সম্পূর্ণ কোরআন মনোযোগ দিয়ে পড়েছি : জাফর ইকবাল
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) ক্যাম্পাসে ফিরে শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেছেন, “আমি পবিত্র কোরআন শরিফ সম্পূর্ণ খুব মনোযোগ দিয়ে পড়েছি। কোরআনে লিখা আছে, ‘যদি তুমি একজন মানুষকে হত্যা করো, তবে তুমি পুরো মানবজাতিকে হত্যা করলে। আর যদি তুমি একজন মানুষকে বাঁচাও তবে তুমি পুরো মানবজাতিকে বাঁচালে।’ আমার মনের ভেতর তার জন্য করুণা হয় যে আমাকে আঘাত করেছে। আমার জানতে ইচ্ছে করে, একজন মানুষ কত দুঃখী হতে পারে যার চিন্তা আরেক মানুষকে হত্যা করে সে বেহেশত যাবে। তোমরা যারা এ ধরনের চিন্তায় আছ, তারা অস্ত্র রেখে আমার কাছে আস, আমাকে বোঝাও। কি বিভ্রান্তিতে আছ, আমাকে জানাও, আমি শুনব।”
আজ বুধবার বিকেল ৪টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তমঞ্চে সাধারণ শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে ‘সাদাসিধে কথা জাফর স্যার ও আমরা’ শীর্ষক এক অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন জাফর ইকবাল।
এ সময় হামলার দিনের ঘটনার কথা স্মরণ করে জাফর ইকবাল বলেন, ‘আমাকে যখন আঘাত করা হয়, আমি বুঝতে পারিনি। কিন্তু আমার সামনে একটি মেয়ে চিৎকার করছে। কিছুক্ষণের মাঝে পুলিশের গাড়িতে করে আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। রাস্তায় আমার মনে হয়, আমার ব্রেন ইনজুর্ড হয়নি তো। কারণ ব্রেন না থাকলে মানুষের বেঁচে থাকার কোনো লাভ নেই। তখন আমি সমীকরণ মনে করে, কবিতা মনে করে ব্রেন টেস্ট করা শুরু করলাম। আমি আমার স্ত্রীকে তখন ফোন দিয়ে বলেছিলাম, আমি এখনো চিন্তা করতে পারছি।’
শাবিপ্রবির কম্পিউটার সায়েন্স ও ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক জাফর ইকবাল আরো বলেন, ‘নিশ্চয় খোদা চান আমি কিছু একটা করি, তাই আমি ফিরে এসেছি। মানুষ আমাকে এত ভালোবাসে তা আমার পক্ষে ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। আর আমি চেষ্টাও করব না।’ এ সময় তিনি পুলিশ, চিকিৎসক ও সেনা সদস্যদের তাদের কর্মদক্ষতার জন্য ভূয়সী প্রশংসা করেন ও তাদের ধন্যবাদ জানান।
জাফর ইকবাল শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলেন, ‘২০১৫ সালের ৩০ আগস্ট কিছু ছাত্র শিক্ষকদের গায়ে হাত তুলেছিল। এরপর থেকে এক ধরনের মনঃকষ্ট থেকে নিজেকে সব কিছু থেকে গুটিয়ে নিয়েছিলাম। ছাত্রছাত্রীদের দূরে সরিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু আজ আমি আমার ভুল বুঝতে পারছি। আমার ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশে বলছি, আমি তোমাদের সাথে এবং তোমাদের সাথেই থাকব।’
মুক্তমঞ্চের চার দিকে হাজারো শিক্ষার্থীর সামনে দাঁড়িয়ে আবেগ আপ্লুত কণ্ঠে জনপ্রিয় লেখক বলেন, ‘যখন আমি বেঁচে ফিরত আসছি বারবার ঘুরে ফিরে অভিজিৎ, অনন্ত, নিলয়, দীপন, ওয়াসিক ও হুমায়ুন আজাদের কথা মনে পড়েছে। আরো অনেকের কথা মনে পড়েছে যাদের নাম হয়তো এই মুহূর্তে মনে আসছে না। উনারা সব আস্তে আস্তে স্মৃতি হয়ে গিয়েছে। আমার নামটাও ওদের সাথে যুক্ত হতে পারত। কিন্তু বেঁচে গেছি। যাঁরা আমাদের মাঝে ফিরে আসে নাই, তাদের পরিবারের প্রতি সম্মান জানাচ্ছি।’
এর আগে স্বস্তি প্রকাশ করে পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থী শাহজাদী নওরীন বলেন, ‘জাফর ইকবাল শুধু একজন লেখকই নন, তিনি আমাদের শৈশব, আমাদের স্বপ্ন দেখার কারিগর, ভালো কিছু করার প্রেরণা, যার জন্য আমাদের অসম্ভব সাহসী হয়ে ওঠা, যার জন্য তরুণ সমাজ অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে শিখেছে।
জাফর ইকবালকে উদ্দেশ করে নওরীন বলেন, ‘আপনার ওপর বর্বর হামলায় আমরা ব্যথিত, ক্ষুব্ধ। আপনি ফিরে আসায় আমরা নির্ভার।’
এ সময় অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন শাবিপ্রবির উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ, জাফর ইকবালের স্ত্রী অধ্যাপক ইয়াসমীন হক, কোষাধ্যক্ষ ইলিয়াস উদ্দিন বিশ্বাস, প্রবীণ সাংবাদিক আবেদ খান প্রমুখ।
সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়ে দীর্ঘ ১১ দিন ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসা শেষে জনপ্রিয় কথা সাহিত্যিক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল ৩২০ একরের শাবিপ্রবির সবুজ ক্যাম্পাসে ফিরে আসায় হাজারো শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মাঝে স্বস্তির হাওয়া বইছে। প্রাণের ক্যাম্পাসে ফিরে একদিকে যেমন উদ্বেলিত জাফর ইকবাল অন্যদিকে পাহাড়-টিলা আর সবুজ বৃক্ষ দ্বারা বেষ্টিত ক্যাম্পাসও যেন ফিরে পেয়েছে প্রাণ।
আজ বুধবার দুপুর সোয়া ১টার দিকে পুলিশী পাহাড়ায় ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেন জাফর ইকবাল। সামনে পেছনে পুলিশের গাড়ি বহরের মাঝে সাদা মাইক্রোবাসে করে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেন তিনি। সাদা মাইক্রোর ডান দিকে জানালার পাশে জাফর ইকবাল, বাঁয়ে তাঁর মেয়ে ইয়েশিম ইকবাল ও সহধর্মিণী ড. ইয়াসমীন হক বসে ছিলেন। ক্যাম্পাসে প্রবেশ করলেও তিনি কোনো জায়গায় থামেননি বা কারো সঙ্গে কথা বলেননি। এ সময় জাফর ইকবালের গাড়িবহর সোজা শিক্ষক কোয়ার্টারে দিকে চলে যায়।
হামলাকারী ফয়জুলকে ক্ষমা : অধ্যাপক জাফর ইকবাল হামলাকারী ফয়জুল হাসান সম্পর্কে বলেন, ‘তার (ফয়জুল) প্রতি আমার বিন্দুমাত্র কোনো প্রতিহিংসা নাই, রাগ নাই, শুধু মায়া হয়, করুণা হয়। সে এই কাজ করেছে বেহেশতে যাওয়ার জন্য। তাকে এটা বুঝানো হয়েছে যে, সে যদি আমাকে মারতে পারে তাহলে বেহেশতে যেতে পারবে। এত সুন্দর একটি পৃথিবীকে সে উপভোগ করতে পারছে না ভেবে আমার মায়া হয়।’
জাফর ইকবাল বলেন, ‘এখানেও হয়তো এমন কেউ আছে যে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আর ভাবছে আজ পারলাম না। পরে হয়তো একবার সুযোগ নেব। এমন কেউ থাকলে আমি বলব, তোমাদের মধ্যে যদি কোনো বিভ্রান্তি থাকে, দয়া করে আমার সাথে দেখা করতে আস। সামনা সামনি আমার সাথে কথা বলো প্লিজ। আমি শুনতে চাই তোমার মধ্যে কি নিয়ে এত বিভ্রান্তি।’
গত ৩ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তমঞ্চে ইইই ফেস্টিভ্যালের সমাপনী অনুষ্ঠান চলাকালে সন্ত্রাসী হামলার শিকার হন জাফর ইকবাল। গুরুতর আহত অবস্থায় তাঁকে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে জাফর ইকবালকে ঢাকা সিএমএইচে পাঠানো হয়।