এবার ছাত্রদের হয়রানি করা হলে জবাব দেবেন ঢাবি শিক্ষকরা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সাম্প্রতিক ঘটনায় ছাত্রছাত্রীদের হয়রানির প্রতিবাদে মানববন্ধন করেছেন সচেতন শিক্ষকরা। তাঁরা বলেছেন, এবার থেকে যদি ছাত্রদের হয়রানি করা হয়, তাহলে শিক্ষকরা সমুচিত জবাব দেবেন।
আজ রোববার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে ‘ছাত্রছাত্রীদের নিরাপত্তা ও মর্যাদা রক্ষা কর’ শীর্ষক মানববন্ধন থেকে এসব কথা জানানো হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সচেতন শিক্ষকবৃন্দের ব্যানারে এই মানববন্ধনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রতি ছয়টি লিখিত দাবি পাঠ করা হয়।
মানববন্ধনে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, ‘ছাত্রছাত্রীদের পাশে আমরা শিক্ষকরা আছি। তোমাদের যেকোনো ন্যায্য দাবির সঙ্গে আমরা সঙ্গে আছি। আমরা পাশে থাকব। যদি ছাত্রদের হয়রানি করা হয়, তাহলে শিক্ষকরা সমুচিত জবাব দেবেন। ছাত্রদের আটক করার আগে আমাদের আটক করতে হবে।’
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রতি ছয়টি লিখিত দাবি পাঠ করেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক তানজীম উদ্দিন খান। দাবিগুলো হলো—বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ছাত্রছাত্রীর শিক্ষার পরিবেশ অক্ষুণ্ণ রাখতে হবে, তাদের মত প্রকাশের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে, ক্যাম্পাসে সব শিক্ষার্থীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে, বিধিসম্মতভাবে সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া ব্যতীত অন্য কারো বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না, রাষ্ট্রীয় বাহিনী কিংবা বেসরকারি কোনো গোষ্ঠী দ্বারা কোনো ছাত্রছাত্রী যেন আক্রান্ত না হয়, সে জন্য অবিলম্বে একটি বিশেষ সেল গঠন করতে হবে।
এ ছাড়া অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে নয়, আন্দোলন চলাকালে ঘটে যাওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাগুলোর সঙ্গে যারা সুনির্দিষ্টভাবে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনে নারকীয় তাণ্ডব চালানোর জন্য যারা জড়িত, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ভবনসহ সব আাবাসিক এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মর্যাদা সমুন্নত রাখতে হবে এবং তাদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার সুরক্ষা দিতে হবে।
মানববন্ধনে লেখক গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, ‘আজকে কয়েক দিন কয়েকজন শিক্ষকের নাম অব্যাহতভাবে মনে আসছে। তাঁরা হলেন, স্যার পি জে হার্টজ, অধ্যাপক আহমেদ ফয়জুর রহমান, অধ্যাপক রমেশ চন্দ্র মজুমদার। তাঁরা যদি বেঁচে থাকতেন, হয়তো তাঁদের আত্মা দেখছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁরাও ছিলেন। এই অধ্যাপকরা কোনো শিক্ষার্থীর সামান্য ইনফ্লুয়েঞ্জা হলেও ছাত্রদের কাছে ছুটে যেতেন। এমনও হয়েছে, রাত ২/৩টা পর্যন্ত সঙ্গে থাকতেন। সুতরাং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যিনি উপাচার্য, তিনি শিক্ষার্থীদের যেমন শিক্ষক, তেমন অভিভাবকও। তিনি বলেছেন, অভিভাবকদের কাছে হস্তান্তর করেছেন। এটা আমার কাছে অত্যন্ত বেদনাদায়ক মনে হয়েছে। বাংলাদেশে এই প্রথম প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নারী নির্যাতিত হলো। সেটা হলো বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ ভূখণ্ড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। সুতরাং এটা আমাদের সকলের জন্য লজ্জার। আমি শুধু এটা বলব প্রাতিষ্ঠানিক নারী নির্যাতনের ঘটনা এটাই যেন সর্বশেষ হয়।’
সভাপতির বক্তব্য অধ্যাপক এম এম আকাশ বলেন, ‘আমাদের মূল দাবি হলো দুটি—আমরা ছাত্রদের নিরাপত্তা চাই, শিক্ষকদেরও নিরাপত্তা চাই।’
কেন এই সমস্যার সৃষ্টি হলো উল্লেখ করে এই অধ্যাপক বলেন, ‘কারণ রাষ্ট্রযন্ত্র স্বায়ত্তশাসন লঙ্ঘন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ওপর হামলা করেছে। আমরা জানি, স্বায়ত্তশাসন অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং প্রক্টরের অনুমতি ছাড়া পুলিশ ঢুকতে পারে না। সুতরাং ঢাবি স্বায়ত্তশাসন অনুযায়ী পুলিশ যখন তখন এখানে কিছু করতে পারবে না। তাকে আগে পূর্বানুমতি নিতে হবে।’
প্রশাসন দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে উল্লেখ করে এম এম আকাশ বলেন, ‘আমাদের যাঁরা দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকরা আছেন, যাঁদের আমরা নির্বাচিত করেছি। আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, তাঁরা তাঁদের দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করছেন না। কারণ আমরা যেকোনো হলে রাত ১০টায় যদি আমরা উঁকি মারি। তাহলে আমরা দেখতে পাই, সেখানে একটা সামন্তপ্রভুর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হয়েছে। প্রতিটি হলে একটি বিশেষ দল গেস্টরুম-গণরুমকে আশ্রয় করে, সেখানে ছাত্রদের থাকতে দেয়। সেই সুবাদে তাদের দিয়ে মিছিল করায়। তাদেরকে দিয়ে নানা রকম কাজ করায়। তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিশেষ আদর্শ গ্রহণ করতে বাধ্য করে। সেই হলের প্রভোস্ট এবং হাউসটিউটরের দায়িত্ব ছিল, এই ধরনের কার্যকলাপ থেকে তাদের বিরত করা। কিন্তু তারা দলের স্বার্থ দেখবেন নাকি ছাত্রের স্বার্থ দেখবেন। এই দুয়ের মাঝে দোদুল্যমান আছেন। তবে কেউ কেউ বলেছেন, তাদের বিরুদ্ধে যদি ব্যাবস্থা নিতে যাই, তাহলে সশস্ত্র হামলা হবে। রাষ্ট্র তাদের পক্ষে অবস্থান নেবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবাই ভালো মানুষ নয় উল্লেখ করে এই অধ্যাপক বলেন, ছাত্রদের মাঝে যেমন খারাপ থাকতে পারে, আবার শিক্ষকের মাঝে খারাপ থাকতে পারে। কেউ যদি অন্যায় করে, তাহলে বিধিসম্মতভাবে নিয়ম অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্ডিন্যান্সও তা আছে। সেই বিধি অনুসরণ করতে গিয়ে কোনো দলীয় পক্ষপাত নিলে চলবে না। যার যতটুকু অপরাধ, তাকে ততটুকু শাস্তি সঠিকভাবে চিহ্নিত করে দিতে হবে।
প্রশাসন মূল্যবোধ লঙ্ঘন করেছে উল্লেখ করে এম এম আকাশ বলেন, ‘রাতের অন্ধকারে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ার অপরাধে বের করে দেওয়া হলো। যদি দিয়ে থাকে তারা নিজেরা দিয়েছে কি না অথবা অন্য কেউ তাদের আইডিতে দিয়েছে কি না, এটা তো তদন্ত করে দেখতে হবে। সাইবার স্পেশালিস্ট নিয়ে এসে সেটা দেখতে পারত। এটা বাংলাদেশের মূল্যবোধ নয়, যে রাত ১টা-২টা বাজে মেয়েদের হল থেকে বের করে দেবো। সুতরাং বাংলাদেশের যে স্বাভাবিক মূল্যবোধ, সেটা লঙ্ঘন করা হয়েছে। যারা করেছে, তারা সেই মূল্যবোধ লঙ্ঘন করেছে।’
দুটি বিষয়ে উপাচার্যকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে উল্লেখ করে এই অধ্যাপক বলেন, প্রথমটি হলো ছাত্রদের গণতান্ত্রিক অধিকার, অর্থাৎ ডাকসু নির্বাচন দিতে হবে। দ্বিতীয়টি হলগুলোকে দায়িত্বশীল প্রশাসন দিয়ে হলগুলোকে দখলমুক্ত করতে হবে।
অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌসের সঞ্চালনায় এতে অন্যদের মধ্যে আরো উপস্থিত ছিলেন মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক নাসরীন ওয়াদুদ, আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান নুরুল আমিন বেপারী, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের অধ্যাপক সংগীতা আহমেদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক তাসনীম সিদ্দিকীসহ অর্ধশত শিক্ষক।