বশেমুরবিপ্রবির আন্দোলনকারীদের ওপর বহিরাগতদের হামলা
উপাচার্যের (ভিসি) পদত্যাগের দাবিতে লাগাতার আন্দোলনের মধ্যেই গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরবিপ্রবি) শিক্ষার্থীদের ওপর বহিরাগতরা হামলা চালিয়েছে। এতে সাংবাদিক, শিক্ষার্থীসহ অন্তত ২৫ জন আহত হয়েছে। অনেককে গোপালগঞ্জ সদর হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছে আন্দোলনকারীরা।
আজ শনিবার সকালে ক্যাম্পাস বন্ধ করে শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার নির্দেশ, হল ও ক্যাম্পাসে পানি, ক্যান্টিন ও ওয়াইফাই বন্ধের ঘটনার পর দুপুরে ক্যাম্পাসের বাইরে অন্তত দুটি জায়গায় শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার এই ঘটনা ঘটল।
এ ঘটনার পর ক্যাম্পাসে তুমুল বৃষ্টির মধ্যেই শিক্ষার্থীরা ভিসির পদত্যাগের দাবি করে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। ক্যাম্পাস আরো উত্তাল হয়ে উঠেছে। তবে এ ব্যাপারে চেষ্টা চালিয়েও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির সভাপতি শামস জাবিন দুপুরে এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশই গোপালগঞ্জ শহরের বিভিন্ন বাসাবাড়ি ও মেসে ভাড়া থাকে। দুপুরের দিকে তারা আন্দোলনে যোগ দিতে ক্যাম্পাসের দিকে আসছিল। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে পথে গোবরা ও সোনাপুর এলাকায় বহিরাগতরা তাদের ওপর এই হামলা চালায়।’
এতে তিন সাংবাদিক, এক নারী শিক্ষার্থীসহ অন্তত ২৫ জন আহত হয়েছে। আহত তিন সাংবাদিক হলেন- ক্যারিয়ার টাইমসের প্রতিনিধি তাহেদুল ইসলাম, বাংলাদেশ টুডের প্রতিনিধি সফিউল কায়েস এবং ঢাকা টাইমস ও প্রতিদিনের সংবাদের প্রতিনিধি জাহেদুল ইসলাম।
কারা এই হামলা চালিয়েছে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে আহত শিক্ষার্থীরা জানায়, যারা ভিসির দালাল হিসেবে কাজ করছে ক্যাম্পাসে ও ক্যাম্পাসের বাইরে তারাই এই হামলা চালিয়েছে। তারা আরো জানায়, এই ধরনের হামলা চালিয়ে আন্দোলন বন্ধ করা যাবে না। ভিসি পদত্যাগ না করা পর্যন্ত এই আন্দোলন চলবে।
‘বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা, হল ত্যাগের নির্দেশ’
আজ সকালে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আগামীকাল রোববার থেকে আগামী ৩ অক্টোবর পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের ঘোষণা দেয়। এর পাশাপাশি আজ শনিবার সকাল ১০টার মধ্যে শিক্ষার্থীদের হল খালি করার নির্দেশ দেয়। এনটিভি অনলাইনকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক আশিকুজ্জামান ভূঁইয়া।
তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের এই সিদ্ধান্ত ‘অযৌক্তিক ও অবৈধ’ আখ্যা দিয়ে সকাল থেকেই ক্যাম্পাসে ভিসি অধ্যাপক ড. খন্দকার নাসির উদ্দিনের পদত্যাগসহ অন্যান্য দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল অব্যাহত রেখেছে শিক্ষার্থীরা।
অপরদিকে আজ সকাল থেকেই ক্যাম্পাসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পুলিশ, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট অবস্থান নিয়েছেন বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছে। এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের একটি সূত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যাতে অবনতি না হয় সেজন্য বাইরের জেলা থেকে পুলিশ ও র্যাব আনা হয়েছে।
শিক্ষার্থীরা সকাল থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবন ও ফটকে অবস্থান নিয়ে ভিসিবিরোধী স্লোগান দিচ্ছে। তারা বলছে, ভিসি পদত্যাগ না করা পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।
হলের পানি-খাবার বন্ধ, বিদ্যুৎও নেই
এর পরই সব হলের পানি ও ক্যান্টিন বন্ধ করে দেওয়ার অভিযোগ করেছে শিক্ষার্থীরা। তাদের আরো অভিযোগ, ক্যাম্পাসের সব খাবারের দোকানও কর্তৃপক্ষ জোর করে বন্ধ করে দিয়েছে। এর ফলে শিক্ষার্থীরা সকাল থেকে না খেয়ে আছে।
যদিও এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। একটি সূত্র বলেছে, আজ বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইনে সংস্কারকাজ চলার কারণে সকালে থেকে গোলাপগঞ্জে বিদ্যুৎও নেই। ফলে এর অংশ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেও কোনো বিদ্যুৎ নেই। তবে শিক্ষার্থীরা বলছে, অন্য সময়ে বিদ্যুৎ না থাকলে প্রশাসন জেনারেটরের মাধ্যমে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করে থাকে। আজকে সেই ধরনের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
আইন বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী নজরুল ইসলাম সকাল ১১টার দিকে এনটিভি অনলাইনকে অভিযোগ করে বলেন, ‘বন্ধের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় ছুটির এই সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক ও অবৈধ। আমরা এটা মানি না। কোনো ছাত্রছাত্রী হল ছেড়ে যাবে না। ভিসির দালাল শিক্ষকরা ছাত্রীদের জোর করে হল থেকে বের করে দেওয়ার চেষ্টা করছে।’
এই আন্দোলনকারী বলেন, সকাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় হলের পানি ও বিদ্যুৎ বন্ধ রয়েছে। হলের ক্যান্টিন, ক্যাম্পাসের খাবারের দোকানও বন্ধ। ক্যাম্পাসের ভিতরের ওয়াইফাই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির সভাপতি শামস জেবিন দুপুরে এনটিভি অনলাইনকে হলে পানি, বিদ্যুৎ, খাবার না থাকার বিষয়টি নিশ্চত করেছেন।
হলের পানি, বিদ্যুৎ খাবারের ক্যান্টিন বন্ধের ব্যাপারে জানতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও কারো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
যেভাবে আন্দোলনের সূত্রপাত
সম্প্রতি ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান কাজ কী’—এই বাক্যটি ফেসবুকে পোস্ট করার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী ও দ্য ডেইলি সানের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি ফাতেমা-তুজ-জিনিয়াকে নিজের কক্ষে নিয়ে অশোভন ভাষায় কথা বলেন ভিসি। তাঁদের কথোপকথনের একটি অডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফাঁস হয়ে যায়।
সেখানে ভিসিকে বলতে শোনা যায়, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ কী? ফাজিল কোথাকার! বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ কী, তুমি জান না? বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ তোমাদের মতো বেয়াদব তৈরি করা। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ কী, তোর আব্বার কাছে শুনিস। গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো দিন?’
উপাচার্য বলছিলেন, ‘আমি খুলছি বলেই তো তোর চান্স হইছে। না হলে তো তুই রাস্তা দিয়া ঘুরে বেড়াতি। বেয়াদব ছেলেমেয়ে।’
অডিও ফাঁসের পর জিনিয়াকে বহিষ্কার করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এই সিদ্ধান্তকে অবৈধ, অমানবিক, স্বাধীন মতপ্রকাশের প্রতিবন্ধক ও সাংবাদিকতার জন্য হুমকি হিসেবে উল্লেখ করে প্রতিবাদ জানিয়েছে বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন। এরপর নিজের জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন জিনিয়া। দুদিন বাদেই কর্তৃপক্ষ জিনিয়ার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে। এর আগেও শ্রেণিকক্ষ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট করার দায়ে পাঁচ শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করেছিল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
এরপর গত বুধবার রাতেই ভিসিবিরোধী আন্দোলনে নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তারপর গভীর রাতে একটি অফিস আদেশ আসে, যেখানে ১৪ দফা মেনে নেওয়ার কথা বলা হয়। কিন্তু শিক্ষার্থীরা এই অফিস আদেশ আমলে না নিয়ে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে আবার ভিসির পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে, যা আজও অব্যাহত আছে।