ভিসির আইডি দেওয়া এবং মেইল প্রিন্ট আউটও হয়েছে প্রো-ভিসির অফিস থেকে। যাচাই করে নিতে পারেন মেইলের রিসিভারের পক্ষে কখনও বিসিসি দেখা সম্ভব কী! তাহলে চিঠিটি পাঠিয়েছে কে? আমরা যাচাই করে প্রমাণ পেয়েছি, চিঠিটি সম্পূর্ণভাবে দেশে বসেই তৈরি করা।”
নিজের পক্ষে আরও প্রমাণ তুলে ধরে সামিয়া বলেন, ‘প্রত্যেকটা বিদেশি জার্নাল বা বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ডোমেইন থাকে। এখানে কথিত অ্যালেক্স মার্টিন সেই ডোমেইনও ব্যবহার করেননি। নিজস্ব ব্যক্তিগত মেইল থেকে তিনি এই চিঠি পাঠিয়েছেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আজ পর্যন্ত চিঠিটির কোনও সফট কপিও আমাকে পাঠায়নি। ট্রাইব্যুনাল পর্যন্ত এই চিঠিটি এবং অ্যালেক্স মার্টিনকে নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল। ট্রাইব্যুনালের সদস্য ড. জিনাত হুদা গণমাধ্যমকেই বলেছেন, অ্যালেক্স মার্টিন চরিত্রটি সন্দেহজনক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অফলাইন জার্নালের কপি কীভাবে অ্যালেক্স মার্টিনের কাছে পৌঁছাল? কিন্তু তদন্ত কমিটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে (যে তদন্ত কমিটি চার বছর ধরে মিডিয়াকে আমার বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেছে) এই বিষয়ে সম্পূর্ণ নিশ্চুপ থেকেছে। চিঠিটি ম্যানুফ্যাকচার করা সেটি গুরুত্বপূর্ণ অধিদপ্তরগুলোই বলছে। আপনারা চাইলে নিজেরাও যাচাই করে নিতে পারেন তাদের এই মেইল দেখিয়ে।’
সামিয়া আরও দাবি করেন, ‘এ ধরনের অভিযোগে কখনও কোনো জার্নাল বা বিশ্ববিদ্যালয় জুনিয়র কাউকে দিয়ে পাঠায় না। সাধারণত ডিন অফিস বা প্রফেসররা এ জাতীয় অভিযোগগুলো আদান-প্রদান করেন। কিন্তু কথিত অ্যালেক্স মার্টিন একজন জুনিয়র অ্যাডমিনিসট্রেটিভ অ্যাসিসটেন্ট এবং যার কোনো অস্তিত্বই শিকাগো জার্নালে নেই। একটি মিথ্যা চিঠির ওপর ভিত্তি করে তদন্ত হলে, শাস্তি দেওয়া হলে, সেই তদন্তের কার্যকারিতা কি ষড়যন্ত্রমূলক নয়? এটি কি অপরাধ নয়? উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নয়? দীর্ঘ চার বছর ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আমাকে মিডিয়া ট্রায়ালের মাধ্যমে হয়রানি করে শাস্তি দিয়েছে। চিঠির অস্তিত্বই তো মিথ্যা।’
সামিয়া রহমান বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন বলুক, কেন এই মিথ্যা চিঠির ওপর ভিত্তি করে যড়যন্ত্র করে আমাকে ফাঁসানো হলো? বিসিসি কেমন করে দেখা যাচ্ছে ওই মেইলটিতে?’
চার বছর চুপ থাকা প্রসঙ্গে সামিয়া রহমান বলেন, চার বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের হুমকি-ধমকির চাপে ও তদন্তনাধীন বিষয় বলে মুখ বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছিলাম। তার সুযোগে ষড়যন্ত্রকারীরা দিনের পর দিন প্রপাগান্ডা চালিয়েছে আমার বিরুদ্ধে। অবশ্যই বাংলাদেশের আদালতের ওপর সম্পূর্ণ আস্থা রেখে আদালতেই যাচ্ছি। যে লেখাটি আমি লিখিনি, জমা দেইনি, (আইডিয়া দেওয়া আর গবেষণা এক বিষয় নয়)। ডিন অফিসে আমার কাছ থেকে লেখার কোনো হার্ড বা সফট কপি জমা দেওয়ার কোনো প্রমাণ তদন্ত কমিটি, ট্রাইব্যুনাল পর্যন্ত পায়নি, রিভিউয়ারের কপিও আমার কাছে আসেনি। মারজান তদন্ত কমিটির কাছে যেখানে লিখিতভাবে স্বীকার করেছে যে, সে জমা দিয়েছে, রিভিউয়ারের কপিও সেই নিয়েছিল এবং এটি তার অনিচ্ছাকৃত ভুল, অথচ তদন্ত কমিটি বলছে দালিলিক প্রমাণ নাকি অস্পষ্ট কে জমা দিয়েছে! মারজান নিজে তদন্ত কমিটির কাছে জমা দেওয়া ও রিভিউ করার কথা লিখিতভাবে বলার পরও কেন দালিলিক প্রমাণ অস্পষ্ট বলে তদন্ত কমিটি? এ সংক্রান্ত প্রমাণস্বরূপ মারজানকে দেওয়া আমার মেইল পর্যন্ত তদন্ত কমিটির কাছে জমা দেওয়া হয়েছিল। তদন্ত কমিটি সেক্ষেত্রেও নিশ্চুপ থেকেছে। কারণ উদ্দেশ্য আমাকে শাস্তি দেওয়া।’
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ বলেন, ‘সামিয়া যে বিভাগের শিক্ষক ছিলেন সে বিভাগে কাজের সূত্রে আমার সঙ্গে একটা দীর্ঘ সম্পর্ক আছে। সামিয়া যখন এ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হওয়ার জন্য আবেদন করেন, তখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। আজাদ চৌধুরী তখন ভিসি। স্যারের কক্ষে সামিয়ার সঙ্গে আমার তখন দেখা হয়। তখন নিজেও রি-কমান্ড করে ছিলাম এমন একটা মানুষ যাতে শিক্ষক হয়। সামিয়া ঠিকই তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। তবে তাঁর স্বপক্ষে যে অভিযোগগুলো ছুঁড়ে দেওয়া হয়েছে, তা সম্পূর্ণ মিথ্যা। এটা উদ্দেশ্য প্রণোদিত বলা যেতে পারে, যা নিয়ে নতুন করে জল্পনার অবকাশ নেই। আর যে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা নেই, যে বিষয়ে কোনো আইন প্রণয়ন করা হয়নি; সে বিষয়ে … চাপিয়ে দেওয়া ন্যক্কারজনক।’